ঢাকা, শনিবার   ০২ নভেম্বর ২০২৪,   কার্তিক ১৮ ১৪৩১

গণহত্যা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বাণী

প্রকাশিত : ১২:৪৯ পিএম, ২৫ মার্চ ২০১৮ রবিবার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে বাণী প্রদান করেন। তা তুলে ধরা হলো-
‘‘১৯৪৭ সালের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে। অর্থনৈতিক শোষণ ছাড়াও তারা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়। পাকিস্তানিদের এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রুখে দাঁড়ান। তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম। বাঙালিদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার এবং নির্যাতন। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬-দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০’র সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ের পথ ধরে বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম যৌক্তিক পরিণতির দিকে ধাবিত হয়।

আগরতলা মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু বাঙালিরা দমবার পাত্র নন। তাঁরা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনেন। আইয়ুব খানের পতন হয়। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেয়।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ইয়াহিয়া খান আর জুলফিকার আলী ভুট্টো মিলে ষড়যন্ত্র শুরু করে বাঙালিদের ক্ষমতা হস্তান্তর না করার। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা স্বাধীনতার ডাক দিয়ে তিনি ঘোষণা করেন, ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’’। ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। পাকিস্তান থেকে সৈন্য নিয়ে আসে পূর্ব বাংলায়। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট-এর আদেশ দিয়ে গোপনে পাকিস্তানে চলে যায় ইয়াহিয়া খান।

২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহর ও বন্দরে হত্যা করা হয় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। সেই রাত থেকে পরবর্তী নয় মাস পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর-রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর সদস্যরা-সারাদেশে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায়। হত্যা করে প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে। এত কম সময় ও স্বল্প পরিসরে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যার নজির বিশ্বে আর নেই। শুধু মানুষ হত্যা নয়, একইসঙ্গে ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করা হয়। লাখ লাখ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট করা হয়। বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করা হয় প্রায় এক কোটি মানুষকে।

গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তৎকালীন ইপিআর ওয়ারলেসসহ, টেলিপ্রিন্টার-টেলিগ্রাফের মাধ্যমে এ ঘোষণা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।
পাকিস্তানি বাহিনী এবং তার দোসরদের সেই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ শুরুর দিন ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের ২০ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে। এর আগে একই বছরের ১১ মার্চ মহান জাতীয় সংসদে এদিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা বিশ্বের জঘন্যতম গণহত্যাগুলোর অন্যতম। বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য প্রতিবেদন, দূতাবাসগুলোর বার্তা এবং পরবর্তীকালে দেশি-বিদেশি লেখক-ইতিহাসবিদদের রচনায় গণহত্যার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

১৯৭১ সালের ১৩ জুন সানডে টাইমস পত্রিকায় অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ‘জেনোসাইড’ শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে সময় ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আর্চার ব্লাড। তিনি যেসব টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে সেখানে বাংলাদেশের ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বা ‘নির্বাচিত গণহত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। হোয়াইট হাউসে প্রেরিত বার্তার উপর ভিত্তি করে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাপক গ্যারি বাস-এর গ্রন্থেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সংঘটিত ঘটনাকে জেনোসাইড বা গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। গিনিস বুক অভ্ রেকর্ড-এ বাংলাদেশের ১৯৭১ এর হত্যাযজ্ঞকে বিংশ শতাব্দীর ৫টি গণহত্যার মধ্যে অন্যতম গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ প্রণয়ন করেছিলেন। সেই আইনের আওতায় অনেকের বিচার সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দেয় এবং বিচার কাজ বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অংশীদার করে। খালেদা জিয়াও স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে গণহত্যার দোসর নিজামী-মুজাহিদদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়। এখনও তাদের সাথে নিয়ে রাজনীতি করছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য পরিচালনা করছি, বিচারের রায় কার্যকর করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত থাকবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের ব্যাপারে আমরা সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।

গণহত্যা দিবসে আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতাকে। শ্রদ্ধা জানাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ নির্যাতিতা মা-বোনকে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। আমি সব শহীদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।

২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন প্রকৃতার্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতির প্রতি জাতির চিরন্তন শ্রদ্ধার স্মারক এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
আমি গণহত্যা দিবস উপলক্ষে গৃহীত সব কর্মসূচির সাফল্য কামনা করছি।

এসএইচ/