ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

ভয়ঙ্কর ফাঁদ রাতের মাইক্রোবাস

প্রকাশিত : ০৬:১১ পিএম, ৩০ মার্চ ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:৫৬ এএম, ৪ এপ্রিল ২০১৮ বুধবার

মনির হোসেন পেশায় একজন গণমাধ্যম কর্মী। রাজধানীর উত্তরার ১৩ নং সেক্টরের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি। প্রিন্ট মিডিয়ায় কাজ করার কারণে তেঁজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে অফিস শেষ করে বাসায় ফিরতে প্রায় প্রতিদিনই রাত হয়ে যায় তার। মাসে দু’ একদিন অফিস থেকে বেরিয়েই উত্তরায় যাওয়ার গাড়ী পেলেও প্রায় দিনই গাড়ীর জন্য রাস্তায় দাড়িয়ে বেগ পেতে হয় তাকে। কোন কোন দিন টাঙ্গাইলগামী অনেক গাড়ীতে চড়েও উত্তরায় যেতে হয় তাকে। এভাবে গণপরিবহন না পেয়ে প্রায়ই উত্তরবঙ্গগামী বিভিন্ন গাড়ীতে চড়ে রাতে বাসায় যেতে হয় তাকে। এভাবে চলতে চলতে গণপরিবহনের ওপর এক প্রকার বিশ্বাস চলে এসেছে তার। প্রায় দিনই বিভিন্ন গাড়ীতে চড়ে বাসায় যেতে যেতে এক প্রকার সাহস হয়েছে তার। 

এভাবেই একদিন রাতে অফিস থেকে বেতন নিয়ে বাসায় যাওয়ার সময় কোন গণপরিবহন না পেয়ে প্রায় ঘন্টা খানিক দাড়িয়ে থাকতে থাকতে অতিষ্ট হয়ে ওঠেন তিনি। সেই মূহুর্তে কালো গ্লাসযুক্ত মাইক্রোবাস এসে তার সামনে দাড়ালে একটি কিশোরের ডাকে উত্তরায় যাওয়ার জন্য তিনি চড়ে বসেন গাড়িটিতে। তার আগে একই স্থান থেকে অন্য দুই যাত্রীও চড়েন একই গাড়ীতে। তাদের তিন জন ছাড়াও গাড়ীটিতে আগে থেকেই অবস্থান করছিল আরো চার যাত্রী। কিছু দূর যেতেই তার পাশে বসা ব্যক্তিটি ব্যাগ থেকে হালকা নাস্তা বের করে খাচ্ছিলেন। পাশের অন্যদেরও ঐ খাবার খাওয়ার জন্য অনুরোধ করে ব্যক্তিটি। ভদ্রতার খাতিরে অন্য যাত্রীদের মতো মনে সন্দেহ নিয়ে মনিরও ঐ খাবার হাতে নেয়। সকলকে ঐ খাবার খেতে দেখে তার সন্দেহ কেটে যায়। সেই খাবার খাওয়ার পর তিনি ঘুম থেকে উঠে দেখেন খিলক্ষেত রাস্তার পাশে পরে রয়েছেন তিনি। তার কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, পকেটে থাকা মোবাইল এবং মানিব্যাগ কোনটাই নেই। তখন তার মনে পড়ে ঘন্টা খানিক আগের স্মৃতি। তখন বুঝতে পারেন তিনি আসলে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়েছিলেন। 

ঘটনাটির সপ্তাহ খানেক পর রাজধানীর মিরপুর পাইকপাড়া নিবাসী তৈরী পোষাক শিল্প ব্যবসায়ী পঙ্কজ কুমার পাল গুলিস্থান এলাকা থেকে পোষাক শিল্পে ব্যবহৃত বেশ কিছু প্রয়োজনীয় মালামাল কিনতে দেরী হওয়ায় গাড়ী না পেয়ে দ্রুত বাসায় আসার জন্য প্রায় দ্বিগুন ভাড়া দিয়ে মাইক্রোবাসে চড়ে বসেন তিনি। খানিকটা যেতে না যেতেই গাড়ীর মধ্যে থাকা এক ব্যক্তি হাতে কিছু একটা মেখে পেছন থেকে তার দু’চোখে লাগিয়ে দিলে প্রচন্ড জ্বালা-যন্ত্রনায় গাড়ীর মধ্যে ছটফট করতে থাকেন তিনি। এমতাবস্থায় তার পকেটে থাকা মানিব্যাগ থেকে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এটিএম কার্ড নিয়ে পঙ্কজের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে এটিএম কার্ডের পাসওয়ার্ড নিয়ে নেয় তারা। পরবর্তীতে তাকে চোখ বেঁধে দুই দিন অজ্ঞাত স্থানে রেখে তিন দিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পেয়ে তিন দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকেন তিনি। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সরাসরি ডাচ বাংলা ব্যাংকের একটি শাখায় কার্ড হারানোর অভিযোগ দিতে গিয়ে দেখেন অ্যাকাউন্টে কোন টাকাই নেই। 

এছাড়াও গত কয়েকদিন আগে গাজীপুর জেলার টঙ্গী এলাকার মামুন নামে এক পোষাক শ্রমিক কোম্পানী থেকে বেতন নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে গাবতলী যাওয়ার পথে আশুলিয়া ধউর বেরিবাঁধ এলাকায় যাওয়া মাত্রই রাত নয় টার দিকে তাকে দেশীয় অস্ত্র ঠেঁকিয়ে সবর্স্ব নিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। সবর্স্ব নেয়ার পর তাকে উর্পযুপরি কুপিয়ে আহত করে ফেলে রাখে বেড়িবাঁধের রাস্তার পাশেই। প্রায় দুই সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে সুস্থ হন তিনি।   

এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে রাতের শহরে। শুধু ঢাকা নয়, দেশের প্রধান শহরগুলোর রাতের রাজপথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর চক্র। যারা রাতের গাড়ি পার্টি নামে পরিচিত। সংশ্লিষ্টরা বলছে, রাজধানীতে কর্মব্যস্ত মানুষের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর অন্যতম সমস্যা হলো যানবাহনের স্বল্পতা। আর এই সমস্যাকে কাজে লাগিয়ে নগরীতে ছিনতাইয়ের ফাঁদ পাতছে বেশ কিছু সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। মাইক্রোবাসে যাত্রী পরিবহনের নামে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে এই ছিনতাইকারী চক্র। একটু আরামে ও দ্রুত অফিস বা গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়ায় অনেকটা অসাবধানতার কারণে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছেন যাত্রীরা।

তবে পুলিশ বলছে আগের তুলনায় এ ধরনের ছিনতাইয়ের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। নগরীর বিভিন্ন সড়কের মোড়ে অফিসের শুরুতে বা শেষে হাজারো মানুষকে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। পাবলিক পরিবহনের আশায় অপেক্ষা করতে হয় তাদের। গন্তব্যে পৌঁছাতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগায় ছিনতাইকারীরা। অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সামনে মাইক্রোবাস নিয়ে ডাকাডাকি শুরু করে তারা। মাইক্রোবাসে লোক তোলা হয় টার্গেট করে। নির্ধারিত ব্যক্তি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যায় মাইক্রোবাস। ছেড়ে যায় গন্তব্যের পথে। মাঝ পথে গিয়ে টের পাওয়া যায়, টার্গেট ব্যক্তি ছাড়া বাকি সবার ভয়ঙ্কর রূপ বেরিয়ে আসে।

প্রথমেই টার্গেট ব্যক্তিকে দুই পাশ থেকে দুজন শক্ত করে ধরে বসে। পেছন থেকে বা পাশ থেকে আরেকজন মুখ চেপে ধরে। কাউকে মারধর, কারও চোখে বিষাক্ত মলম ও মরিচের গুঁড়া জাতীয় পাউডার মেখে দেয়। এতে টার্গেট ব্যক্তির চোখে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, অনেকটা বেহুশ হওয়ার মতো অবস্থা। একই সঙ্গে চলে শারীরিক নির্যাতন। ছোট ছোট রড জাতীয় বস্তু বা হাতুড়ি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড়ে ও জয়েন্টে আঘাত করা হয়। এরপর কেড়ে নেওয়া হয় সঙ্গে থাকা মোবাইল, মানিব্যাগ, ল্যাপটপ সবকিছু। এ ছাড়া সঙ্গে থাকলে এটিএম কার্ড ও মোবাইল ব্যাংক থেকে টাকাও তুলে নেয় সংঘবদ্ধ চক্র। এরপর সুযোগ বোঝে মাইক্রোবাস থেকে ভুক্তভোগীকে নামিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। রাজধানীর বনানী, মহাখালী, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, মতিঝিল, নিউমার্কেট এলাকায় বেশ কয়েকটি ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। এরা ছিনতাইয়ের কাজে বেশিরভাগ সময় কালো কাচের মাইক্রোবাস ব্যবহার করে। যাতে গাড়ির ভিতরে কী হচ্ছে বাইরে থেকে দেখা না যায়। পথচারীরা এ ধরনের ঘটনার শিকার হলেও ঝামেলা এড়াতে থানায় কোনো মামলা করা হয় না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা এ ধরনের ছিনতাইকারী চক্রকে গ্রেফতারের অভিযান অব্যাহত রেখেছি। ইতিমধ্যে কিছু গ্রেফতারও হয়েছে। এখন অনেকটাই কমে গেছে পুলিশের টহলের কারণে।

যাত্রীদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এসব ছিনতাই ঠেকাতে সবার আগে যাত্রীদের সচেতন হতে হবে। যে কোনো অপরিচিত মাইক্রোবাসে ওঠা যাবে না। কষ্ট হলেও পাবলিক পরিবহন যাতায়াতের জন্য সবচেয়ে বেশি নিরাপদ।

 আরএ/এসি