ঢাকা, বুধবার   ০৬ নভেম্বর ২০২৪,   কার্তিক ২২ ১৪৩১

দেশের মাটিকে না ভালোবাসলে কেউ বেশিদূর এগোতে পারে নাঃ শাইখ সিরাজ

প্রকাশিত : ১২:০৩ এএম, ১৩ মার্চ ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৪:১১ পিএম, ১৯ মার্চ ২০১৮ সোমবার

টিভিতে আমি একটা অনুষ্ঠান করেছি ‘ফিরে চল মাটির টানে’। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের নিয়ে গ্রামে গিয়েছি কৃষকদের সঙ্গে কাজ করার জন্য। আমাকে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেছেন, “আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের গ্রামে কৃষিকাজে নিয়ে গেলেন, তারা কি কৃষক হবে?” আমি বলেছি “না, তা হবে না”। কিন্তু একজন তরুণ যে শহরে-নগরে জন্মেছে, বড় হয়েছে, তার সামনে সকালে মা যখন নাশতাটা দেয় সে জানেও না এ খাবারটা কোথা থেকে আসে। এ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাটাও তার নেই।

এই তরুণকে গ্রামে নেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সে তার দেশকে, দেশের মাটিকে জানবে। একটা ভূ-খণ্ড কীভাবে স্বাধীন হয়েছে, এ সম্পর্কে তার সেভাবে ধারণা নেই। যে স্বাধীন ভূ-খণ্ডটা সে পেয়েছে, সেই মাটি স্পর্শ করলে সে কী অনুভব করে? একজন কৃষক আজীবন এ দেশটার জন্যে দিয়ে যায়। অথচ সে কিন্তু সমাজে কোনো মূল্য পেল না।

যে তরুণটি মাটি স্পর্শ করে কোনোদিন অনুধাবনই করল না, এই দেশের মাটি কত উর্বর, কত শক্তিশালী! সে যখন একটি ধানের চারা নিজের হাতে কাদার মধ্যে রোপণ করবে, তখন এ মাটির স্পর্শ তাকে শিহরিত করবে।

দেশের ৬৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে আমার দেশের কৃষক নিজের হাতে কাজ করছে। বছরে তিন কোটি টন খাদ্য উৎপন্ন করছে। গোটা জাতির খাবারের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। খাদ্যে আজ আমাদের দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে, স্বাধীনতার ৪৭ বছরে আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য কী? আমি বলব, খাদ্যে স্বয়ম্ভরতার ওপরে কোনো সাফল্য হতে পারে না। কারণ এ-ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা না এলে নানা ধরনের টানাপোড়েনের ভেতরে আমাদের থাকতে হতো।

আমি মনে করি, এ সবকিছু সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। কারণ তারা আগামীতে নেতৃত্ব দেবে। আর সত্য হচ্ছে দেশকে, দেশের মাটিকে না ভালবাসলে কেউ বেশিদূর এগোতে পারে না। এজন্যেই আমি তরুণদের নিয়ে গিয়েছি মাটির কাছে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর আমাদের কৃষির সমস্যা ছিল খাদ্যাভাব। গ্রামে গিয়ে দেখেছি এক বাড়িতে রান্না হচ্ছে, পাশে দুই-তিনজন দাঁড়িয়ে আছে ভাতের মাড় নেয়ার জন্যে। আর এখন আমাদের খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে। তবে বর্তমানে চ্যালেঞ্জগুলো অন্যরকম। এর একটি হলো দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন। ক্রমাগত পরিবর্তনশীল এ জলবায়ুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের কৃষি প্রযুক্তি ও এর উন্নয়নের অবকাঠামো গড়ে ওঠে নি।

আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এখন আমাদের দেশের কৃষিতে খুব দ্রুত বিদেশী বড় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবে। তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য আমাদের কৃষকদের নেই। তারা সব জমি কিনে নিলে আমাদের কৃষকরা হয়ে যাবে উদ্বাস্তু। সরকার যদি অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগকারী ও কৃষকদের মধ্যে চুক্তিতে সাহায্য করে তাহলেই কেবল তাদের রক্ষা করা সম্ভব।

ঢাকায় আমরা তরুণদের নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার ব্যাপারে বড় বড় সেমিনার করছি। সাধারণত তারা কেউ ঋণ ছাড়া ব্যবসা এগিয়ে নিতে পারছে না। আর গ্রামের একজন তরুণ হয়তো তার কৃষি জমিতে নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বিনিয়োগ করল। তার ঋণের কোনো সুযোগ নেই। তাহলে আসল উদ্যোক্তা হলো কে?

আমি এমন একজনকে চিনি, যিনি এবার উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিন কোটি চারা উৎপাদন করেছেন। একটি চারার মূল্য গড়ে ১০ টাকা হলে, তার এক বছরের আয় হবে ৩০ কোটি টাকা। বিপুল সম্ভাবনাময় এই কৃষিক্ষেত্রে আমাদের তরুণদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

বর্তমান সময়ে মানুষ এক ধরনের বিভ্রান্তিতে আচ্ছন্ন। সে কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের প্রয়োজন এমন একজন রোল মডেল যাকে তারা অনুসরণ করতে পারবে। কোয়ান্টাম মানুষকে মেডিটেশন শেখাচ্ছে, স্বপ্নের কথা বলছে। আমি মনে করি, জীবনে এই মেডিটেশন বা সাধনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

*৫ মার্চ ২০১৮ সোমবার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আয়োজিত মাসিক মুক্ত আলোচনার ৭৪ তম পর্বে সাংবাদিক শাইখ সিরাজের দেওয়া হুবহু বক্তব্য। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাদেশের কৃষিসম্পদ : সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ’।

এসি