ঢাকা, শুক্রবার   ০১ নভেম্বর ২০২৪,   কার্তিক ১৭ ১৪৩১

অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশের মেয়েরা

শরিফুল হাসান

প্রকাশিত : ০৭:৩৯ পিএম, ২ এপ্রিল ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ১০:২৮ এএম, ৪ এপ্রিল ২০১৮ বুধবার

দিনটা ছিল ৫ ফেব্রুয়ারি। সালটা ২০১৬। সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই জানতে পারি সাফ গেমসে স্বর্ণজয়ী মাবিয়া আক্তার দেশে ফিরেছেন। কিন্তু কেউ তাকে একটা ফুল দিয়েও স্বাগত জানায়নি। সেই মাবিয়া যে কিনা সাফ গেমসে ভার উত্তোলনে বাংলাদেশে স্বর্ণ এনে দিয়েছিলেন। জাতীয় সঙ্গীতের সময় যার কাঁন্না ছুয়েছিল পুরো বাংলাদেশকে।

সেই মাবিয়া যখন দেশে ফিরলো এবং তাকে স্বাগত জানানোর জন্য যখন কেউ থাকলো না, সেদিন আমার খুব কষ্ট লেগেছিল। যে মেয়েটি আমাদের দেশের এতো সম্মান এনে দিলো, জাতীয় সঙ্গীতের সুরে যে মেয়েটি কেঁদে পুরো দেশকে কাঁদালো, আমরা তাকে এটুকু সম্মান জানাতে পারবো না? সেদিন জেদ চেপে গিয়েছিল। ঠিক করে রেখেছিলাম আর কেউ না হোক আমি ওকে সম্মান জানাবো। এরপর সেদিন ওকে আমাদের প্রথম আলো অফিসে নিয়ে এসেছিলাম। সম্পাদক মতি (মতিউর রহমান) ভাই থেকে শুরু করে বার্তাকক্ষে সবাই সেদিন তাকে করতালি দিয়ে সম্মান জানিয়েছেন।

এর কয়েকদিন পর আমি মাবিয়াদের বাড়িতে যাই। রাজধানী খিলগাঁও সিপাহীবাগের ঝিলপাড়ের একটি টিনের বাসায় থাকে মাবিয়ারা। একেবারে আক্ষেরিক অর্থেই বস্তি। মাবিয়ার বাবা সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। তাদের সংসার চলছিল কোনও মতে। সেখান থেকে মাবিয়া জীবনের লড়াই জিতে এতোদূর এসেছে। কারণ মাবিয়াদের মধ্যে আছে অদম্য শক্তি।

আজকের দিনে কথাগুলো বলার কারণ মাবিয়ার মতোই লাল সবুজ বাংলাদেশের কিশোরি মেয়েরা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ফুটবলে। বাংলাদেশি বহু পন্ডিত লোকজন যখন সারাক্ষণ ব্রাজিল আর্জেন্টিনা নিয়ে পাল্টাপাল্টি গালিগালাজে ব্যস্ত, যখন বার্সা-রিয়াল ছাড়া তাদের আড্ডা জমেই না, সেইখানে আমাদের বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ দলের মেয়েরা হংকংকে হারিয়ে আন্তর্জাতিক যুব ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল জিতেছে ৬-০ গোলে। চ্যাম্পিয়নদের গৌরব তো আছেই, সঙ্গে মাত্র তিন ম্যাচে ২৪ গোলের কৃতিত্বও দিয়েছে উৎসবের উপলক্ষ।

এর আগে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপের টানা দুই আসরের শিরোপা জেতা দিয়ে শুরু বাংলাদেশের মেয়েদের বিজয় কেতন উড়ানো। মাঝখানে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ বাছাই জয় আর কিছুদিন আগে সাফের মুকুট মাথায় দেওয়া কিশোরী মেয়েরা যেভাবে একের পর এক জয়ের পতাকা উড়াচ্ছে তা সত্যিই গর্বের।

আর এবার তো হংকংয়ে চার জাতি জকি কাপে গোলবন্যা বইয়ে দিয়েছে মেয়েরা। মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ১০-১, ইরানের বিপক্ষে ৮-১ আর শেষ ম্যাচে স্বাগতিক হংকংকে ৬-০ গোলে হারিয়েছে তারা। বিদেশের মাটিতে তিন ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে দুই ডজন গোল!

কেউ আবার ভাববেন না হংকং দুর্বল দল। বরং এবাররে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশই ছিল র‌্যাংঙ্কিংয়ের সবচেয়ে পেছনের দল (১০২)। মালয়েশিয়া ছিল ২২ ধাপ এগিয়ে। ইরান ৪৪ ধাপ। ৩১ ধাপ এগিয়ে ছিল হংকং। বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল গত তিন বছরের ব্যবধানে যে নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছে গেছে তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ এগুলো।

ইরানের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করা তহুরা হংকংয়ের সাথে আবার করেছেন হ্যাটট্রিক। প্রথম ম্যাচে দুই গোলসহ পুরো টুর্নামেন্টে আট গোল করে বাংলাদেশের এই স্ট্রাইকারই জিতেছে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার। সেরা খেলোয়াড় হওয়া শামসুন্নাহারেরও (জুনিয়র) চার গোল। শুরুতে বলেছিলাম মাবিয়ার কথা। চরম দারিদ্যে তার জীবন কেটেছে। ময়মনসিংহের কলসন্দিুররে ফুটবলার সাবিনা তো জ্বরেই মারা গেল। আজকের চ্যাম্পিয়ন দলের কৃষ্ণা, সানজিদা, তহুরা, মারিয়া, অনুচিং, আনাই, শামসুন্নাহারের জীবনের লড়াইটাও নিশ্চয়ই একেকটা গল্প।

আরেকটা কথা বলি। নিয়মিতভাবে নারী নিপীড়ন বা ধর্ষণের মতো খবরগুলো যখন দেখি আমার ভীষণ খারাপ লাগে। আমি সবসময় বলি আমাদের মেয়েদের সহযোগিতা করার দরকার নেই। শুধু যদি আমরা প্রতিবন্ধকতা না তৈরি করি তবেই আমাদের মেয়েরা বিশ্বজয় করবে। সেই আশায় শুভেচ্ছা জানাই কৃষ্ণা, সানজিদা, তহুরা, মারিয়া, অনুচিং, আনাই, শামসুন্নাহাদের। শুভেচ্ছা জানাই বিজয়ী বাংলাদেশের ফুটবল দলকে। শুভেচ্ছা জানাই বাংলাদেশের প্রতিটা মেয়েকে। শুভেচ্ছা জানাই বাংলাদেশকে।

 

লেখক: ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট ও ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান