নিভে যাচ্ছে সম্ভাবনার সব টুকুন আলো
কাজী ইফতেখারুল আলম তারেক
প্রকাশিত : ১১:৪৭ পিএম, ২৭ মার্চ ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ১২:১৪ এএম, ২৯ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার
ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে এখন শুধুই কান্নার আওয়াজ! আইসিইউর সামনে স্বজনদের নিদারুণ অপেক্ষা। ভেজা চোখে বিমূর্ত হয়ে বসে আছেন অনেকগুলো মানুষ। যাদের জীবনে নেমে এসেছে কঠিন বিপর্যয়। তারা কেউই জানেন না তাদের ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে?
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) বস্ত্র প্রকৌশল বিভাগের তিন ছাত্র ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে আইসিইউতে রয়েছেন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
তাদের পোড়া শরীরের মতই পুড়ে গেছে হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের স্বপ্নগুলো। সন্তানের সঙ্গে কাটানো দিন গুলোর কথা স্মরণ করে অপেক্ষার প্রহর গুণছেন স্বজন আর সহপাঠীরা। ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছে তাদের মা, ভাই-বোন সহপাঠী আর শিক্ষকরা।
শনিবার (২৪ মার্চ) রাতে ময়মনসিংহের ভালুকায় স্কয়ার ফ্যাশন কারখানার পাশে মাস্টার বাড়ি এলাকার একটি ফ্ল্যাটের নিচ তলায় গ্যাস বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই মারা যান তৌহিদুল ইসলাম। এই ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পরে ওই রাতেই তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।
বার্ন ইউনিটে আইসিইউতে পাশাপাশি শুয়ে আছেন তিনবন্ধু। নওগাঁর হাফিজুর রহমান (২৩), সিরাজগঞ্জের শাহীন মিয়া (২৩) ও মাগুরার দীপ্ত সরকার (২২)। তিনজনেরই জীবনও সংকটাপন্ন।
এই তিনজনই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সম্ভাবনার আলো। তাদের প্রতিভার আলোয় উদ্ভাসিত হতে যাচ্ছিল পরিবার, সমাজ ও দেশ। ঠিক তার আগেই তাদের স্বপ্ন পুড়ে গেছে আগুনের লেলিহান শিখায়। এই দগ্ধ শরীর নিয়ে বার্ন ইউনিটের বিছানায় তাদের নিস্তব্ধতা যেন ভারী করে রেখেছে পুরো চারপাশ।
নওগাঁর বিল্লাল হোসেনের ছোট ছেলে হাফিজুর রহমান। আর কিছু দিন পরই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হবার কথা। তার আগেই ঘটে গেল এমন দূর্ঘটনা। হাফিজের বড় ভাই রবিউল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে গেলে অঝোরে কেঁদে বুক ভাসালেন তিন।
রবিউল ইসলাম তার ভাই সম্পর্কে বলেন, হাফিজুরের মতো মেধাবী ছাত্র তাদের বংশে কেউ নেই। তারা সবাই আশায় ছিলেন, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে পরিবারটির দুঃখ দুর্দশা দূর করবেন হাফিজুর।
ছেলেকে দিয়ে দু`চোখভরা স্বপ্ন ছিল শাহীন মিয়ার মা সাফিয়া বেগমের। তাকে মুঠোফোনে বলেছিল আর কয়টা দিন মাত্র। পড়ালেখা শেষ করেই তার কাছে ফিরে আসবে। চাকুরি করে সংসার চালাবে সে। বিধবা মাকে এমন স্বপ্নই দেখিয়েছিলেন অগ্নিদগ্ধ শাহিন মিয়া।
ছেলের এমন অবস্থা দেখে মোছাম্মৎ সাফিয়া বেগম কেঁদে কেঁদে বলেন, ``শাহীন বাবা ফিরে আই, আগের মত। তোকে এইভাবে দেখতে ইচ্ছে করে না। তুই কথা বল। আমি তোর কাছে কিছুই চাই না। তুই ফিরে আই মার বুকে....
তিনি বলেন, আমার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে শাহীন মেজ। তার বাবা মারা গেছেন তিন বছর আগে। অনেক অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে তাকে পড়ালেখা করিয়েছি। তার দিকে তাকিয়ে ছিল পরিবার ও এলাকাবাসি। আমাকে বলেছিল, পড়ালেখা শেষ হতে আর দেড় মাস বাকি। এরপরে চাকুরি নিয়েই বাড়ি আসবো মা... ``
মাগুরার দীপ্ত সরকারের ভাই নারায়ণ বলেন, ‘আমার ভাই আমাদের এলাকার গর্ব। তাকে এই অবস্থায় দেখব তা কখনো কল্পনা করিনি। তার দুর্ঘটনার কথা শুনে পরিবার পরিজনরা ভেঙ্গে পরেছে।
কর্মজীবনে প্রবেশ করে পরিবারের হাল ধরবে এমন আশায় সবাই স্বপ্ন বুনেছিল। কিন্তু আগুনে নিভতে বসেছে মেধাবী তিন শিক্ষার্থীর জীবনের সম্ভাবনার সবটুকুন আলো। আগুনের লেলিহান শিখায় কেড়ে নিয়েছে তাদের আরেক সহপাঠী বন্ধু তৌহিদুল ইসলামের জীবন প্রদীপ।
শিক্ষাজীবনের শেষের দিকে এসে কুয়েটের এই চার মেধাবী ছাত্র ময়মনসিংহের ভালুকার স্কয়ার ফ্যাশন কারখানায় শিক্ষানবিশ (ইন্টার্ন) প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ওই পোশাক কারখানার পাশে মাস্টারবাড়ি এলাকার একটি ভবনের তিনতলায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতেন তারা।
ঘটনার পর পুলিশ জানিয়েছে, বাড়ির মালিক অবৈধভাবে বাসায় গ্যাস-সংযোগ নিয়েছিলেন। সেই সংযোগের ফুটো থেকে গ্যাস ছড়িয়ে ওই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ভবনের মালিকের অবহেলার কারণে (দণ্ডবিধির ৩০৪-ক ধারা) মোতাবেক এই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে ভালুকা থানার পুলিশ।
পরিবারগুলো নিজেদের সোনার ছেলেদের বেঁচে ওঠার প্রতীক্ষায় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। তাদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন হতাহত শিক্ষার্থীদের সহপাঠী ও শিক্ষকেরা। তাদের ওষুধ ও অন্যান্য খরচের ক্ষেত্রেও তারা এগিয়ে এসেছেন। হতাহত শিক্ষার্থীদের সহপাঠী ও শিক্ষকেরা জানালেন, ফলাফলের দিক থেকে ভালুকায় হতাহত চার শিক্ষার্থী প্রথম ১০ জনের মধ্যে।
আইসিইউর কনসালট্যান্ট চিকিৎসক মৌমিতা তালুকদার জানান,অগ্নিদগ্ধ তিনজন শিক্ষার্থীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তিনজনেরই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। শাহীন মিয়ার শরীরের ৮৩ শতাংশ হাফিজুর রহমানের ৫৮ শতাংশ আর দীপ্ত সরকারের ৫৪ শতাংশ পুড়ে গেছে। এদের তিনজনকেই কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস দেওয়া হচ্ছে।
এই তিন শিক্ষার্থী বার্ন ইউনিটের রেড ইউনিটের প্রধান অধ্যাপিকা ডাঃ রায়হানা আওয়াল সুমির তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
কুয়েটের প্রফেসর আবদুল জলিল বলেন, মেধাবি এই তিন শিক্ষার্থীর চিকিৎসার খরচ বহন করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওদের বাঁচাতে দেশবাসিকে এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি। এই দুর্ঘটনার সুষ্ঠু কারণ জানতে ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামীকাল তারা ঘটনাস্থলে পৌছাবেন।
হতাহত শিক্ষার্থীদের সহপাঠী তুষার মাহমুদ জানান, প্রতিদিন সত্তর থেকে আশি হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। যা জোগান দেওয়া তাদের পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। আমার বন্ধুদের বাঁচাতে দেশের সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি।
এই বিস্ফোরণের ঘটনায় ভালুকা থানার উপপরিদর্শক কাজল হোসেন বাদী হয়ে ‘আর এস টাওয়ার’ নামের ভবনটির মালিক আবদুর রাজ্জাক ঢালীকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন। মামলায় বাড়ির মালিকের অবহেলা, ভুল নকশায় ভবন নির্মাণ, অবৈধ গ্যাসলাইন সংযোগের কারণে এই বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
হতাহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসায় সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসুন-
ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেড
খুলনা শাখা, ব্যাংক হিসাবের নাম- খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হিসাব নং- ১২০.১১০.২৬৪৩৭
জানতা ব্যাংক লিমিটেড
কুয়েট কর্পোরেট শাখা, হিসাবের নাম- জরুরি সাহায্য তহবিল, হিসাব নং- ০১০০০১৯২৮৬৩৮৪
কেআই/এসি