‘বঙ্গবন্ধু না জন্মালে বাঙালি স্বাধীনতা-ই পেত না’
প্রকাশিত : ০৫:৫৮ পিএম, ১৭ মার্চ ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৬:০০ পিএম, ১৭ মার্চ ২০১৮ শনিবার
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল প্রবক্তা। যখনই বাঙালিদের উপর কোনো আঘাত এসেছে তখনই রুখে দাঁড়িয়েছেন। রাজনৈতিক নেতা থেকে বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে জাতির জনক-তার পুরোটা জীবন কেটেছে বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে প্রতিষ্ঠা করবার লড়াইয়ে। তিনি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা এবং জাতীয়তাবাদের আলোয় উদ্ভাসিত একজন রাষ্ট্রনায়ক। তার জন্ম না হলে বাঙালি স্বাধীনতা-ই পেত না।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি-দর্শনের মূল্যায়নে এসব কথা বলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন ?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজঃ এই দাবিটি পুরোপুরি যৌক্তিক। বঙ্গবন্ধুর সব আন্দোলনের একটিই উদ্দেশ্য ছিল। আর তা হচ্ছে বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা। বাঙালি জাতির জাতিসত্ত্বার উপর যখনই আঘাত এসেছে তখনই বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদ মুখর হয়ে সেই আঘাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৭০ এর নির্বাচন- যখনই বাঙ্গালির অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সামনে এসেছে তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বজ্র কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে জয়লাভের পর যখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে তখন তিনি তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেও জাতীয়তাবাদকে খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি বলেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস, বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।’ অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলোকে উদ্ভাসিত। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হল। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলায়। রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশের মাটিতে আরও জোরালো ভাবে দিলেন জাতীয়তাবাদের ঘোষণা। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চরম মরণ সংগ্রামে। জাতীয়তাবাদ না হলে কোন জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। ... এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন, সবার সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে, সেটা হলো অনুভূতি। ... অনেক দেশ আছে একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সবকিছু, কিন্তু সেখানে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে, তারা একটি জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর। আজ বাঙ্গালি জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে; এই সংগ্রাম হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালি, আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদ।’
অতি সাধারণ ভাষায় তিনি জাতীয়তাবাদের যে গভীর ব্যাখা দিয়েছেন তা সত্যিই অনন্য। তিনি প্রথমেই বলেছেন, জাতীয়তাবাদ না হলে একটি জাতি এগোতে পারে না এবং জাতি হিসেবে আমাদের এগিয়ে যাবার মূলনীতি হবে জাতীয়তাবাদ । কাজেই আমরা দেখতে পাই রাজনৈতিক নেতা থেকে বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে জাতির জনক-তার পুরো জীবনই কেটেছে বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে প্রতিষ্ঠা করবার লড়াইয়ে। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা এবং জাতীয়তাবাদের আলোয় উদ্ভাসিত একজন রাষ্ট্রনায়ক।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। তার স্বপ্নে সেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র পরবর্তীতে কতোটা বাস্তবায়ন হয়েছে। আপনার মূল্যায়ন।
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজঃ দেখুন মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয়। একটি আইন করার আগে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে সমাজ সেই আইনের জন্য প্রস্তুত কিনা। নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধু ধর্ম নিরপেক্ষ ছিলেন এমনকি তিনি তার এক ভাষণে বলেছেন ‘সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না’। ১৯৭২’র সংবিধানে বঙ্গবন্ধু তার চিন্তার প্রতিফলন ঘটান। কিন্তু তার পরের ইতিহাস বাঙালি জাতির অন্ধকার যুগের ইতিহাস। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। অবৈধভাবে সামরিক জান্তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। সংবিধানে একের পর এক অবৈধ সংশোধনী আনা হয়। ১৯৭২’র সংবিধানকে ভূলুণ্ঠিত করে পাকিস্তানি চেতনার আলোকে একের পর এক সংশোধনী আনা হয়। পাকিস্তানি পরাজিত শক্তির দোসরদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা হয়। সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প রোপণ করা হয়। সমাজ এক ভুল ইতিহাস ও মূল্যবোধের চোরাবালিতে নিমজ্জিত হতে থাকে। ইতিহাসের বিশাল এক সময় ধরে চলে এই অধঃপতন। অবৈধ সামরিক সরকারের আমলে রোপিত সাম্প্রদায়িকতার বৃক্ষটি সমাজে ডাল-পালা ছড়িয়ে বটবৃক্ষে পরিণত হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
একটি সরকারের পক্ষে সাম্প্রদায়িকতাকে একা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন বা রাষ্ট্র ধর্মের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে সমাজকে সেই মোতাবেক তৈরি করতে হবে এবং সেই তৈরির দায়িত্ব কিন্তু সবার। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। সমাজকে তৈরি না করে যেকোনো আইন চাপিয়ে দিলে তা সমাজের জন্য বুমেরাং হয়ে যেতে পারে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনি একজন আইনজীবী। বর্তমানে প্রচলিত আইনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার বাস্তবায়ন কতটুকু ঘটেছে?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজঃ দেখুন আমাদের দেশের ইতিহাসে একটি লম্বা সময় ধরে পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন অবৈধ সামরিক শাসকেরা এবং তাদের সমর্থকেরা দেশ পরিচালনা করেছেন। তারা সে সময় তাদের পাকিস্তানি ভাবধারা অনুযায়ী বিভিন্নভাবে সংবিধানকে কাটাছেঁড়া ও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ এর মত কালা আইন ও করেছেন। যা ছিল বঙ্গবন্ধুর চিন্তার সঙ্গে পরিপূর্ণ সাংঘর্ষিক। পরে আমরা দেখেছি যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায় বসিয়ে এদেশকে পাকিস্তান বানানোর চক্রান্ত করা হয়েছে। তবে আশার বিষয় আওয়ামী লীগ সরকার এসব চক্রান্ত কারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। প্রথমবার ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ এর মত জঘন্য কালা আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছে। পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মত দুরুহ কাজটি সম্পন্ন করেছে। ধন্যবাদ দিতে হয় আমাদের উচ্চ আদালতকেও যেখান থেকে কিছু যুগান্তকারী রায় এসেছে এসব অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ও তাদেরকৃত সংশোধনের বিরুদ্ধে। সর্বোপরি আমি আশাবাদী যে আমরা শিগগিরই এমন একটি আইনি ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারবো যেখানে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন আমরা দেখবো।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ বঙ্গবন্ধুর দর্শন বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কতটুকু সফল মনে করেন?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজঃ বঙ্গবন্ধুর দর্শন বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শতভাগ সফল। তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়ন করে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে একটি বিষয় আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে বাংলাদেশ তার ইতিহাসে অবৈধ সামরিক শাসক ও পাকিস্তানিদের দোসর দ্বারা শাসিত হয়েছে। সেই সময়ে কিছু জঞ্জাল সমাজে জমেছে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই জঞ্জাল পরিষ্কার করে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন তা সত্যি অতুলনীয়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ জাতির জনককে নিয়ে এখনও যারা কটুক্তি করার দু:সাহস দেখায় কিংবা মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে তাদের বিষয়ে আইন কী বলে?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজঃ মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অস্বীকার করা মানে প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করা। মনে রাখতে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধু না জন্মালে বাঙালি জাতি কোনো দিন-ই স্বাধীনতা পেত না। আমরা যদি এবার আইনি দৃষ্টিকোন থেকে দেখি, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ষষ্ঠ এবং সপ্তম তফসিল স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্রের মূল পাঠকে সংবিধানের সঙ্গে সংযোজিত করেছে। কিন্তু যেটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই সেটা হল, ১৯৭২ সালের আদি সংবিধান থেকেই এই দুটি বিষয় আমাদের সংবিধানের অন্তর্গত করা হয়েছে। আমাদের সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্র দুটি আমাদের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃত। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলেও স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্র ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী হিসেবে চিহ্নিত করে সংবিধানের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। একইভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত রয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি। সুতরাং এই বিষয় নিয়ে বিতর্ক অর্থহীন ও অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।
/ এআর /