সূর্যোদয়ের দেশে
মফিজুর রহমান
প্রকাশিত : ১১:০৬ পিএম, ২৮ মার্চ ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ০৩:১৪ পিএম, ৪ এপ্রিল ২০১৮ বুধবার
পূর্বদিকে সূর্য ওঠে- এ কথাটি দ্রুব সত্য। কিন্তু বিশ্বের কোন দেশে প্রথম সূর্য ওঠে সে কথাটি আমাদের অনেকের কাছেই এখনো অজানা। তিন দশক আগে এ বিষয়টি আমার কাছেও ছিল অজানা। আমরা ছোটবেলা থেকেই একথা জেনে এসেছি যে, সূর্যোদয়ের দেশ হচ্ছে জাপান। অপরদিকে জাপান ভূমিকম্পের দেশ হিসেবেও সবার কাছে পরিচিত। তবে আমার এ লেখার বিষয়টি ‘সূর্যোদয়ের দেশ’ নিয়েই। আমাদের অনেকের মনেই এখনো এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, বিশ্বে জাপানেই সকালে প্রথম সূর্য ওঠে। হ্যাঁ, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত জাপানেও প্রতিদিন সকালে পূর্বদিকেই সূর্য ওঠে। তবে বিশ্বে জাপানই যে প্রথম সূর্যোদয়ের দেশ নয়–সে কথাও দ্রুব সত্য। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে জাপানই যে সূর্যোদয়ের দেশ-এ কথাটি তাহলে এলো কোত্থেকে। ছোটবেলা পাঠ্যপুস্তকে পড়ে আমার মনেও এ বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল যে, জাপানই বিশ্বে প্রথম সূর্যোদয়ের দেশ। আর তখন থেকেই স্বপ্নের সূর্যোদয়ের এ দেশটি দেখা ও তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ জন্মে আমার মনে। আর এ স্বপ্নও আমার একদিন পূরণ হয় জাপান সফরের মধ্য দিয়ে।
বিশ্বে প্রথম সূর্যোদয়ের দেশ জাপান- আমার এ ধারণা পাল্টে যায় এখন থেকে তেত্রিশ বছর আগে। নিপ্পন কেনসিকাই (Nippon Kenseikai) নামের একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে জাপান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বৃত্তি পেয়ে তখন জাপান সফরের সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। এ সফরের আগে থেকেই আমার ভেতরে একটা উত্তেজনা কাজ করছিল। আমার সফরের মুল কর্মসূচির বাইরে আমি কি করবো, কি দেখবো এবং কি জানবো সে সম্পর্কেও আমি অলিখিত কিছু কর্মসূচীও ঠিক করলাম। যদিও আমার ব্যক্তিগত কর্মসূচির একটি বাদে সবগুলোই পূরণ হয়েছিল। উপরন্তু আমি অতিরিক্ত আরও অনেক কিছু দেখতে পেরেছি এবং উপভোগ করতে পেরেছি। সূর্যোদয়ের এ ধারণা হয়তো আমার আজীবনই থেকে যেতো যদি আমার জাপান যাওয়ার সুযোগ না হতো। জাপান যাওয়ার আগে আমার মনে যে উত্তেজনা কাজ করে তা হচ্ছে- প্রথমত: আমি আমার ছোটবেলা পাঠ্যপুস্তকে পড়া স্বপ্নের সূর্যোদয়ের দেশ জাপান যাচ্ছি। দ্বিতীয়তঃ আমি তখন একজন পেশাদার তরুণ সাংবাদিক হিসেবে সে দেশের প্রচার সংখ্যায় শীর্ষ পত্রিকার অফিস পরিদর্শনসহ পত্রিকা প্রকাশনার সার্বিক কার্যক্রম সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করবো। তৃতীয়তঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর নিক্ষিপ্ত আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি নগরী দুটো পরিদর্শনসহ সেদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করবো। আর সূর্যোদয় সম্পর্কে সার্বিকভাবে অবগত হওয়ার বিষয়টি তো ছিলই। আমার জাপান সফরের সময় শুধু দেখা হয়নি আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত হিরোশিমা ও নাগাসাকি নগরী দুটোকে। কেননা এ দুটি নগরীই ছিল আমার জাপান সফরের মূল কর্মসূচী বহির্ভূত।
অবশেষে সব প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে ১৯৮৪ সালের ২০জুন জাপানের রাজধানী টোকিওর নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে আমার ছয় মাসের জাপান সফরের কর্মসূচী শুরু হয়। ওই দিন নারিতা বিমানবন্দরে আমাকে স্বাগত জানানোর জন্য আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষমান ছিলেন নিপ্পন কেনসিকাই প্রতিনিধি ইয়ামাগুচি ও তার এক বান্ধবী। ওই তরুণ এর আগে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। যে কারণে জাপান পৌঁছে বিমানবন্দরে নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে আমাকে কোন অসুবিধায় পড়তে হয় নি। জাপান সফরের প্রথম দুই সপ্তাহ আমাকে রাখা হয় টোকিওর অশোকসাবাসি (Asakusabasi) এলাকার চারতারা হোটেল বেলমনটে (Belmonte) । ওই হোটেলেই প্রতিদিন আমার জন্য জাপানি ভাষায় দৈনন্দিন ব্যবহার্য বিষয়ের ওপর প্রাথমিক ধারণা দেওয়া ও পরে তা কার্যক্ষেত্রে সরেজমিনে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়। এই কাজে সহায়তা করতেন জাপান সরকারের মনোনীত এক তরুণী (নাম মনে নেই)। জাপানি ভাষাভাষী আমার প্রশিক্ষক যোগাযোগের জন্য ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতেন। বলে রাখা ভাল, সত্তরের দশকের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যয়নকালে বার বার পরীক্ষা পেছানোর প্রেক্ষাপটে আমি জাপানি ভাষার ওপর ডিপ্লোমা নেওয়ার উদ্দেশ্যে ভর্তি হয়ে ক্লাসও করি অনেকদিন। পরে সাংবাদিকতা বিভাগের পরীক্ষা এসে যাওয়ায় জাপানি ভাষার কোর্সটি আর শেষ করা যায়নি। তবুও জাপানি ভাষা ব্যবহারের ওপর আমার মনে ইতোমধ্যেই প্রাথমিক কিছুটা ধারণাও সৃষ্টি হয়। যা আমার জাপান সফরের শুরুতে প্রাপ্ত প্রশিক্ষণে অনেক সহায়ক হয়েছিল।
টোকিও পোঁছানোর পর থেকেই জাপানে সূর্যোদয়ের বিষয়টি জানার জন্য আমি আমার উত্তেজনা যেন আর কিছুতেই চেপে রাখতে পারছিলাম না। আমার প্রশিক্ষক ওই তরুণীকে একদিন খুব বিনয়ের সাথেই জিজ্ঞাসা করলাম সূর্যোদয়ের বিষয়টি। তরুণী আমার প্রশ্নের পর আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। তিনি বুঝতে পারলেন জাপানে সূর্যোদয় সংক্রান্ত আমার অজ্ঞতার বিষয়টি। তিনি হেসেই বললেন, হ্যাঁ জাপানেই প্রথম সূর্য ওঠে।তবে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। আর সে সূর্যোদয় প্রাকৃতিক সূর্যোদয় নয়। সে সূর্যোদয় হচ্ছে (Symbolic) প্রতীকী। ওই সময় তিনি তার হাতে থাকা ডায়েরিটা খুলে ধরলেন আমার সামনে। তিনি ডায়েরির পাতায় তর্জনী রেখে বললেন, এটি জাপানের জাতীয় পতাকার ছবি। আমি জাপানের পতাকার ছবিটি দেখে রীতিমত বিস্মিত হলাম। কেননা এর আগে জাপানের জাতীয় পতাকার ব্যাপারে তেমন কোনো ধারনাই আমার ছিলনা। প্রশিক্ষককে আমি আমার সদ্য শেখা জাপানি ভাষায়ই তখন বললাম, ‘দাই তাই ওনাজি’। যার বাংলায় অর্থ হচ্ছে, প্রায় একই রকম। অর্থাৎ জাপান ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দেখতে প্রায় একই রকম। তবে পার্থক্য শুধু জাপানের পতাকায় সাদার মাঝে লাল সূর্য। আর বাংলাদেশের পতাকায় সবুজের মাঝে লাল সূর্য। জাপানে প্রথম সূর্যোদয়ের বিষয়টি যে প্রতীকী তা আমার কাছে তখনো অস্পষ্ট মনে হলেও ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হতে থাকে।
১৯৪৫ সালের আগস্টে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি নগরীতে দুটি আণবিক বোমা ফেলে। ৬ আগস্ট লিটল বয় (Little Boy) নামের প্রথম আণবিক বোমাটি ফেলে হিরোশিমা এবং ৯ আগস্ট ফ্যাট ম্যান (Fat Man) নামের দ্বিতীয় বোমাটি ফেলে নাগাসাকি নগরীতে। ওই বোমার তেজস্ক্রিয়তার ফলে দুটি নগরীতে যে বিরূপ প্রভাব পড়ে তা ছিল সারা বিশ্বে মানব সভ্যতার জন্য বিরল এক ঘটনা। আজও বিধ্বস্ত নগরী দুটোতে জন্ম নিচ্ছে বিকলঙ্গ শিশু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে সেই কবে। বাহাত্তর বছরেও সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। আণবিক বোমার বিভীষিকা এখনো তাড়িয়ে বেরাচ্ছে জাপানে আলচিত নগরী দুটোর মানুষকে। স্বভাবতই বিশ্বের কোনো দেশ বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার হলে পাল্টা আক্রমনের মাধ্যমে তার প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু না, জাপান তা করেনি। যুদ্ধ শেষে জাপান সারা বিশ্বে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ‘ফ্লাওয়ার মুভমেন্ট’ নামে শান্তির আন্দোলন শুরু করে। জাপানের পূর্ব দিগন্তে উদয় হয় উন্নয়নের সূর্য। যে আন্দলনের ফলে আধুনিক জাপান আজ সারা বিশ্বে এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী উন্নত দেশের মডেলে পরিণত হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সরকারি পর্যায়ে নেওয়া দেশের উন্নয়ন কর্মসূচিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে দেশটির সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে এবং সরকারের সকল উন্নয়ন কর্মসূচী সফল করে তোলে এবং এখনো সফল করে চলছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সরেজমিনে পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতি বছর ২০(বিশ) হাজার তরুণ-তরুণী, যুবক–যুবতিকে সরকারি খরচে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হচ্ছে। পাশাপাশি অন্য দেশ থেকেও তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতিকে জাপানের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও সামাজিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য সে দেশে দীর্ঘ সময় অবস্থানের অনুমতি দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে প্রতি বছর। আমন্ত্রিতদের রাখা হয় দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে হোমস্টেতে। এমনি এক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্যই আমি বৃত্তি পেয়ে জাপান যাই। ওই কর্মসূচিতে অংশ নেয় বাংলাদেশ ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরও কয়েকটি দেশের যুবক-যুবতি প্রতিনিধিরা। এদের মধ্যে একমাত্র আমিই পেশায় সাংবাদিক হওয়ায় আমাকে আমার কাঙ্ক্ষিত স্থান এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিদর্শনের সুযোগ করে দেওয়া হয়। এমনি করে আমি অনেক অজানার অনেক কিছুই জানতে পেরেছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপানের ‘ফ্লাওয়ার মুভমেন্ট’ বা শান্তির আন্দোলনের কর্মসূচিকেই জাপান নতুন সূর্যোদয় হিসেবে আক্ষায়িত করে এবং দেশটিকে সারা বিশ্বে সূর্যোদয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় বছরখানেক আগে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে লেখক সূর্যোদয়ের দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার নাম উল্লেখ করেছেন। এ তথ্য অনুযায়ী প্রাকৃতিক নিয়মে প্রকৃত সূর্যোদয়ের দেশ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। আর উন্নয়নের মডেলের প্রতীকী সূর্যোদয়ের দেশ হচ্ছে জাপান।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক