ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

প্রশ্নফাঁস রোধে নানা উদ্যোগ, তবুও শঙ্কা

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ০৮:০১ পিএম, ১ এপ্রিল ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ১০:১৬ এএম, ৩ এপ্রিল ২০১৮ মঙ্গলবার

গত নিম্ন মাধ্যমিক (এসএসসি) পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে প্রশ্নফাঁস নিয়ে তীব্র সমালোচনার মূখে পড়তে হয় শিক্ষামন্ত্রণালয় ও সরকারকে। ফলে এবার উচ্চ মাধ্যমিকে (এইচএসসি) প্রশ্নফাঁস রোধে আগেভাগেই বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে শিক্ষামন্ত্রণালয়। তবে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নেওয়া এসব পদক্ষেপ প্রশ্নফাঁস রোধে যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন শিক্ষাবিদেরা। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মনেও কাজ করছে এক ধরনের শঙ্কা।

শিক্ষাবিদেরা বলছেন, প্রশ্নফাঁসকারীদের চিহ্নিত এবং তাদের কঠোর শাস্তি ব্যবস্থা  না করতে পারলে মন্ত্রণালয়ের এমন পদক্ষেপ কাজে আসবে না। আগেরবার প্রশ্নফাঁস চক্র চিহ্নিত করতে না পারায় এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে ইচ্ছুক ১৩ লাখ ১১ হাজার ৪৫৭ জন পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকের মনে একধরনের উৎকণ্ঠা কাজ করছে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, এর আগেও পরীক্ষা শুরুর ৩০মিনিট আগে প্রশ্নের সিলগালা খোলার নিয়ম ছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই স্বীকার করেছেন, নানাবিধ কারণে এর আগেই প্রশ্ন খুলতে হয়। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগে প্রশ্ন খুললে সেটা দেখভাল করার মতো লোকবলও সেখানে উপস্থিত রাখা সব সময় সম্ভব হয় না। আবার যে সময় কেন্দ্রে প্রশ্ন পৌঁছানোর কথা, রাস্তাঘাটের দুরাবস্থার কথা মাথায় রেখে এর আগেই সেখানে প্রশ্ন পাঠাতে হয়। অন্যদিকে সেট একাধিক হলে যেসব সেটেরই প্রশ্নফাঁস হয়ে যাবে না, এরও নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে আগামী এইচএসসি পরীক্ষায় শতাধিক কেন্দ্র কমিয়ে আনার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এটিও প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে তেমন কোনো কাজে আসবে বলে মনে করেন না শিক্ষাবিদরা। তাদের ভাষ্য, ট্রেজারি থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রশ্নপত্র নিয়ে যেতে কঠোর নিরাপত্তার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু অতীতেও একই ধরনের নিরাপত্তা দিয়ে প্রশ্ন স্থানান্তরিত হলেও প্রশ্নফাঁস ঠেকানো সম্ভব হয়নি।

এছাড়া পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে সব শিক্ষার্থীর কেন্দ্রে প্রবেশের কথা বলা হলেও মানবিক কারণে সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরে যানজটের কারণে এ বিষয়ে ছাড় দিতে হয়েছে। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে দূরদূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কারণে দেরি হতে পারে বলেই মনে করেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।

সরকারের এসব উদ্যোগের বিপরীতে যেসব সংঘবদ্ধ চক্র প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাদের শনাক্ত করার ওপরই বেশি জোর দিচ্ছেন অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা। নিরাপত্তা বিশ্নেষকরাও মনে করেন, অপরাধের মূলে আঘাত না করে কোনোভাবেই অপরাধ বন্ধ করা যায় না।

ফলে প্রশ্নফাঁস সম্পূর্ণভাবে ঠেকাতে হলে সরাসরি প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে।কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের হাত থেকে প্রশ্নফাঁস হওয়ার অভিযোগের চেয়ে প্রশ্নছাপা, পরিবহন ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের মাধ্যমে সে কাজ হয়েছে বলে অভিযোগের পক্ষে বেশি প্রমাণ রয়েছে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক প্রস্তুতির পাশাপাশি প্রশ্ন প্রণয়ন, ছাপা, পরিবহন এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের ওপর কঠোর নজরদারি ছাড়া প্রশ্নফাঁস ঠেকানো যাবে না বলে অভিমত তাদের।

এছাড়া প্রশ্নফাঁসের পর যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে, সেটা সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা হচ্ছে। কয়েক দিন আগেও কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপে থেকে আগামী এইচএসসি পরীক্ষায় প্রকাশ্যে প্রশ্নফাঁসের হুমকি দিয়ে রেখেছে সাইবার অপরাধীরা।

এব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, পরীক্ষার আগের রাতে হয় পরীক্ষার আগের রাতে কিংবা পরীক্ষার দিন সকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে প্রশ্নপত্র পৌছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে। শিক্ষামন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ নিলেও প্রশ্নফাঁস রোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।তিনি মনে করেন, সমাজে অনৈতিকতা চর্চার ভয়াবহ রূপ হচ্ছে প্রশ্নফাঁস। প্রশ্নফাঁস বেশি ক্ষতি করছে মেধাবী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। অবিলম্বে এটি বন্ধ করতে না পারলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে, মেধাহীন হবে জাতি। তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁস ঘটনার সঙ্গে আমাদের নৈতিক বিষয়টি জড়িত। সমাজে অনৈতিকতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এটাই তার প্রমাণ। এখন প্রশ্নফাঁস হলে আগে মা-বাবাও দৌড়ান ফাঁস হাওয়া প্রশ্ন যোগার করার জন্য। সন্তানও মা-বাবাকে দ্বিধাহীনভাবে বলছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যোগার করে দিতে।কারণ প্রশ্ন যোগার করতে না পারলে তার সন্তানও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। যে বাবা মা সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দিবে সে বাবা মা যদি সন্তানকে অনৈতিক সুবিধা দিতে কাজ করেন তাহলে আমাদের সমাজ নৈতিকতা শিখবে কিভাবে?এই যে চিত্রটা, এটা জাতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর একুশে টিভি অনলাইনকে, `প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে হলে অবশ্যই যারা এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত, তাদের সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে। এছাড়া যেসব স্থান থেকে প্রশ্নফাঁস হয়েছে এবং যেসব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হতে সেটা সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা নির্ধারণ করার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, যত সেট প্রশ্নই করা হোক না কেন, এসব ব্যক্তি ও স্থান বের করে শাস্তি দিতে না পরলে তারা কিন্তু বসে থাকবে না। তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাবে এবং প্রশ্নফাঁস করতে যা যা করণীয়, এর সবই করবে। ফলে অপরাধীদের আগে শনাক্ত করে কঠোর ও দৃষ্টান্ত্মমূলক শাস্তি নিশ্চিত করলেই প্রশ্নফাঁস বন্ধ হবে। অন্যথায় সরকারের সব চেষ্টাই ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান হবে।

সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে বা নিচ্ছে সেগুলো সমর্থনের পাশাপাশি অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের ওপরই বেশি গুরত্ব দেন এই শিক্ষাবিদ। তার মতে, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি অপরাধ দমনে কিছু ক্ষেত্রে কঠোর হাতে শাস্তি প্রদানও প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

এব্যাপারে জানতে চাইলে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, প্রশ্নফাঁসের সঠিক কারণ জাতি এখনও জানতে পারেনি। প্রশ্লফাঁস ঠেকাতে সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। এবং যারা জড়িত তাদের অবশ্যই কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অনেকেই বলে ৫০ বছর আগে প্রশ্নফাঁস ছিলো, এখনও আছে। এমন বলা উচিত নয়। ৫০ বছর আগের সময় আর এসময় এক নয়। এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। যেকোনো মূল্যে প্রশ্নফাঁস রোধ করা দরকার।এটা শিক্ষার্থীদের মেধাকে অবমূল্যায়ন করে। হতাশ করে, নিরাশ করে, জাতির মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে। একইসঙ্গে পরীক্ষা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা যেতে পারে।

এব্যাপারে জানতে চাইলে সাংবাদিক, কলামিস্ট ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো প্রশ্নফাঁস। এর পিছনে মূল কারণ হলো দুর্নীতি।যারা প্রশ্নপত্র তৈরি করছে এবং এর সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তারাই মূলত প্রশ্নফাঁস করছে।

বিনা লাভে কেউ প্রশ্নপত্র ফাঁস করে না। এছাড়া সমাজে মূল্যবোধের অভাব দেখা দিয়েছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটা পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটছে।এ শ্রেণীর অভিভাবকরা ফাঁস হাওয়া প্রশ্ন পেতে মরিয়া হয়ে উঠছে। সাধারণ নাগরিকদের মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের কারণে এমনটা হচ্ছে। এককথায় বলতে গেলে সন্তাদের অসাধু করে গড়ে তুলতে কাজ করছেন অভিভাবকরা। সুতরাং প্রশ্নফাঁস হাওয়ার জন্য সামাজিক অবক্ষয় এবং মানবিক মূলবোধের ঘাটতি কিছুটা হলেও দায়ী। প্রশ্নফাঁস বন্ধে সরকারকে সর্তক থাকতে হবে।সমাজে মূলবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা চালু করতে হবে। প্রশ্নফাঁসসহ অসাধু কাজের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে কিছুটা হলেও কমে আসবে প্রশ্নফাঁস।

এবিষয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, প্রশ্নফাঁস রোধে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সেটা নেওয়া হচ্ছে। এরপরও বর্তমান প্রক্রিয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হবেনা, এর শতভাগ নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন বক্তব্য দিয়ে দায় এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, দুষ্কৃতকারী রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। শিক্ষায় অপরাধ দমনে তাই তারা কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখাবে বলেও জানান তিনি।

এবারে জানতে চাইলে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে এমন একজন শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন বাবা আব্দুর আজিজ বলেন, `এসএসসি পরীক্ষার সময় যা দেখলাম, এইচএসসিতেও যদি তাই হয় তবে তা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য খুব খারাপ নজির হয়ে থাকবে। ঘোষণা দিয়ে প্রশ্নফাঁস হলেও মূল হোতাদের বিরম্নদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কথা শুনিনি। সরকারের কাছে দাবি, এইচএসসিতে যেন এমন না হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।

এব্যাপারে অভিভাবক সমন্বয় পরিষদের সদস্যসচিব নীপা সুলতানা বলেন, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার জন্যই এমনটি ঘটছে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও অন্যতম কারণ। উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসটি দুই বছরের মধ্যে শেষ করাটা অত্যন্ত কঠিন। কোচিং করেও অনেক শিক্ষার্থী সিলেবাস কাভার করতে পারে না। এ ছাড়া সৃজনশীল পদ্ধতি একটি বড় কারণ। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও উচ্চমাধ্যমিক বা কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ হয়নি বললেই চলে। শিক্ষকরাই যেখানে সৃজনশীল বোঝেন না তারা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করবেন কিভাবে? এগুলোই মূলত বড় কারণ এত বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী চূড়ান্ত পরীক্ষা থেকে বিরত থাকার জন্য।

/ এআর /