ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ২০ ১৪৩১

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস রুটিনে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা

মোহাম্মদ ইউসুফ

প্রকাশিত : ০৬:৪৫ পিএম, ১০ মার্চ ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৪:৫৩ পিএম, ১৪ মার্চ ২০১৮ বুধবার

দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রচলিত ক্লাস রুটিন শিক্ষার্থীদের জন্যে মঙ্গলজনক না হলেও স্বাধীনতার চার দশক পরও এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্যে শুধু স্বাস্থ্যহানিকর নয়, শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রেও এ রুটিনে রয়েছে নানারকম অসুবিধা। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক এ ক্লাস রুটিন যে পরিবর্তন করা জরুরি- এ নিয়ে কেউ ভাবছে না। শিক্ষক নেতারা নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠ গরম করলেও অবিবেচনাপ্রসূত ও অস্বাভাবিক এ ক্লাস রুটিন নিয়ে কেউ উচ্চবা”্য করেন না। পাঁচ বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ক্লাস রুটিনে ঘণ্টার সময় বাড়ালেও আসল সমস্যার সুরাহা করেনি। গতানুগতিক ধারায় চলছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর পাঠক্রমিক কার্যক্রম।

বর্তমানে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালাগুলোতে স্বাধীনতার পর থেকে যে ক্লাসর রুটিন চলে আসছে তার সময়সূচি হচ্ছে: সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত; ক্লাস ৮ ঘণ্টা। কোথাও কোথাও সকাল সাড়ে ১০টা থেকেও ক্লাস শুরু হয়। ২০১৩ সাল থেকে যে  নিয়ম কার্যকর হয়েছে তা হল, সময় বাড়িয়ে ৮ ঘণ্টার স্থলে ৬ ঘণ্টা। আগে ৩৫-৪৫ মিনিটে ঘণ্টা হিসেব করা হতো। এ স্বল্প সময়ে পাঠদান সুসম্পন্ন হয় না বলে বর্তমানে ঘণ্টার সময় ৬০ মিনিট করা হয়েছে। পাঠদান কার্যক্রমের সর্বমোট সময় ৬ ঘণ্টা (৩৬০ মিনিট)। এটা নতুন কিছু নয়; স্বাধীনতার পর থেকেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ৮ ঘণ্টা (৩৫Ñ৪০মিনিট) ক্লাস হয়ে আসছে। সরকারি নিয়মে সব বিদ্যালয়ে ৬ ঘণ্টা ক্লাস হয় না। নিজেদের সুবিধা মতো সময় ঠিক রেখে কেউ কেউ ৭ ঘণ্টা কিংবা আগের মতো ৮ ঘণ্টা ক্লাস করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দিবসের প্রথম ভাগে অর্থাৎ ৭/৮ টা থেকে ক্লাস শুরু না হয়ে ১০টা অথবা সাড়ে ১০টায় কেন ক্লাস শুরু হবে। দেশের কিন্ডারগার্ডেন স্কুলগুলো সকাল ৭ বা ৮ টায় ক্লাস শুরু করতে পারলে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো নয় কেন? শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিয়ে কী একবারও ভেবেছেন?

বর্তমান ক্লাস রুটিনে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তেমন অসুবিধা হয় না। সবচে’ বেশি সমস্যার মুখোমুখি হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।বিশেষ করে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থীরা বেশি কষ্টের শিকার হয়। কেননা, শিক্ষক-কর্মচারিরা বাড়ি কিংবা বাসা থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে আসেন। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে বাড়ি থেকে খাবার আনা নানা কারণে সম্ভব হয়ে ওঠে না। কেউ কেউ আনলেও সেটা হাতে গোনা। যেসব শিক্ষার্থীর বাড়ি বিদ্যালয়ের কাছাকাছি তারা বাড়ি থেকে খেয়ে আসতে পারে। তবে মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় সিংহভাগ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়সংলগ্ন দোকান থেকে নি¤œমানের সিঙ্গোরা, চমোচা, চানাচুর, বাদাম, আইসক্রিম, বিস্কিট ইত্যাদি খেয়ে পেটের জামিন দেয়। শহরাঞ্চলে সামর্থ্যবান অভিভাবকদের সন্তানেরা হয়তো ভালো মানের খাবার নিয়ে বিদ্যালয়ে যায়। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। কিন্তু মফস্বলের খেটে খাওয়া মানুষের ছেলে মেয়েরা ৫/১০ টাকা নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। এমন গরিব ছেলে মেয়েও আছে যারা আইসক্রিম কিংবা নলক‚পের পানি পান করে টানা ৬/৭ ঘণ্টা বিদ্যালয়ে অবস্থান করতে হয়। প্রায় অভুক্ত শিক্ষার্থীরা মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবার শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নেয়। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীরা শারীবিকভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে যায়। শিক্ষকদের কথা মনোযোগসহকারে শোনার মতো পরিস্থিতি থাকে না। এ কারণে মধ্যাহ্ন এর আগে শিক্ষকদের পাঠদান যেভাবে ফলপ্রসূ হয়, পরে ঠিক সেইভাবে হয় না। এছাড়া অভূক্ত ছেলে মেয়েরা কালক্রমে গ্যাস্ট্রিক, আলসারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

বর্তমান রুটিনের কারণে ছাত্রছাত্রীদের বলতে গেলে প্রায় সারাদিন বিদ্যালয়ে কাটাতে হয়। শীতকালে তো তাদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে। খেলাধুলা ও বিশ্রাম করার সুযোগই থাকে না তাদের। শিক্ষার্থীরা এত বেশি পরিশ্রান্ত হয় যে, রাতে পড়াশোনায় আর তাদের মন বসে না। শিক্ষক প্রদত্ত বাড়ির কাজ শেষ করতে না করতেই অনেকেই পড়া অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে বিদ্যালয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি নিতেই সময় ফুরিয়ে যায়। এতে করে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বাড়ির কাজ শেষ করতে না পেরে শিক্ষকের ভয়ে বিদ্যালয়ে আসে না। বিদ্যালয়ে আসলেও কেউ কেউ নানা অজুহাতে চতুর্থ ঘণ্টার পর ছুটির আবেদন করে বাড়ি চলে যায়। আবার কেউ কেউ শিক্ষককে না জানিয়ে বিদ্যালয় থেকে পালিয়ে যায়। বিশেষ করে মফস্বলের বিদ্যালয়গুলোতে এমন চিত্র হরহামাশাই পরিলক্ষিত হয়।

বর্তমান রুটিনের কারণে যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা সমাধানের একমাত্র পথ হল রুটিনের সময় পরিবর্তন করা। অর্থাৎ সকাল ১০টা বা সাড়ে ১০টার পরিবর্তে সকাল ৭টা কিংবা সাড়ে ৭টা থেকে ক্লাস শুরু করতে হবে। দিবসের প্রথমভাগে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হবে। এটিকে মর্নিংস্কুল পদ্ধতিও বলা যেতে পারে। বেলা ১টা/দেড়টায় বিদ্যালয় ছুটি হয়ে যাবে। সকাল বেলায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার মন-মেজাজ সজীব ও সতেজ থাকে। লেখাপড়ার অনুক‚ল পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। এছাড়া মর্নিংস্কুল চালু হলে শিক্ষার্থীরা ছুটির পর বাড়িতে গিয়ে দুপুরের খাবার খেতে পারবে। বিশ্রাম, খেলাধুলা ও পড়াশোনার জন্যে প্রচুর সময় পাবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকেরাও প্রচুর সময় পাবেন; ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাÐে নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে পারবেন।

মর্নিংস্কুল পদ্ধতি চালু করতে নতুন করে কিছু করার দরকার নেই। স্কুলকর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে ৬ ঘণ্টা ঠিক রেখে দিনের যেকোনো সময় থেকে ক্লাস শুরু করতে পারে। এক্ষেত্রে আইনগত বাধা নেই। দেশের কোন কোন স্থানে স্কুলকর্তৃপক্ষ নিজস্ব উদ্যোগে সকাল ৮ টা থেকে ক্লাস করে আসছে। তারপরও শিক্ষামন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলেই ভালো। মন্ত্রণালয়ের গৃহীত সিদ্ধান্ত সার্কুলার আকারে দেশের সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠালে নতুন রুটিনেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্লাস চালু হবে।

লেখক: প্রধানসম্পাদক, চাটগাঁর বাণী