শিশুদের ফেইসবুক আসক্তি: বর্তমান অবস্থা এবং প্রতিকার
প্রকাশিত : ১১:১৫ পিএম, ৮ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৪:৫৪ পিএম, ১৪ মার্চ ২০১৮ বুধবার
বর্তমান বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি মানুষ সম্পৃক্ত। এর মাধ্যমে একে অপরের সাথে যেমন পরিচিত হওয়া যায়, আবার মুহূর্তের মধ্যে জানা যায় বিশ্বের কোথায় কি ঘটছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন সংবাদ মাধ্যমের চেয়েও দ্রুতগতিতে খবর পৌঁছে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফলে উপকৃত হচ্ছে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
তবে আমাদের শিশুরা ফেইসবুক, টুইটার বা ইন্সটাগ্রাম যেভাবে বহুলভাবে ব্যবহার করছে তাতে এটি আসক্তির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অভিভাবকদের জন্য। বাংলাদেশ বা উন্নত বিশ্বের প্রায় সবদেশে এ চিত্র অভিন্ন।
গত বছর ৩১ ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান মতে, মাসে অন্তত একবার ফেইসবুক ব্যবহার করেন এমন লোকের সংখ্যা ২.১৩ বিলিয়ন। গত বছর এপ্রিলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা আড়াই কোটি। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে একটি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফেইসবুক ব্যবহারকারী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ঢাকা। ফেইসবুক, ভায়োলেন্স এন্ড সেইফটি অফ চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ নামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে আট বছর বয়সের শিশুরাও ফেইসবুক ব্যবহার করছে। গবেষণা জরিপে অংশগ্রহনকারী ১৪ শতাংশ শিশু স্বীকার করেছে তারা ১৩ বছরের কম বয়সী হলেও আইন অমান্য করে ফেইসবুকে একাউন্ট খোলেছে।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে ১১ ও ১২ বছর বয়সী শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি শিশুর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাউন্ট আছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা অফকম। এসব মাধ্যমে একাউন্ট খুলতে হলে আইন অনুযায়ী ১৩ বছর বয়সী হতে হয়। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১০ বছর বয়সীদের ২৮ শতাংশ, ১১ বছর বয়সীদের ৪৬ শতাংশ এবং ১২ বছর বয়সীদের ৫১ শতাংশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাউন্ট আছে। প্রতি দশজন অভিভাবকের মধ্যে আটজনই এসব মাধ্যম ব্যবহারের জন্য যে বয়সের বাধ্যবাধকতা রয়েছে সেটা জানেন না।
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ফেইসবুকের সাবেক নির্বাহী চামাথ পালিহাপিটিয়া দু:খ করেছেন এই বলে যে, তিনি নিজেকে দোষী মনে করেন, কারণ সমাজের সুখ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি ফেইসবুকের বিভিন্ন টুলস তৈরি করেছেন। তিনি নিজের সন্তানদের ফেইসবুক ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন। এর আগে গত নভেম্বরে ফেইসবুকের বিনিয়োগকারী শেন পার্কার বলেছেন, তিনি স্যোশাল মিডিয়ার বিরুদ্ধে ন্যায়বান বিরোধীতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি ফেইসবুক এবং অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমকে সংবেদনশীল মানবিক মনস্তত্ত্বকে শোষণ করছে বলেও অভিযোগ করেন। এবছর জানুয়ারীতে এ্যাপলের দুই বিনিয়োগকারী শিশুদের জন্য আইফোন এবং আইপ্যাড ব্যবহার সীমিত করার জন্য সহজ উপায় বের করার জন্য প্রতিষ্টানটির প্রতি আহবান জানান। শতাধিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শিশুদের জন্য ফেইসবুকের মেসেজ সুবিধা বন্ধ করারও দাবি জানিয়েছেন।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেইসবুক আসক্তি কোকেন আসক্তির মতো মানুষের মগজে প্রভাব ফেলে। একে কারের এক্সেলেটরের সঙ্গে তুলনা করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওফির টুরেল বলেছেন, ফেইসবুক আসক্তি মানুষের মগজকে বেশি পরিমাণে সক্রিয় করে তুলে। এই গবেষণায় দেখা গেছে, ফেইসবুক ব্যবহারকালে মানুষের মস্তিষ্কের এমেগডালা নামক একটি অংশ সক্রিয় হয়, যেটি আবেগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্ট্রেইটাম নামক আরেকটি অংশকেও সক্রিয় করে, যেটি পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দেয়। এতে আরো দেখা যায়, অংশগ্রহনকারীদের অনেকে সড়ক চিহেৃর চেয়েও ফেইসবুকের প্রতি অতিমাত্রায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়।
ফেইসবুক এবং গুগলে কাজ করা দুইজন প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিকে সম্পর্কে সচেতন করার জন্য প্রচারণা শুরু করেছেন। ফেইসবুকে কাজ করা রজার ম্যাকনেমি এবং গুগলে কাজ করা ট্রিসটান হ্যারিস দি সেন্টার ফর হিউম্যান টেকনোলজি নামের এই প্রচারণায় প্রযুক্তিকে মানুষের সর্বোচ্চ স্বার্থে ব্যবহারের লক্ষ্যে কাজ করছেন। তাদের অভিযোগ প্রযুক্তি আমাদের মন এবং সমাজকে অপহরণ করছে।
অ্যাপলের সিইও টিম কুক নিজের ভাতিজাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখতে চাননা বলে মন্তব্য করেছেন। ফেইসবুকের লাইক বাটনের আবিস্কারক জাস্টিন রসেনটেইন আসক্তির ভয়ে নিজের আইফোনে ফেইসবুক অ্যাপস ডাউনলোড করেননি।
২০১৭ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাজ্যের ১৫ বছর বয়সী ১২ হাজার শিশুর উপর এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কম ব্যবহার করে, তারা যদি এর ব্যবহার বাড়িয়ে দেয় তাহলে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ দ্রুত হয়। আর যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অত্যাধিক সময় ব্যয় করে, তারা যদি আরো বেশি সময় দেয় তাহলে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এই প্রতিবেদনের একজন লেখক অধ্যাপক জেইন ওয়েঙ্গ শিশুদের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত করার পক্ষে মত দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহারের কারণে মানসিক ক্ষতি বেশি হচ্ছে। মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার ব্যবহারের জন্য চোখ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি মেরুদণ্ডের ব্যথা হতে পারে। হতে পারে ঘুমের সমস্যাও। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মূল যে সমস্যাটা হয় সেটা হলো ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আসক্তি। আসক্তির ফলে মানুষ সহজে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারেনা। এর ফলে অনেক পাশ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। পড়াশোনায় মনোযোগ কমে গিয়ে ফেইসবুকের প্রতি অত্যাধিক মনোযোগ দেখা দেয়। দিনের মধ্যে স্কুলের সময় ছাড়া অন্যান্য সময়ে শিশুরা মোবাইল, কম্পিউটার বা ল্যাপটপে বেশিরভাগ সময় কাটায়। অনেকে আবার স্কুলের ইন্টারনেট ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরাঘুরি করে। শিশুদের মধ্যে গণিত বা ইংরেজী ক্লাশের চেয়ে কম্পিউটার ক্লাশের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখা যায় মূলত এ কারণেই। এতে অন্যান্য ক্লাশের প্রতি তাদের মনোযোগ কমে যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তির কারণে শিশুরা অন্তর্মূখী হয়ে যাওয়াসহ আচরণগত অনেক পরিবর্তন দেখা যায়। শিশুরা পিতামাতা, ভাইবোনের চেয়ে ফেইসবুক বন্ধুদের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হয়ে যায়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কোন সমস্যার কথা শেয়ার করতে চায় না, বরং তাদের ফেইসবুক বন্ধুদের সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করতে চায়। ফলে পরিবারের মধ্যে বন্ধন শিথিল হয়ে যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে অনেক নেতিবাচক আচরণ গড়ে উঠে। বিভিন্ন ধরনের ভিডিও এবং গেম দেখে শিশুরা নানা ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ করে। সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে ফেইসবুকের মাধ্যমে ছড়ানো গেম ব্লু হোয়েলের কথা বলা যায়। এই গেমের পাল্লায় পরে ভারত এবং বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন মারা গেছে এবং অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এখন দেখার বিষয় কিভাবে সন্তানদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আসক্তি থেকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। পিতামাতারা সাধারণত স্বাধীনতা দিতে গিয়ে বা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পিতামাো হতে গিয়ে সন্তানদের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়ার অভিপ্রায়ে সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ করে দেন। সন্তানের আবদার মেটাতে গিয়ে তাদের হাতে তুলে দেন অত্যাধুনিক মোবাইল, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ। পকেট খরচ হিসেবে দেন কাড়ি কাড়ি অর্থ। কিন্তু খেয়াল রাখেন না তাদের সন্তান কাদের সঙ্গে মিশছে, তার বন্ধুরা কোন প্রকৃতির, পড়াশোনা ঠিকভাবে করছে কিনা। কারণ ছোটবেলায় যদি সন্তানদের ঠিকভাবে গড়ে তোলা না যায় একটা সময় পর সেটা আর হয়ে উঠবে না। তাই শিশুকাল থেকেই সন্তানদের প্রতি বিশেষ যত্ম নিতে হবে। আধুনিক বিশ্বে প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া বেঁচে থাকা কঠিন হলেও প্রযুক্তির অপব্যবহার আপনার এবং আপনার সন্তানের জীবন বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। তাই প্রযুক্তির ব্যবহারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। শিশুদের সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করতে হবে। তাদের বুঝাতে হবে আপনি তার সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্খী। আপনার সঙ্গে সন্তান যেন সবসময় যোগাযোগ করতে পারে সেধরনের পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। অনেক পিতামাতা অর্থ-বিত্তের পেছনে ছুটতে গিয়ে সন্তানদের মোটেও সময় দেন না। এর ফলে সন্তানেরা নিজের জগৎ তৈরি করে যেখানে ফেইসবুক বা ক্লাশের বন্ধুরা হয়ে উঠে তার অত্যন্ত আপনজন। বন্ধুত্ব গড়ে তোলা খারাপ কিছু নয়, তবে অনেক সময় অসৎ সঙ্গে পড়ার আশংকা থাকে। এজন্য পিতামাতার উচিত সবসময় সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখা। শিশুরা বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করে। তাই মাঝে মধ্যে বা স্কুল ছুটির সময় একসঙ্গে সময় কাটানোর ব্যবস্থা হিসেবে পিকনিকের আয়োজন করা যেতে পারে।
শিশুদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলতে হবে। ভাল গল্পের বই, অনুকরণীয় মহান ব্যক্তিত্বের জীবনীগ্রন্থ, কৌতুকের বই, ছড়া বা কবিতার বই, ভ্রমণকাহিনী এসব পড়তে দিতে পারেন শিশুদের। ঘরের মধ্যে ছোটখাট হলেও একটি লাইব্রেরী বা কমপক্ষে একটি বইয়ের সেলফ রাখার চেষ্টা করতে হবে। বই নিজেও পড়তে হবে যা দেখে শিখবে সন্তানেরা।
শিশুদের অবসর সময় বেড়াতে নিয়ে যেতে পারেন। বিশেষ করে স্কুলের ছুটির সময় ঘুরে আসুন দর্শনীয় স্থানে, নিয়ে যান প্রকৃতির কাছাকাছি। এতে শিশুদের মন সতেজ থাকবে, মেজাজ হয়ে উঠবে ফুরফুরে।
পড়াশোনার পাশাপাশি শিশুদের অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করুন। নাচ, গানে উৎসাহিত করতে পারেন। অনেকের আবার আগ্রহ থাকে খেলাধুলায়। তাদের আরো বেশি করে উৎসাহ দেন।
এভাবে আপনার সন্তানদের ব্যস্ত রাখুন পড়াশোনা এবং অন্যান্য সৃজনশীল কাজে। এতে করে তারা প্রযুক্তি বা ফেইসবুক আসক্তি থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। পিতা-মাতা হিসেবে আপনি থাকবেন দুশ্চিন্তামুক্ত এবং আপনার সন্তানেরা গড়ে উঠবে দেশের উজ্জল ভবিষ্যত হিসেবে।
সরওয়ার হোসেন
চীফ নিউজ এডিটর, চ্যানেল আই ইউরোপ