ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

২৪১ বছর সাজা হয়েছিল যে কিশোরের!

প্রকাশিত : ০৭:৩০ পিএম, ৩১ মার্চ ২০১৮ শনিবার

প্রতিদিন ভোর পৌনে পাঁচটায় ঘুম থেকে জেগে ওঠে বব্বি বসটিক। সাড়ে পাঁচটায় নাস্তা। এরপর কিছু সময় টিভি দেখেন। বেশিরভাগ সময়ই সিএনএন। তারপর দিনের প্রার্থনা করেন। দিনের বাকি সময় ঘোরাফেরা করেন। রাত ১০টায় ঘুমাতে যান। গত ২০ বছর যাবত বব্বির দৈনন্দিন রুটিন এটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরীর একটি জেলখানায় এভাবে দিন কাটছে বব্বি বসটিকের। এভাবে তাকে কাটাতে হবে আরও ২২১ বছর। যদি এর আগে মরে না যান।

১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরের এক মঙ্গলবার দিনটা অমঙ্গল হয়ে যায় বব্বি আর তার বন্ধু ডোনাল্ড হাটসনের জন্য। নেশার ঘোরে আর ঝোকের বসে করে ফেলা কিছু অপরাধের জন্য ২৪১ বছর সাজা হয় বব্বি বসটিকের।

সেদিন যা হয়েছিল
ছোটবেলা থেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পরেন বব্বি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই ধূম আর মদ পান স্বাভাবিক বিষয় হয়ে ওঠে বসটিকের জন্য। ১২ বছর বয়সেই স্বাদ পেয়ে যান ক্যান্নাবিস মাদকের। মাদকের পয়সা জোগানের জন্য ছোটখাট চুরি করতেন বব্বি।

সেই বব্বির হাতেই একদিন ১৯৯৫ সালের ওই দিনে খুন হন এক যুবক। বব্বিদের এলাকায় দুস্থদের মাঝে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী বিতরণ করতে আসা একদল যুবক-যুবতীদের ওপর হামলা করে বসটিক এবং হাটসন। ৫০০ ডলার ছিনতাই করতে গিয়ে মেরেই ফেলেন প্রথম যুবকটিকে। এরপর ছিনতাই করেন ওই যুবকের সঙ্গে থাকা অন্য আরেকটি মেয়েকে। গুলি করে বসেন ওই মেয়ের সঙ্গে থাকা বন্ধুকেও। অবশ্য গুলিটি তাকে আঘাত করেনি।

সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে এক নারীর থেকে ছিনতাই করেন তার গাড়িটি। ছিনতাই এর আগে যৌন হয়রানিও করেন তারা। এর প্রায় এক ঘণ্টা পর যখন পুলিশের হাতে ধরা পরেন বব্বি তখন তার বয়স মাত্র ১৬ বছর।

১৬ বছর বয়সেই ১৭টি ফৌজধারী ধারা মাথায় নিয়ে আদালতে বিচারের শরণাপন্ন হন তিনি। নাবালক হিসেবে মুক্তি পেয়ে যেতে পারেন এই আশায় সাজা কম হওয়ার দুইটি সুযোগ হাতছাড়া করেন। আর তাই বব্বির সাজা হয় ২৪১ বছর আর তার সহযোগী হাটসনের সাজা হলো ৩০ বছর।

যেভাবে ২৪১ বছর সাজা হলো-
১৯৯৭ সালে উপরোক্ত ঘটনাগুলোর বিষয়ে দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণা করেন মিসৌরীর আদালতের বিচারক এভেলিন বেকার। ১৭টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে বব্বির বিরুদ্ধে সাজার রায় ঘোষণা করেন তিনি।

রায়ের বিস্তারিত বিবরণে বলা হয়, একটি অপরাধের সাজা শেষ হলে তবেই আরেকটি অপরাধের সাজা শুরু হবে বব্বির। অর্থ্যাৎ ১৭টি অভিযোগের প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা করে কারাভোগ করতে হবে বব্বিকে। আর এতেই বব্বির মোট সাজার পরিমাণ গিয়ে ঠেকে ২৪১ বছর কারাবাসে।

অনুতপ্ত অপরাধী ও বিচারক
ঘটনার দুই দশকেরও বেশি সময় পরে এসে অনুতপ্ত অপরাধী ও বিচারক দুই জনেই।

নিজের অপরাধের স্বপক্ষে কোন যুক্তি না দিয়ে বব্বি বসটিক বলেন, আমি যা করেছি তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। শুধু এটুকু বলি, আমি তখন ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলাম না। নেশার ঘোরে ছিলাম। অপরাধ করে ফেলেছি বুঝে ওঠার পর থেকে প্রতি মুহুর্তেই আমার খারাপ লেগেছে।

নিজেকে বলছিলাম আমি তো এতটা খারাপ না। আমি বুঝতে পারি যে, আমি যা করেছি তা করা উচিৎ হয়নি। আমি আমার কাজের জন্য অনুতপ্ত-নিউইয়র্ক টাইমস, সেন্ট লুইস পোস্ট-ডিসপ্যাচ এবং এন্টারপ্রেনার ম্যাগাজিনকে বলছিলেন বব্বি।

জেলখানায় থেকে একটি কোর্স করছেন বব্বি। যেখানে কয়েদিদের সেখানো হয় যে, তাদের অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা কতটা কষ্টের মধ্যে দিয়ে যান। এই কোর্সের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বব্বি বলেন, আমি যখন অপরাধ করেছিলাম তখন আমি বুঝতেই পারিনি যে, আমার অপরাধের শিকার কারা অথবা তারা কী-ই বা করেছিল। কিন্তু এই কোর্সের কারণে আমি এখন বুঝতে পারি যে, আমি কতটা গুরুতর অপরাধ করেছি।

এদিকে বব্বির সাজা ঘোষণা নিয়ে অনুতপ্ত বিচারক এভেলিন বেকার। ১০ বছর আগে ২৫ বছরের বিচারিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানা বেকার বলেন, আমার ক্যারিয়ারে এটাই একটা কেস যেটার সাজার মেয়াদ নিয়ে আমি আফসোস করি। অনুতপ্ত বোধ করি। বব্বিকে একজন পূর্ণবয়স্ক অপরাধীর মতই বিবেচনা করেছিলাম। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা মাত্র ১৬ বছরের একটি কিশোর এমন অপরাধ করে ফেললেও তার শুধরানোর সুযোগ থাকতে পারে। বব্বির সহযোগী হাটসনকে যে ৩০ বছর সাজা দিয়েছিলাম; একই সাজা বব্বিকেও দেওয়া যেত।

দ্বিতীয় সুযোগ
বব্বিকে একটি দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া যায় কী না তা নিয়েই এখন ভাবা হচ্ছে। প্যারোলে তাকে জামিন দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া চলছে যুক্তরাষ্ট্রে।

এদিকে নিজের করা অপরাধের শিকার ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে ‘ক্ষমা’ চেয়ে চিঠি লিখছে বব্বি। গত ১০ বছর যাবত নির্যাতিত ব্যক্তি অথবা তাদের স্বজনদের এমন চিঠি লিখে যাচ্ছে বব্বি। তবে এখন পর্যন্ত কোন চিঠির উত্তর পায়নি তিনি।
কারও দয়া-মায়া নয় বরং একটি ‘দ্বিতীয় সুযোগে’র জন্য সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে আসছে বব্বি। তিনি বলেন, তারা তাদের অবস্থান থেকেই বিচার করবেন। তারা যদি মনে করে যে, অবুঝ অবস্থায় আমার করা ভয়ানক অপরাধের জন্য আমাকে এখানেই (জেলখানায়) মরে যেতে হবে, তাহলে তারা এভাবেই বিচার করক। আমি শুধু এটুকুই বলব যে, ১৬ বছরের যে কিশোর ওই অপরাধগুলো করেছিল আমি আর তা নেই। আমি আমার কাজের স্বপক্ষে যুক্তি দিচ্ছি না। তবে আমার শিশু অবস্থায় করা অপরাধের শাস্তি আমার শিশুকাল পেয়েছে। কিন্তু এখন একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ হিসেবে তাকে সেই শাস্তি দেওয়াটা ঠিক হবে না যা সে করেনি। যদি তারা আমার এ কথা না শুনে থাকেন তাহলে আমি আবারও তাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। তারা জানুক যে আমি অনুতপ্ত।

বব্বির ভাগ্যে কী ঘটবে তা আগামী এপ্রিল মাসে ঠিক করবে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত। তবে বব্বির পক্ষেই রায় আসবে বলে ভাবছেন দেশটির আইনজ্ঞরা।

২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত গ্রাহাম বনাম ফ্লোরিডা রাজ্যের একটি মামলায় রায় দেয় যে, বব্বির মতো যেসব নাবালক ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেনি, তাদেরকে প্যারোলের জামিন সুবিধা ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া উচিৎ হবে না।

২০১২ এবং ২০১৬ সালের আরও দুইটি মামলায় এই শর্তকে আরও শিথিল করা হয়েছে।

কোর্টগুলোর এমন রায়ের ফলে প্রায় দুই হাজার ৬০০ নাবালক যাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল তাদের সংখ্যা এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ইতোমধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে ২৫০ জন কয়েদিকে। নির্দিষ্ট কিছু সময় কারাভোগের পর মুক্তির অপেক্ষায় আছেন আরও অনেকেই।

তথ্যসূত্র: বিবিসি।

/এসএইচএস// এসএইচ/