ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

উপদেশ নয়, শিশু চায় দৃষ্টান্ত

আবুল মোমেন

প্রকাশিত : ১১:৪৭ পিএম, ২৯ মার্চ ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৫:১৮ পিএম, ৩০ মার্চ ২০১৮ শুক্রবার

আমাদের দেশে শিশুরা আজ সবচেয়ে বঞ্চিত। সেটা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে। বঞ্চিত এই অর্থে যে, আমরা ধরেই নিয়েছি ভালো জামা-কাপড়, ভালো খাবার এগুলোই হচ্ছে শিশুর চাহিদা। এর বাইরে আমরা বেশি কিছু ভাবি না। কিন্তু বাইরে হয়তো রোদ উঠেছে, শিশুর ইচ্ছে করবে মাঠে গিয়ে দৌড়াতে, গাছে উঠতে। তার লাফ দিতে ইচ্ছা হয়, পুকুরে সাঁতার কাটার ইচ্ছা হয়। শৈশবে এমন ক্ষুধার কোনো শেষ নেই। তার যেমন আছে চিংড়ি মাছ খাওয়ার ক্ষুধা, তেমনি রয়েছে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা। বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করার ইচ্ছা তার আরো বেশি। কিন্তু সেগুলো অতৃপ্ত থেকে যাচ্ছে। আমরা সাধারণভাবে যে ধরনের ঘরবাড়িতে থাকছি, এই ফ্ল্যাটবাড়িগুলো হচ্ছে খাঁচার মতো। দরজাটা লাগিয়ে দিলে পুরো দুনিয়া থেকে আপনি বিচ্ছিন্ন, সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। এটা শিশুর মনে বন্দিত্বের বিরাট একটা চাপ সৃষ্টি করে।

আমি সৌভাগ্যবান যে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে এমএ ক্লাস পর্যন্ত পড়িয়েছি। একবার ক্লাস ফোরের বাচ্চাদের সাথে আমরা একটা মুক্ত আলোচনা করলাম যে, মানুষ আসলে ইনডোর প্রাণী না আউটডোর প্রাণী। সেখানে অনেক তর্ক-বিতর্ক করল শিশুরা। তারপর তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, মানুষ আসলে আউটডোর প্রাণী। ভুল করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এটা অনেক আগে বলেছিলেন যে, শিশুকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে ছেড়ে দিতে হবে।

এমনভাবে ছাড়া উচিত যাতে তার গায়ে ধুলোবালি লাগে, বৃষ্টি জলে সে যেন একটু ভেজে। শিশু আলাদা থাকতে চায় না। সে চায় মানুষের সংস্পর্শ। আপনি যদি তাকে সবার থেকে আলাদা করে রাখেন যে সাফ-সুতরা থাকবে, পরিষ্কার থাকবে তাহলে শিশুর যে স্বাভাবিক প্রবণতা আছে, এটা থেকে সে বঞ্চিত থাকবে। বন্ধুদের সাথে সে গলাগলি করবে, ঝুলাঝুলি করবে, ধাক্কাধাক্কি করবে, ফুটবল খেলবে। এ স্বাধীনতাটুকু তাকে দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিশুর তিন ধরনের বিকাশ প্রয়োজন হয়। একটা হচ্ছে শারীরিক, একটা মানসিক, আরেকটা হচ্ছে আবেগিক বিকাশ। শরীরেরটা আমরা দেখতে পাই যে খাওয়াদাওয়া করছে, আকারেও বাড়ছে। আবার শিশুকে মানসিকভাবে সমৃদ্ধ করতে গিয়ে আমরা মনে করেছি যে, লেখাপড়া করলেই সব হয়ে যাবে। ফলে এখন আরেকটি জিনিসের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। তা হলো, অনেক অনেক পরীক্ষা। এখন আর কেউ শিক্ষার্থী নেই, সকলেই পরীক্ষার্থী। আমি মনে করি, এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খুব ক্ষতি হচ্ছে। কারণ প্রাথমিক থেকে অষ্টম-নবম শ্রেণি পর্যন্ত জীবনটা হচ্ছে সংগ্রহ ও সঞ্চয় করার সময়। সে চতুর্দিক থেকে সংগ্রহ করবে। তার কাছে তো আমি তখন ফল চাইতে পারি না। অথচ এখন অভিভাবকরা ক্লাস ওয়ান থেকেই সন্তানকে জিপিএ ফাইভের জন্যে তৈরি করছেন। এর ফলটা দাঁড়িয়েছে স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টারের মূল্য বেড়ে গেছে। পাঠ্যবইয়ের চেয়ে এখন দাম বেশি গাইড বইয়ের। শিক্ষকের চেয়ে হাউজ টিউটরের দাম বেশি। শিক্ষার চেয়ে বেশি দাম পরীক্ষার। উল্টো যাত্রা হয়ে গেল সব। আপনি যখন জীবনে প্রবেশ করবেন, তখন কি কেউ জানতে চাইবে আপনি গণিতে কত নম্বর পেয়েছেন? ইংরেজিতে কত নম্বর পেয়েছেন? এটা তো কেউ জিজ্ঞেস করে না।

জীবনের আসল চাহিদা হচ্ছে আপনার বিবেচনা বোধ কেমন আপনি কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? আপনার মাঝে বিচক্ষণতা, সেবাপরায়ণতা, মানবিকতা, বন্ধুপ্রীতি আছে কিনা। জীবনে চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন কিনা। আপনি কঠিন সময়ে ভেঙে পড়েন, নাকি দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন? জীবন আপনাকে এসব চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে আর স্কুল বলছে, শুধু পরীক্ষায় পাশ করো। লেখাপড়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর সাথে সাথে মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো আরো গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের নিয়ে কাজের ৪১ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সরাসরি উপদেশ দিলে শিশু কখনো কিছু শেখে না। শিশু সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে উপদেশ, শিশু চায় দৃষ্টান্ত। সে কোনোকিছু সরাসরি শিখে না। সবকিছু দেখে দেখে শেখে। সে খুব ভালো অনুকরণ করতে পারে। শিশু যে-রকম বড়দের জুতা পরে, শাড়ি পরে, স্বভাবটাও সে বড়দের কাছ থেকে আয়ত্ত করে।

মা-বাবা ঝগড়া করবেন আর আশা করবেন সন্তান শান্তশিষ্ট হবে, খুব যৌক্তিক আচরণ করবে, এটা হবে না। এমন দৃষ্টান্ত দিতে হবে তার সামনে, যেন সে বুঝতে পারে কোনটা সত্য, কোনটা বেশি গ্রহণযোগ্য। এখন মুশকিল হয়েছে, সন্তানদের দেওয়ার মতো সময় আমাদের নেই। ইংরেজিতে আমরা বলি ‘কোয়ালিটি টাইম’। আপনি যখন ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরছেন, তখন সে কিছু একটা বললে আপনি বিরক্ত হচ্ছেন। বলছেন, চুপ করো। সন্তান কাছে এলেই তাকে থামিয়ে দিচ্ছেন, তার সাথে বসাটা মুলতবি করছেন।

আমি শুধু অভিভাবকদের বলব শিশুর জন্যে আপনার সময়টা বাড়ান। ওদের পাঁচ রকম পাখি দেখান, গাছ দেখান, ফুল চেনান। এটিই শিক্ষা। একবার পড়ালেখা শিখলে বই সে একাই পড়তে পারবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বয়স উপযোগী অন্যান্য শিক্ষাটা ওর হচ্ছে কিনা। তাকে লার্নিং অব লাইফ দিতে হবে। এ শিক্ষা আমাদের দেশে স্কুল-কলেজ দেয় না, তাই এ কাজ করতে হবে বাবা-মা-অভিভাবকদেরকেই।

আপনিও যদি জিপিএ ফাইভের ফাঁদে পড়ে যান, তাহলে আপনার সন্তান সামগ্রিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত হবে। তার হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেধার বিকাশ হলো, অঙ্কে-ইংরেজিতে সে দুর্দান্ত নম্বর পেল কিন্তু তার মানবিক বোধগুলো বিকশিত হবে না। তখনই দেখা যায়, সে নানারকম ভুলভ্রান্তি করে। কারণ তার মূল্যবোধের জায়গাটা তো ফাঁকা!

আমি অনেকদিন থেকে এ কথাটাই বলছি একটা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যারা সত্য-মিথ্যার প্রভেদ বুঝতে পারে না। সত্য যদি ১০০ হয়, মিথ্যা তো শূন্য। অথচ সে ভাবে, মিথ্যা ৮০। মিথ্যা দিয়েও সত্যের কাছাকাছি যাওয়া যাবে। এ বিষয়টাই সবচেয়ে ভয়ংকর। এভাবে সমাজ বেশি দূর যেতে পারবে না। সমাজের এই যে সংকট, এটা কিন্তু ছোট ছোট জায়গা থেকেই মেরামত হতে হবে। অর্থাৎ আপনি আপনার পরিবারের মধ্যে যদি সত্য আর মূল্যবোধের চর্চাটা শুরু করেন, তাহলে সেটা একসময় চারপাশকে প্রভাবিত করবে।

আমি হতাশ হই না। কারণ সততা, কল্যাণ বা যা-কিছু ভালো, সেটার জোর এত বেশি যে, কোনো ব্যাধি বা অকল্যাণ এর সামনে টিকতে পারবে না। তবে এর জন্যে ভালো বিষয়গুলো নিয়মিত চর্চার মধ্যে আনতে হবে। একবার যদি এটা চর্চার আওতায় আনা যায় যে, বাড়িতে আমরা কিছুতেই কপটতা করব না, তাহলে শিশু সেভাবেই বেড়ে উঠবে। চারপাশে বিভ্রান্তির ধূম্রজাল আমাদের নিজেদেরই পরিষ্কার করতে হবে। সবাইকে সত্যের ওপর দাঁড়াতে হবে, দাঁড়াতে হবে ইতিহাসের সঠিক রাস্তায়। আর এভাবেই শিশুর সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে একটা স্পষ্ট, সৎ ও অকপট সম্পর্ক।

লেখক: বিশিষ্ট কবি, লেখক ও কলামিস্ট

এমএইচ/টিকে