‘অনৈতিকতা চর্চার ভয়াবহ রূপ প্রশ্নফাঁস’
প্রকাশিত : ০৬:০৮ পিএম, ২৪ মার্চ ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৭:২৮ পিএম, ২৯ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার
অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম
পাবলিক পরীক্ষাসহ সরকারি চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস এখন নিয়মিত ঘটনা। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের বিস্তর অভিযোগ উঠে। পরীক্ষার আগের রাতে হয় পরীক্ষার আগের রাতে কিংবা পরীক্ষার দিন সকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে প্রশ্নপত্র পৌছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে। শিক্ষামন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ নিলেও প্রশ্নফাঁস রোধ করতে ব্যর্থ হয়। সমাজে অনৈতিকতা চর্চার ভয়াবহ রূপ হচ্ছে প্রশ্নফাঁস। প্রশ্নফাঁস বেশি ক্ষতি করছে মেধাবী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। অবিলম্বে এটি বন্ধ করতে না পারলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে, মেধাহীন হবে জাতি। এমনটাই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সম্প্রতি একুশে টিভি অনলাইনকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাতকার এসব কথা বলেন।
দেশবরেণ্য এ শিক্ষাবিদনের কথায় উঠে এসেছে কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের চাকরির সমস্যাসহ শিক্ষাব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি-গলদ। এছাড়া সাম্প্রতিক সময় চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা ও চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের সমালোচনা এবং এ থেকে বেরিয়ে আসার দিশাও খুঁজে পাওয়া যাবে তার সাক্ষাৎকারে। তিনি মনে করেন বিদ্যমান সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি পরীক্ষার্থী হিসাবে গড়ে উঠছে।
সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন একুশে টিভি অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান। এর চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো-
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : কী কারণে বারবার প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটছে, এটা থেকে উত্তরণের উপায় কি হতে পারে ?
ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: প্রশ্নফাঁস ঘটনার সঙ্গে আমাদের নৈতিক বিষয়টি জড়িত। সমাজে অনৈতিকতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এটাই তার প্রমাণ। এখন প্রশ্নফাঁস হলে আগে মা-বাবাও দৌড়ান ফাঁস হাওয়া প্রশ্ন যোগার করার জন্য। সন্তানও মা-বাবাকে দ্বিধাহীনভাবে বলছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যোগার করে দিতে। কারণ প্রশ্ন যোগার করতে না পারলে তার সন্তানও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। যে বাবা মা সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দিবে সে বাবা মা যদি সন্তানকে অনৈতিক সুবিধা দিতে কাজ করেন তাহলে আমাদের সমাজ নৈতিকতা শিখবে কিভাবে? এই যে চিত্রটা, এটা জাতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। প্রশ্ন ফাঁসের কারণে একদিকে যেমন দুর্বল মেধার শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে যোগ্য শিক্ষার্থী বঞ্চিত হচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত ফল ও চাকরি থেকে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মেধাবীরা কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়ায় তাদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। তাদের অনেকের নৈতিক স্খলন হয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এদের একটি বড় অংশ হতাশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে মাদকে। এই করুণ পরিণতি এখনি ঠেকাতে না পারলে ভয়াবহ সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
একুশে টিভি অনলাইন: প্রশ্নফাঁস রোধে কি কি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ড.সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: একে অন্যকে দোষারুপ না করে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে আসলে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে হবে। প্রশ্নফাঁসকারী যে হোক না কেন তার কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রশ্নফাঁসের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার গোটা সিস্টেমটাই দায়ী। শিক্ষার বাণিজ্য করণ রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রশ্নফাঁস রোধে গোটা পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে আসনে হবে। তাহলে এমনিতেই কমে আসবে প্রশ্নপত্র ফাঁস।
এখন আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই হয়ে গেছে পরীক্ষানির্ভর। এত পরীক্ষা হওয়া উচিত নয়। আমাদের সময় তো এত পরীক্ষা হতো না। তখনকার শিক্ষার্থীরা কি শেখেনি? আর স্কুলের ভিক্তিক পরীক্ষা নিতে হবে। তাহলে এক স্কুলের প্রশ্নের সঙ্গে অন্য স্কুলের মিল থাকবে। কারণে এক স্কুল যা পড়িয়েছে অন্য স্কুল তা নাও পড়াতে পারে।
একুশে টিভি অনলাইন: সৃজনশীল পদ্ধতিকে আপনি কিভাবে মূলায়ন করেন?
ড.সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের আরও বেশি পরীক্ষার্থী হিসাবে গড়ে উঠছে। এ পদ্ধতি আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী কেউ সৃজনশীল বোঝে না। তারা নোট-গাইডের আশ্রয় নেয়। শিক্ষার্থীরা গাইড পড়ে, কোচিংয়ে যায়। শিক্ষকরাও গাইড থেকে প্রশ্ন করে। এখন যারা সৃজনশীলই বোঝে না তারা তো প্রশ্ন ফাঁসের পেছনে দৌঁড়াবেই।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অনেকের অভিমত, শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে অনেকটাই সনদনির্ভর। দেশপ্রেম, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। এগুলোর চর্চার অভাবে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে অভিশাপে পরিণত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়?
ড.সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিবর্তন হচ্ছে। শিল্পায়ন, নগরায়ন, বস্তুতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা আমাদের একাকী করে দিচ্ছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাছে। সামাজিক বিকাশ ব্যহত হচ্ছে। যে কারণে দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে নানান অপরাধ। এ থেকে উত্তোরণের জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সমাজে প্রযুক্তির অপব্যবহারে সময় নষ্টকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ বিপদগামী হচ্ছে। পশ্চিমারা প্রযুক্তিকে এমনভাবে সাজিয়েছে যাতে তরুণ সমাজ শুধু নয় যেকোনো বয়সের ব্যক্তিও ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি দিনের পর দিনও তাতে আবদ্ধ থাকতে অতিক্রম করতে অনেকটা বাধ্য হচ্ছে।
বিশেষ করে গুগল ও ইউটিউবকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, তরুণরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অপব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। প্রযুক্তির অপব্যবহারের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তরুণরা। নষ্ট হচ্ছে তরুণদের নৈতিকতা। তাদের যে সময় ব্যয়ের কথা ছিল নিজেদের গোছানোর, সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিপাটি করতে, নিজেদের যোগ্য রূপে গড়ে তুলতে অথচ সে সময়টুকু যাচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহারে। সিনেমার কাহিনী,নাচ-গানে সাজ-সজ্জার দৃশ্য এমনভাবে নির্মিত হয়, তরুণসমাজ বাস্তবজীবনেও এর প্রয়োগ ঘটাতে আগ্রহ দেখায়। ফলে সমাজজীবন হচ্ছে ব্যাহত। বিয়ে-সংসার বেশিদিন টিকছে না। সামান্য অজুহাত, মান-অভিমানে একে অপরকে আলাদা করে দিচ্ছে। বাড়ছে সন্দেহপ্রবণতা, কমছে বিশ্বস্ততা।
বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। বিবাহরীতি ভেঙে বেড়েছে লিভ টুগেদার প্রথা। ভিনদেশি নাটক-সিরিয়াল দেখে নিজেদের চরিত্রে রূপ দিতে গিয়ে সংসারে নিয়ন্ত্রণ এমনভাবে হারিয়ে যায় সন্তানাদি শোনে না বাবা-মায়ের কথা। কেউ মানে না কারো নিয়ন্ত্রণ করে না। এজন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতার শিক্ষা রাখতে হবে। এবং সমাজে প্রত্যেক ক্ষেতে নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। তাহলে দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ তৈরি হবে।
একুশে টিভি অনলাইন: কীভাবে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার না করে নিরেট সেবায় রূপান্তর করা যায়?
ড.সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন অনেক ভাল মানের শিক্ষা নিশ্চিতে কাজ করছে। তবে কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অনেকেই আবার টাকার মাধ্যমে সনদ বাণিজ্য করছে। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে আমাদের নিজেদের মানসিকাতার পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষাকে সেবা হিসাবে নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।
একুশে টিভি অনলাইন: মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : একুশে পরিবারের প্রতিও শুভ কামনা।
‘‘অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক। ইংরেজির ছাত্র হয়েও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গদ্যশিল্পী, মননশীল লেখক হিসেবে পরিচিত তিনি। সৃষ্টিশীল জীবনে প্রায় ৮০টিরও বেশি গ্রন্থের স্রষ্টা। শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় থেকে অসংখ্য স্বপ্নবাজকে জন্ম দিয়েছেন সুন্দর পৃথিবীর বিনির্মাণে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর অগণিত শিষ্য। সফল ও সার্থক জীবনে শুধু সাহিত্য রচনা ও শিক্ষকতায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। জাতির ক্রান্তিলগ্নে কলমের খুরধারায় মোকাবেলা করেছেন সব অপশক্তিকে।
ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৫০ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগোরিস হাই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করে ভর্তি হন নটরডেম কলেজে। সেখান থেকে ইন্টারমিডিয়েটে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। ১৯৫৬ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
এরপর নিজ এলাকা মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। এসময় জগন্নাথ কলেজেও খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন এ শিক্ষাবিদ। পরের বছর ১৯৫৭ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের লিডস ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট এবং লেজিস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে তিনি মাসিক পরিক্রমা (১৯৬০-৬২), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা (১৯৭২), ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র (১৯৮৪) ইত্যাদি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন।’’
/ এআর /