ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে সিন্ডিকেট!

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ০৯:২৯ পিএম, ২৪ মার্চ ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৯:২৯ পিএম, ২৫ মার্চ ২০১৮ রবিবার

নিত্য পণ্যের মতো প্রতিনিয়ত বাড়ছে নির্মাণ সামগ্রীর দামও। খুচরা কিংবা পাইকারি অথবা উৎপাদন পর্যায়ে নানা অজুহাতে দাম বৃদ্ধি করছে। বাজার সংশ্লিটরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে চরম সংকটে পড়বে আবাসন খাত। দাম বৃদ্ধি নৈপথ্যে বিশেষ সিডিন্টেড কাজ করছে বলেও অভিযোগ করেন তারা। নিজেদের ইচ্ছা মতো ওই সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরে হঠাৎ করে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছেই চলেছে নির্মাণ সামগ্রীর দাম। নীতিনির্ধারকরা বাজার সহনীয় পর্যায়ে রাখতে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা বলেও বাস্তাবে এর প্রতিফলন হচ্ছেনা। মালিক পক্ষের ইচ্ছায় বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য নির্ধারণ হওয়ার কারণেই ঠকছে ভোক্তারা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গত এক মাসে বিভিন্ন কোম্পানির ৫০ কেজির বস্তা প্রতি দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা। ১ মাস  আগে বিভিন্ন কোম্পানির সিমেন্টের দাম বস্তা প্রতি বিক্রি হতো ৩৫০ থেকে ৩৯০ টাকা। বর্তমানে দাম বেড়ে তা বিক্রি হচ্ছে ৪৬০থেকে ৪৭০ টাকা দামে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি খুচরা সিমেন্ট ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ক্রাউন সিমেন্ট ৪৬০ টাকা, ফ্রেশ সিমেন্ট ৪৭০টাকা, রুবি সিমেন্ট ৪৬০ টাকা, আকিজ সিমেন্ট ৪৭৪ টাকা, শাহ সিমেন্ট (স্পেশাল) ৪৭০ টাকা, প্রিমিয়ার ৪৬০ থেকে ৪৭০ টাকা, হোলসিম ৪৬৫ টাকা, স্ক্যান ৪৭০ টাকা, সুপার ক্রিপ ৪৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহেও এসব সিমেন্টের প্রতি বস্তায় ৭০ থেকে ৮০ টাকা কমে বিক্রি করা হয়েছে।

এদিকে গত এক সপ্তাহ ব্যবধানে বিভিন্ন মানের রডে টন প্রতি দাম বাড়ছে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। বর্তমানে বাজারে বিএসআরএম স্টিল কোম্পানির  তৈরি ৬০ গ্রেডের রড বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ৭২ হাজার টাকা। একেএস স্টিলের ৬০ গ্রেডের রড বিক্রি হচ্ছে ৭১ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া রহিম স্টিলের ৬০ গ্রেড রডের বাজার মূল্য ৭০ হাজার টাকা। এছাড়া ৪০ গ্রেড রডের বাজার মূল্য ৫৩ থেকে ৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এব্যাপারে জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারে মাহবুব এন্টারপ্রাইজ সিমেন্ট বিক্রেতা আতিক একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, গত এক মাস ব্যবধানে প্রতি বস্তা সিমেন্ট ১০০ থেকে ১২০ টাকা বাড়ছে। তিনি জানান, মালিক পক্ষরা মিলে বড় একটি সিন্ডিটেক তৈরি করছে। তারা সব সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এদের কারণে বিভিন্ন সময় নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক ভাবে বাড়ে। দাম বৃদ্ধির কারণে গত এক মাসে বেচাকেন অনেকটাই কমে এসেছে। তিনি বলেন, দাম কমতে সরকার যদি উদ্যোগ গ্রহণ না করে তাহলে আবাসন ক্ষেতে বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে।

দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে কারওয়ান বাজার রডব্যবসায়ী কাজিন এন্টারপ্রইজ মালিক মামুন আহমেদ একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, আমরা বিভিন্ন রড কোম্পানি থেকে রড কিনে নিয়ে আসি। দাম বৃদ্ধির সঠিক কারণ আমরা জানতে পারি না। রড মালিকরা এবিষয় ভালো বলতে পারবেন। তবে দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আল আমিন একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, “হঠ্যাৎ করে অস্বাভাবিক হারে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার থেকে কোনো ধরনের কর আরোপ হয়নি, বাড়েনি কাচঁমালের দামও। তবুও রড, সিমেন্ট, ইট, ছাড়াও গত ছয় মাসে পাথরসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে। আমরা মনে করি এই মূল্য বৃদ্ধিতে নির্মাণকাজ গতিহীন হয়ে পড়বে। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে অনেকেই সাময়িকভাবে কাজ বন্ধ রেখেছে। ফলে সঠিক সময় ফ্ল্যাট হস্তান্তর অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।

নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, “উৎপাদন পর্যায়ে প্রতি বস্তায় (৫০কেজি) কাঁচামালের খরচ বেড়েছে ৮০ টাকা পর্যন্ত। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন হিসেবে- ক্লিংকার ৪০ ডলার থেকে বেড়ে ৬৩ ডলার, স্লাইড ১৮ ডলার থেকে বেড়ে ৩০ ডলার হয়েছে, ২৪ ডলারের জিপসাম ৩২ ডলার, ফ্লাই অ্যাশ ২১ ডলার এখন ২৯ ডলার, লাইমস্টোন ১৮ ডলার তা এখন ২৮ ডলার, ডলার মূল্য ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৮৪ বা ৮৫ টাকা হয়েছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কন্সস্ট্রাকশন ইন্ড্রাস্টিজের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মুনীর উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, “বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজরেও কাঁচা মালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্বেও অতিরিক্ত মুনাফা লোভে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নির্মাণ সামগ্রির দাম বাড়াচ্ছে উৎপাদকরা। তিনি আরও বলেন, নির্মাণ সামগ্রীর দাম এভবে ক্রমাগত বাড়তে থাকলে উন্নয়ন কাজের গতি কমে যাওয়ার আশঙ্কার কথাও বলেন নির্মাণ শিল্পের এই ব্যবসায়ী নেতা।”

এদিকে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট, টাইলস, পাথরসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কিত আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, দাম বৃদ্ধির কারণে সংকটে পড়বে আবাসন খাত। তাছাড়া গৃহ ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের দাম ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়বে এমন শঙ্কা করছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব। আবাসন ব্যবসায়ীরা জানান, নির্মাণসামগ্রীর ক্রমবর্ধমান দামের কারণে মারাত্মক হুমকিতে আবাসন খাত। শ্রমিকদের মজুরি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিল্প খাতে। এতে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত আবাসন খাতের উন্নয়ন। এদিকে দেশের জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সেদিকে খেয়াল রেখে ব্যবসায়ীরা আবাসন খাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। অর্থ বিনিয়োগ করেও ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারছেন না তারা। ফলে না পারবেন ব্যবসা চালাতে, না পারবেন বন্ধ করতে।

টিকে