‘বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশোর সবার জন্য অনুকরণীয়’
প্রকাশিত : ০৩:৪৭ পিএম, ১৭ মার্চ ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৩:৩২ পিএম, ১৯ মার্চ ২০১৮ সোমবার
সেলিনা হোসেন
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর চিন্তার গভীরে দেশপ্রেম লালন করতেন। তাঁর প্রতিটি কাজে অধিকার আদায়ের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ প্রাধান্য পেত। সেই চিন্তাটি আমরা শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। জাতির জনকের শৈশব-কৈশোর সব শিশু-কিশোরের জন্য অনুকরণীয়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান লেখক ও ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন। ১৭ মার্চ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, সবকিছুর দায়ভার আমরা সরকারের উপর না চাপিয়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জায়গা থেকে শিশুকিশোরদের জন্য কাজ করা উচিত। এর ফলে একদিকে যেমন তরুণরা মৌলবাদ- জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হবে না, সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ পাবে বেড়ে উঠার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ জাতির জনকের জন্মদিনকে আমরা জাতীয় শিশুদিবস হিসেবে পালন করে থাকি। এর অন্তর্নিহিত কারণটা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সেলিনা হোসেনঃ জাতির জনকের শৈশব ও কৈশোরের মধ্যেই তাঁর পরবর্তী জীবনের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে কোনো বড় মাপের মানুষ তাঁকে শিখিয়ে থাকতে পারেন। তাঁর পরিবারের কাছেও তিনি সে শিক্ষা পেতে পারেন। সেটা হলো শৈশবেই মানুষের প্রতি ভালোবাসার একটা দিক তাঁর চরিত্রে স্পষ্ট হয়। কোনো শীতার্ত মানুষকে দেখে তাকে গায়ের চাদর খুলে দিয়ে দেওয়া, স্কুলে বৃষ্টি ভেজা বন্ধু দেখে নিজের ছাতা দিয়ে দেওয়া, দরিদ্র মানুষকে বাবার গোলা থেকে চাল দেওয়া- এই ঘটনাগুলো মানবিক মূল্যবোধের খুব বড় উদাহরণ। বঙ্গবন্ধু তখন টুঙ্গিপাড়ার খোকা। তখন থেকেই তাঁর নিজের ভেতরে, নিজের বোধ থেকে মানুষের জন্য ভালোবাসার যে চর্চা তা সব শিশুর জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।
আরেকটা বিষয় হলো বঙ্গবন্ধুর এ চর্চাগুলোর পেছনে তাঁর পরিবারের উৎসাহ ছিল। কেন তুমি আরেকজনকে চাদর দিয়ে আসলা? কেন নতুন ছাতা অন্যজন কে দান করে দিলা? সেটা নিয়ে কখনও তাঁকে বকাঝকা শুনতে হয়নি। সবমিলিয়ে একজন শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোরকাল খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকরাও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া দরকার। বঙ্গবন্ধুর বাবা মা যে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন বা যে সুশিক্ষা দিতে সক্ষম হয়েছেন তা আমাদের সবার জন্য অনুকরণীয়। কীভাবে সন্তানকে পরিচালিত করলে সন্তান সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব তাও এখানে দেখা যায়। এসব বিবেচনায় এখানেই জাতির জনকের জন্মদিনকে জাতীয় শিশুদিবস হিসেবে পালন করার স্বার্থকতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিন্তার গভীরে দেশপ্রেম লালন করতেন। পাশাপাশি তাঁর প্রতিটি কাজে অধিকার আদায়ের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতেন। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোরকাল সব শিশু-কিশোরের জন্য অনুকরণীয় হওয়া উচিত।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ শিশুদের মধ্যে নৈতিকতা-মূল্যবোধ জাগ্রত করতে শিশু একাডেমির কোনো উদ্যোগ আছে কি না?
সেলিনা হোসেনঃ শিশু একাডেমীর কাজ হলো শিশুদের চেতনাবোধ জাগ্রত করা। সরকারি যেসব শিশু সদন আছে তা দেখাশোনা করা। সেখানে দু:স্থ ও পিতামাতাহীন শিশুরা এসে অবস্থান করে। সেখানে তাদের লেখাপড়া শেখানো হয়। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শিশুদের বিনোদনেরও ব্যবস্থা আছে। এসব মিলিয়ে শিশুদের মনোজগতে স্বাতন্ত্র একটি জগৎ তৈরি করতে কাজ করছে শিশু একাডেমি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ গৃহকর্ম থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত কোথাও শিশুরা নিরাপদ নয়। সেক্ষেত্রে কি করা যেতে পারে?
সেলিনা হোসেনঃ এখানে সরকারি উদ্যেগের পাশাপাশি ব্যক্তির উদ্যোগটাও জরুরি। একজন মা গৃহকর্মীকে যদি পেটায় তাকে না হয় পুলিশের হাতে দেওয়া গেল। কিন্তু মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যে জায়গাটা তৈরি হলো তা পূরণ হওয়া কঠিন কাজ। ব্যক্তি তো রোবট না। ব্যক্তির অনেক আচরণ নিয়ন্ত্রন করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যক্তির নিজেরই খারাপ আচরণগুলো নিয়ন্ত্রন করা দরকার। সেই বিবেচনায় আমি মনে করি, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগগুলো কাজে লাগানো উচিত। নয়তো নৈতিক মূল্যবোধের জায়গাগুলো আমরা অনবরত হারাতে থাকব।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ খেলার মাঠ সহ নানা ধরনের সুস্থ বিনোদনের অভাবে ভুগছে এখনকার শিশুরা। এক্ষেত্রে করনীয় কী?
সেলিনা হোসেনঃ আগেও বলেছি, সব অভিযোগ রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। ব্যক্তি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতা আছে। শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য তার চারপাশে সুস্থ জগৎ দরকার। এই শিশুটাই একদিন সমাজের নেতৃত্ব দিবে। সবচেয়ে বড় কথা, আমার শিশু আমার পরিবারের যেমন সদস্য তেমনি সে সমাজ ও রাষ্ট্রেরও সদস্য। তাই সব শিশুর ভাল চাওয়াটাও আমার দায়িত্ব। এই বোধ আমাদের ভেতরে তৈরি হতে হবে। আমি আমার সন্তানকে যেভাবে দেখব, আমার পাশের বাড়ির সন্তানকেও সেভাবে দেখব, আমার পথ শিশুটিকে খানিকটা হলেও সেভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করা উচিত। তাহলে তার সুন্দর ভবিষ্যত নিয়ে আমরা নতুনভাবে চিন্তা করতে শিখব।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনি একজন লেখক। সৃজনশীল জগৎ নিয়ে কাজ করেন। সেই জায়গা থেকে বর্তমান শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত মনে করেন?
সেলিনা হোসেনঃ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সততা, মানবিক মূল্যবোধ ও নীতি নৈতিকতার জায়গা থেকে যেমনটি হওয়ার কথা ছিল তেমনটি হয়নি। এসব পুরোপুরিই অনুপস্থিত। একটা শিশুর বিকাশের জন্য যা যা দরকার, স্কুল কর্তৃপক্ষ যদি নিজেদের নিয়মে তা তৈরি করে তাও একটা বড় দিক। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ও নির্দিষ্ট বইয়ের উপরে শিশুরা নির্ভরশীল হবে কেন? একটি জায়গায় বসিয়ে শিক্ষক তার ছাত্রদেরকে ধর্মের সার কথা শুনাবেন। ধর্মের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝাবেন। শিশুটি যদি তা বুঝতে পারে তাহলে সে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বড় হবে।
তার মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হবে। শিক্ষা কোন সীমিত পরিসরের বিষয় নয়। শিক্ষা লাভের পদ্ধতি নির্দিষ্ট বইয়ের মুখস্থা বিদ্যায় সম্ভব নয়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ সম্প্রতি সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সেলিনা হোসেনঃ আমরা সব সময় সরকার কী করছে, মন্ত্রনালয় কী উদ্যোগ নিচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে থাকব কেন? ব্যাক্তি হিসেবে আমার- আমাদের ভূমিকা কী তা নিয়েও মাথা ঘামানো উচিত বলে মনে করি। আমাদের অনেক সংগঠন আছে যারা শিশুদের নিয়ে কাজ করে। হ্যাঁ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটা সুবিধা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেকগুলো ছেলেমেয়ের কাছে একটা বাণী পৌঁছানো সহজ। কিন্তু এর বাইরে থেকেও ব্যক্তি, সমাজ ও সাংগঠনিকভাবে শিশুদের ভিতরে মানবিক মূল্যবোধ, নীতি নৈতিকতা, সততা-এসবের চর্চা বাড়ানো উচিত।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ চারদিকে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের সম্প্রসারন ঘটছে। যা আমাদের শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশে বড় বাধা। একজন লেখক হিসেবে এই সমস্যা উত্তোরনে কী উপায় আছে বলে মনে করছেন?
সেলিনা হোসেনঃ একটা সময় আমরা মাদ্রাসা শিক্ষাকে মৌলবাদের জন্য দায়ী করতাম। কিন্তু হলি আর্টিজানের ঘটনায় জড়িত তরুণদের পড়াশুনা, পারিবারিক পরিচয় আমাদের শিখিয়েছে সমস্যা অন্য জায়গায়। শুধু সরকারের উপর সব দায় চাপিয়ে না দিয়ে পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবাইকে নিজ নিজ জায়গায় সচেতন থাকতে হবে। ধর্মের আসল দিক কী, তার ব্যাখ্যা তরুণদের সামনে স্পষ্ট করতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ এবারের জাতীয় শিশু দিবসে শিশু-কিশোরদের উদ্দেশে যদি কিছু বলতেন।
সেলিনা হোসেনঃ জাতীয় শিশু দিবস আমরা পালন করি জাতির জনকের জন্মদিনে। যিনি একটি পাড়া গাঁ থেকে এসে জাতিকে আলোকিত করেছেন। ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। আমাদের তরুণরা যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে ভেতরে দেমপ্রেম লালন করতে শেখে, প্রত্যেকটি কাজের পেছনে যদি মানুষের মঙ্গল করার ইতিবাচক ইচ্ছে রাখে- তাহলে সে যেমন মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখবে তেমনি দেশ পাবে আদর্শ ও আলোকিত নাগরিক। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে সেটাই প্রত্যাশা।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য।
সেলিনা হোসেনঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।
/ এআর /