পশ্চিমবঙ্গে রামনবমীর উৎসবে সংঘর্ষ, নিহত ৩
প্রকাশিত : ১০:২০ পিএম, ২৭ মার্চ ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ১০:৫৭ পিএম, ২৭ মার্চ ২০১৮ মঙ্গলবার
পশ্চিমবঙ্গে রামনবমীর উতসব উদযাপনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত রবিবার থেকে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় হওয়া এ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ৩ জনের মৃতের সংবাদ নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বার্তা সংস্থা বিবিসি বলছে, রামনবমীর উৎসবকে কেন্দ্র করে বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগ যেমন হয়েছে, তেমনই ভাঙ্গা হয়েছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদের মূর্তি।
বিজেপি ও তাদের সহযোগী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো অস্ত্র হাতে মিছিল করেছে। আর ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস এবারে পাল্টা রামনবমী পালন করতে দেখিয়েছে নিজেদের ‘শো-ডাউন’।
রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ এক পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিমের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় রূপ নেয়। পশ্চিম বর্ধমানের রাণীগঞ্জ শহরে হিন্দু আর মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে রামনবমী পালনকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবারের সংঘর্ষের পরে এখনও সেখানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পুরো শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেছে পুলিশ। তবে তাতে উত্তেজনা প্রশমিত হয়নি এখনও। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ বাহিনীসহ বিপুল সংখ্যক পুলিশ সড়কে টহল দিচ্ছে।
প্রসঙ্গত, রবিবার থেকে রামনবমী পালন করা নিয়ে রাণীগঞ্জ ছাড়াও পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর চব্বিশ পরগণাতেও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়েছে। রাজ্য জুড়েই বিজেপি ও তাদের সহযোগী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো তলোয়ার, ত্রিশূল, কাটারির মতো চিরাচরিত অস্ত্র নিয়ে মিছিল করেছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, এই উগ্র অস্ত্র প্রদর্শন করে রামচন্দ্রের জন্মতিথি রামনবমী পালনের চল পশ্চিমবঙ্গে একেবারেই নতুন। রামনবমী আগেও পালিত হত, তবে তা থেকেছে মূলত পারিবারিক স্তরে।
পুরাণ বিশারদ নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী বিবিসি বাংলাকে তাদের বাড়িতে রামনবমীর উদযাপনের চলমান রীতির বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “দুর্গা পুজো বা কালীপূজোর মতো রামনবমী কোনও কালেই বারোয়ারি উৎসব ছিল না পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু তা বলে কি এখানে রামনবমী পালন করা হত না? আমাদের বৈষ্ণব বাড়ি। ছোট থেকেই দেখেছি সারাদিন উপবাসের পরে সন্ধ্যায় রামকথা পাঠ হত, কীর্তন হত। এটাই প্রচলিত প্রথা ছিল। কিন্তু এই দুবছর ধরে রামচন্দ্রে যে রুদ্ররূপ সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে, অস্ত্র নিয়ে আস্ফালন কোনও রামায়ণেই বর্ণিত নেই। রামের এই চেহারা একেবারে অপরিচিত," বিজেপি আর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর এই অস্ত্র প্রদর্শন করে রামনবমী পালনের পিছনে যে রাজনীতি রয়েছে, তা স্পষ্ট বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের ভিত শক্ত করতে আর মাস কয়েক পরের পঞ্চায়েত ভোটে হিন্দু ভোট একজোট করার লক্ষ্যেই এই রাজনীতি করছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো - এমনটাই মত তাঁদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিষ মৈত্র বলেন, "একটা স্পষ্ট ডিজাইন দেখা যাচ্ছে, যেটা উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগেও হয়েছিল। নির্বাচনের মূল ইস্যুগুলোকে পেছনে ঠেলে দিয়ে ধর্মকে সামনে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা - যা দিয়ে মানুষকে মাতিয়ে দেওয়া সহজ। সমস্যাটা হচ্ছে বেশীরভাগ মানুষেরই তো রামায়ণ পড়া নেই, তাই তাদের যা বোঝানো হচ্ছে, তাই বুঝছে তারা।"
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে উদ্ধৃত করে মি. মৈত্র আরও বলেন, "উনি একটা যথার্থ কথা বলেছেন। রামচন্দ্র বা তাঁর ভক্তরা কি পকেটে পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়াত। অথচ এখন তো দেখা যাচ্ছে যে রামভক্তদের হাতে তলোয়ার, পকেটে কারও পিস্তল, আবার তারা বোমাও ছুঁড়ছে।"
নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী বলছিলেন, "নাবালকদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে যা করা হচ্ছে, তা তো একেবারে জঙ্গীপনা!"
গত বছর শুধু হিন্দুবাদী সংগঠনগুলোই রামনবমীর দিনে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করেছিল। কিন্তু এবারে তাদের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসও সব এলাকায় রামনবমীর পাল্টা মিছিল করেছে - যদিও তাদের হাতে অস্ত্র ছিল না।
কলকাতার চারুচন্দ্র কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ জানান, "সর্বভারতীয় স্তরে রামের নামে যে ভোট হয়, রাম যে ভোট টানতে সক্ষম, সেটা আগেই দেখা গেছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও এখন রাম নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু হয়েছে। এতদিন শুধু বিজেপি এটা করত, এখন তো দেখছি তৃণমূল কংগ্রেসও সেই পথেই পা বাড়ালো। হয়তো তারা ভাবছে যে রাম নিয়ে রাজনীতির ময়দানটা শুধু বিজেপি কে ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না।"
রামনবমীর দিনে অস্ত্র প্রদর্শন নিয়ে অধ্যাপক নন্দ বলেন, "এটা কনসেপ্ট অফ ডিফায়েন্স - যা বহুকাল ধরেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো করে আসছে। সরকারী নির্দেশ অমান্য করার মনোভাব।"
তৃণমূল কংগ্রেস কেন হিন্দুত্ববাদীদের টেক্কা দিতে গিয়ে রামনবমী পালন করতে গেল, তা নিয়ে সমালোচনাও শুরু হয়েছে। বিশিষ্ট কবি শঙ্খ ঘোষ থেকে শুরু করে নানা বুদ্ধিজীবী আর বামপন্থী দলগুলো বলছে ক্ষমতাসীন দলের এই রাজনীতিতে নামাটা অনুচিত হয়েছে।
অন্যদিকে পুলিশ কেন অস্ত্র নিয়ে মিছিলের করতে দিল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াতে পারে এমন পূর্ব অনুমান থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় কড়া সমালোচনার মুখে পরেছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ।
/এস এইচ এস//টিকে