নেলসন ম্যান্ডেলা: কাছ থেকে দেখার কিছু সুখস্মৃতি
আবদুল্লাহ আল-হারুন
প্রকাশিত : ০২:৫২ পিএম, ৪ এপ্রিল ২০১৮ বুধবার
স্টাইগেনবার্গার বেলভেদ্রে হোটেলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার ফিট উচ্চে সুইটজারল্যান্ডের দাভোজ শহরে অবস্থিত। জুরিখ থেকে একশো কিলোমিটার দূরে ইটালির সীমান্তে। চারদিকে পাহাড়্, ছবির মত একটি উপত্যকা। সবসময় স্থানীয় অধিবাসীদের তিনগুণ ট্যুরিস্ট! জার্মান ভাষার অঞ্চল। সুইটজারল্যান্ডের নিজস্ব কোনো ভাষা নেই। এখানে তিনটি সরকারি ভাষা। ইটালি, জার্মান ও ফ্রেঞ্চ। হোটেলটি পাঁচতারার এবং সাথে দুটি প্লাস (৫++)। পৃথিবীর ২৫০টি সর্বশ্রেষ্ঠ হোটেলের একটি। উচ্চতার জন্য শহর ও আশেপাশের এলাকা সারাবছরই বরফাচ্ছন্ন। সেজন্যই দুনিয়াজোড়া খ্যাতি, সবসময় যখন তখন বরফে স্কি করা সম্ভব। শহরে মোট ৭৭টি হোটেল। পাঁচতারার আরও সাতটি হোটেল আছে। বেলেভেদ্রে হোটেলের আরেকটি খ্যাতি হল, এখানেই প্রতিবছর ২৫ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে পৃথিবীর সেরা রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, আবহাওয়াবিদসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এবং প্রথম সারির শিল্পি, কলাকুশলীদের সমাবেশ হয়। এছাড়া বছরের সবসময় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, রাজা-বাদশাহ, প্রিন্স-প্রিন্সেস, ক্রোড়পতিরা আসেন ছুটি কাটাতে। বরফের উপর নানা খেলা খেলেন। শহরটির আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি কিংবদন্তিতুল্য। মধ্যশহরে একটি সাইন বোর্ডে লেখা অছে, এ শহরে শেষ খুন হয়েছে ১৮ জুলাই, ১৮৮৬ সালে! এয়ারপোর্ট নেই। জুরিখ বা কাছেই ইটালির একটি শহর থেকে হেলিকপ্টারে বা ট্রেনে যাতায়াত হয়। মটরেও আসা যায়। তবে রাস্তা খুবই আঁকা-বাঁকা, পাহাড়ের ভেতর দিয়ে। ভয়াবহ সব গভীর গিরিখাত।
এ হোটেলটিতে আমি দু’বছর (২০০৩-২০০৫) রাতের চৌকিদার (নাইট-অডিটর হল ভদ্র-নাম) হিসেবে কাজ করেছি। রাত দশটায় বিকেলের রিসেপশনিস্টরা চলে যাবার পর থেকে সকাল ছ’টা নাগাদ আমি থাকতাম সমগ্র হোটেলসহ এখানের অতিথিদের দায়িত্বে। পদটিকে রাতের রিসেপশনিস্টও বলা হয়। সারাদিনের রোজগারের হিসাব-কিতাব করা ছিল অতিরিক্ত দায়িত্ব। এজন্যই নাইট-অডিটর শিরোনাম। বিলম্বে আসা অতিথিদের জন্য দ্বার খোলা, চাবি হস্তান্তর, কোন অতিথির মাথাব্যাথার ওষুধ পৌঁছে দেয়া, কারো অসুখ হলে হাসপাতালের গাড়ি-ডাক্তার ডাকা, এক রাতের মহিলা (বা পুরুষ)-সঙ্গী যোগাড় করে দেয়া, ইত্যাদি। বলা যায় সব কাজের কাজী। রেস্টুরেন্টে একজন বাবুর্চি থাকত। অতিথিদের অনেকেই রাতে ক্ষুধার্ত হন। তাদের খাবার বানায় সে এবং কোন ওয়েটার নেই, আমাকেই কক্ষে নিয়ে যেতে হত। আট ঘন্টা হোটেলটিতে কর্মচারী বলতে আমি ও বাবুর্চি। আমার ডিরেক্টর বলত, এ সময়টিতে তুমি আমার প্রতিনিধি। তুমি রাতের ডিরেক্টর। তোমার উপরেই হোটেলের নিরাপত্তা, অতিথিদের সুখ-দুঃখ, তাদের দাবি-দাওয়া-আবদার মেটানো সব নির্ভর করে। এসব কারণে বেতনটি ছিল খবুই ভালো। অত টাকার চাকরি আমি আমার জীবনে আর কোথাও করিনি। এখানকার দু’বছরের সঞ্চয় থেকেই জার্মানিতে আবার ফিরে এসে পেনশন নাগাদ (২০১০) বেকার ভাতাসহ ভালই জীবন যাপন করেছি। কারণ এরপর আর কোন স্থায়ী চাকরী মিলেনি (বা আমি নেইনি)। এখন ভাবলেও গা শির শির করে!
২০০৮ সালের জুন কি জুলাই মাস। হঠাৎ করেই সারা হোটেলেই একটি নাম শোনা যাচ্ছে- নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি আসছেন। পাঁচরাত থাকবেন। মাঝে সেন্ট মরিসে একটি স্যানোটরিয়ামে থাকবেন চারদিন। সফরটি ব্যক্তিগত এবং মুলতঃ স্বাস্থ্যগত কারণে। হোটেলে থাকার সময় পূর্ণ বিশ্রাম নেবেন এখানে। সুইটজারল্যান্ডের নিরাপত্তা অফিসাররা আগের সপ্তাহে প্রতিদিনই এসে কর্মচারীদের নাম-ধাম ঠিকানা অতীত বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করেন। আমি রাতে একা আট ঘন্টা কাজ করি, আমার উপরে জিজ্ঞাসাবাদের ঝড় বয়ে গেল। নামের শুরু আবদুল্লাহ দিয়ে, আরও বিপদের কথা! সবে জুনিয়ার বুশের দ্বিতীয় ইরাক যুদ্ধ শেষ হয়েছে। দেশটি পুরো লণ্ডভণ্ড। সারা ইউরোপে মুসলমানদের ইসলামিস্ট-সন্ত্রাসী নামে অভিহিত করা শুরু হয়ে গেছে। আমার সুন্দর একটা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ছিল। ডিরেক্টর বললেন, নিরাপত্তা বিভাগের দাবি, ম্যান্ডেলা থাকার সময় দাড়িটি কাটতে হবে। আমি একটা জেদী লোক। সারাজীবনই নানা বিরূপ পরিস্থিতির সামনাসামনি হয়ে আহত সিংহের মত ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেছি। এসব কথায় মাথায় আগুন জ্বলে যায়! আমি বললাম, দাড়ি কাটার বদলে আমিই মাইনাস হয়ে যাচ্ছি। আমাকে বিদায় দিন। ডিরেক্টরের শিরে সংক্রান্তি। কর্মচারী হিসেবে আমার খুব সুনাম। শুদ্ধ জার্মান-ইংরেজি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারি। হোটেলের কাজে দুই যুগেরও বেশি অভিজ্ঞতা। অনেক অতিথিই চলে যাবার পর ডিরেক্টরের কাছে রাতের পাহারাদারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে টেলিফোন করেন। অনেকে চিঠিও লেখেন। সবচেয়ে বড় কথা এখন কোন নতুন লোক নেয়া যাবে না। গত তিনমাসে যাদের নেয়া হয়েছে, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে ছুটি দেয়া হচ্ছে। ম্যান্ডেলা বলে কথা! তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে কোন ঝুঁকি নেয়া চলবে না। আমার সাপ্তাহিক ছুটির দু’দিন যিনি কাজ করেন, তিনি ৬০ বছরের একজন মহা ভিতু লোক! ম্যান্ডেলা আসার খবর শুনেই ডিরেক্টরকে বলেছেন, ঐ পাঁচদিন তিনি হোটেলের ছায়াও মাড়াবেন না। পুলিশকে তার বড় ভয়। আবদুল্লাহ যেন এ কটা দিন চালিয়ে নেন। তিনি পরে পরপর তিনদিন আমার হয়ে কাজ করবেন। আমি একদিন বেশি সাপ্তাহিক ছুটি পাব। ডিরেক্টরের লেজ ফাটা বাঁশে। একদিন হোটেলের রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্ন আহারের আমন্ত্রণ করে নানা চর্ব-চুষ্য-লেহ্য-পেয় খাইয়ে খোশামুদি করে আমাকে বশ করলেন। বললেন পাঁচদিনই তো, তারপর আবার যতখুশি দাড়ি রেখো। কত আর না করা যায়! আমি চোখের জলে পরের দিন সেলুনে গিয়ে কুড়ি বছরের প্রিয় দাড়িকে বিসর্জন দিলাম। ম্যান্ডেলা চলে যাবার পরে আর ইচ্ছা হয়নি। আমার আবার ৩-৪ দিনের দাড়ির ফ্যাশনে মন নেই। বড্ড বেশি চুলকায়! বছর দুয়েক পরে জার্মানিতে জীবনের শেষ বেকারত্বের সময় আবার দাড়ি রেখেছি এবং ২০১২ সালে পুনরায় কর্তন। সে আরেক ইতিহাস!
এই হোটেলে কাজ করার সময় আমি প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন, তৎকালিন জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনান, ধনকুবের বিল গেইটস, ব্রিটেনের তখনকার প্রধানমন্ত্রি টনি ব্লেয়ার, প্রিন্স চার্লস, তার দুই পুত্র, প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ইত্যাদি বড় বড় হস্তিদের কাছে থেকে দেখেছি। সামান্য কথা বলেছি, করমর্দন হয়েছে। কারো কারো সাথে অনেকক্ষণ কথাও হয়েছে। আমার সুবিধাটি ছিল রাতে একা কাজ করি এবং অতিথিদের সে সময় কোন না কোন সমস্যা বা চাহিদা হয়। কক্ষ থেকে টেলিফোন এলেই আমি বুঝতাম কোন সেলিব্রিটি ডাকছেন। ডেস্কে কোন ঘরে কে আছেন তার নাম লেখা থাকত। আর প্রেসিডেন্ট সুইটের টেলিফোনের আলোটি ছিল লাল (অন্যগুলি সবুজ)। প্রেসিডেন্ট, সরকার প্রধান, ধনকুবেররা, জগদ্বিখ্যাত, ফিল্মস্টার- নায়ক-নায়িকারা প্রেসিডেন্ট সুইটে থাকতেন। প্রথম প্রথম লাল বাতি জ্বললে গায়ে কাঁপুনি উঠত! আমি সামান্য এক রাতের চৌকিদার, বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এসব মহারথীর ছবি টিভির পর্দা আর খবরের কাগজের পাতায় দেখি। আর এখন এদেরই একজন আমার সাথে কথা বলবেন। আল্লাহর নাম নিয়ে টেলিফোন তুলে কন্ঠে যতটা সম্ভব মুক্তগাছার মন্ডার মত মিষ্টতা এনে, বিনয়ের অবতার হয়ে নামটি বলে তার সেবার জন্য আমার মনপ্রাণ তৈরি বলে ঘোষণা দিতাম। ভাবখানা, তার কাজে আমি ফানা হয়ে যাব! কয়েকজনের সাথে কথা বলার পর দেখলাম, ভয়ের কিছুই নেই। এরাও আমার মতই একজন মানুষ। অনেকেই রাতে টেলিফোন করেছেন বলে কুন্ঠিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। তাদের মাফ চাওয়া শুনে তো আমি সাত বাঁও পানির নিচে। বলে কি? আমি করব মাফ? আমার ঘাড়ে তো একটাই মাথা।
বহুদিন পর ম্যান্ডেলার প্রথম রাতটিতে আমার বুক দুরু দুরু। মহাত্মা গান্ধি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন, মাদার টেরেসা, কার্ল মার্কস, টলস্টয় এসব শতাব্দির মহাপুরুষদের নাম শুনেছি। অনেক পরে জন্ম হওয়ার জন্য কারো সাথে দেখা হবার কোনও অবকাশ হয়নি। এখানে দাভোজে যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, নামকরা ফিল্ম-স্টার, নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, রাজনীতিক, রাজা-মহারাজা, প্রিন্স-প্রিন্সেসিন, টাকার কুমীর, রাষ্ট্রদূত, ডিপ্লোম্যাট, তারা কেউই ম্যান্ডেলার সমকক্ষ নন। তিনি একাই একশ। দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। ২৭ বছর জেলে থেকে কালোদের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। শক্তিশালী এপারথিড-সাদাদের হারিয়ে দিয়ে নিজ দেশবাসীদের জন্য সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছেন। এখন এই মহান পুরুষটি আমার সঙ্গে একই ভবনে মাত্র একটি টেলিফোনের দূরত্বে অবস্থান করছেন। হয়ত ঘুমিয়ে আছেন। বাইরে আজ সেনাবাহিনীর গাড়ি। তাবু গেড়ে তারা পাহাড়া দিচ্ছে। প্রধান দরজা আজ খোলা। পাঁচদিনই ২৪ ঘন্টা খোলা থাকবে। খোলা-বন্ধ করার দায়িত্ব বা ঘরের চাবি দেয়া, পাঁচদিন এসব কাজ আমার আর করতে হবে না। কারণ রাত দশটার পরে আর কাউকে হোটেলে ঢুকতে দেয়া হবে না। অতিথিদের আগেই বলে দেয়া হয়েছে। হোটেল হাউস-ফুল নয়। ইচ্ছা করেই দোতলা, যেখানে প্রেসিডেন্ট সুইট, তার ১৫টি ঘরই খালি রাখা হয়েছে। একতলায় রিসেপশন, রেস্টুরেন্ট, অফিস। তিনতলা ও চারতলায় সব ঘরে অতিথি নেই। ম্যান্ডেলা আসার এক সপ্তাহ আগ থেকেই বুকিং বন্ধ ছিল। এখন হোটেলে মোট ৬৭ জন অতিথি (সব ঘর ভরে গেলে ১৫৮ জন)। এবং এ ৬৭ জনের মধ্যে সুইটজারল্যান্ডের সহকারী প্রধানমন্ত্রি (আমন্ত্রণদাতা হিসেবে), তার স্টাফ, ম্যান্ডেলার স্টাফ, দেহরক্ষী ইত্যাদি। আজ লবিতেও চারজন সশস্ত্র পুলিশ। তাদের দেহের দুদিকে মারণাস্ত্র ঝুলছে। সব তালাতেই প্রহরী বসানো রয়েছে। এদের কয়েকজনের সাথে আমার এরইমধ্যে পরিচয় হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের সময়। দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেত-শাসনের অবসানের পর কয়েকশ উপনিবেশবাদি ব্যুর (হলান্ডবাসী) সুইটজারল্যান্ডে হিজরত করেছে। এদের অনেকেই সস্ত্রাসবাদি, সশস্ত্র। হারানো রাজ্যের বেদনায় ক্ষিপ্ত। তারা এখানে ম্যান্ডেলার সফরের বিরুদ্ধে পোস্টার দিয়েছে। সভা-সমাবেশ করেছে। এজন্যই এতসব পাহারার ব্যবস্থা।
আমি নিরাপত্তা বিভাগের নির্দেশে আজ রাত সাড়ে ন’টায় এসেছি। এ পাঁচরাত এ সময়ে আসতে হবে। বিকেলের মহিলা রিসেপশনিস্ট কারিন আমাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবার সময় বলল, ম্যান্ডেলা অসুস্থ। আমি যেন সতর্ক থাকি। স্থানীয় হাসপাতালের ভিআইপি ইমার্জেন্সি টেলিফোন নম্বরটি বড় বড় করে লিখে ডেস্কে রাখা দেখে মনে হল এরা আমাকে নন-ইউরোপিয়ান ভেবে (যেন একটি মুর্খ শিশু) এ কাজটি করেছে। দেশে যে বারো বছর কলেজে ইংরেজি পড়িয়েছি, তারা ভালমতই সেটি জানে! এগুলিই হল প্রচ্ছন্ন্ বর্ণবাদ! তবে এ নম্বরটি ব্যবহার করতে হয়নি। ম্যান্ডেলা সারাসময় সুস্থই ছিলেন।
কিন্ত পয়লা রাতে লাল বাতি জ্বলল না! লম্বা জার্নি করে এসে টানা ঘুম দেয়াটাই স্বাভাবিক। কারিন বলেছে, তিনি বিকেল চারটেয় হোটেলের হেলিকপ্টারে চড়ে জুরিখ থেকে এসেছেন। সুইটজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট তার সাথে ছিলেন। ম্যান্ডেলার সাথে সন্ধ্যা ৭টায় ডিনার করে তিনি চলে গেছেন। ভাইস-প্রধানমন্ত্রি তার প্রতিনিধিত্ব করছেন। সারারাত একটা উত্তেজনায় ভুগেছি। এত রাতে চোখের দেখা সম্ভব নয়। কিন্ত ‘আমি তারে চোখে দেখিনি, শুধু তার বাঁশি শুনেছি’, তাও হল না। টেলিফোনের বাঁশি আর বাজল না। সকাল ছ’টায় সহকর্মীকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় চলে এলাম। কাছেই থাকি, হেঁটে যাতায়াত করি। অন্য দিন এসেই কোনমতে কাপড় খুলে ঘুমিয়ে পড়ি। আজ সে ক্লান্তি নেই। কোথায় যেন একটা আশাভঙ্গের বেদনা। লাইব্রেরি থেকে আনা ম্যান্ডেলার জীবনীর কয়েক পাতা উল্টালাম। যদি দেখা হয়, তার কাছে কিছু জানার আছে। তারই প্রস্তুতি। এক সময়ে নিদ্রা এসে গেল। দ্বিতীয় রাতেও ‘না মিটিল সাধ।’ লবিতে দেখলাম অফ্রিকার নানা স্যুভেনীর ঝুলছে। কারিন বলল, ম্যান্ডেলার সফর উপলক্ষে সাউথ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত আজ এসব নিয়ে এসেছেন। অতিথিরা কিনছেন। হোটেলের কর্মচারীরাও কিনছে। ডিরেক্টর একটি কাঠের মুর্তি কিনেছেন ৪০০ ফ্রাংক দিয়ে। কারিন একটা ফিতার লেস কিনেছে। সে বলল ইচ্ছা হলে আমিও যা খুশি কিনতে পারি। কেনার পর আমার নাম ও দাম একটা খাতায় লিখে রাখতে হবে। সামনের মাসের বেতন থেকে কেটে নেয়া হবে। আমি ভাবলাম, আমার মা বলতেন, ‘সোনা থুয়ে আঁচলে গেরো।’ মহান নেতারই যখন দেখা পেলাম না, তখন তার দেশের পুতুল, ভাস্কর্য! দরকার নেই। এসব রাখবো কোথায়? আমার কি এখানে নিজের বাড়ি? ২০ বর্গমিটারের একটি পাখীর বাসা! সারা রাত ডেস্কে ঘন ঘন চোখ গেল। ভাবলাম যন্ত্রটি ঠিক আছে তো? হয়ত তিনি কল করছেন, বাতি জ্বলছে না। একটা পরীক্ষা আছে, সেটা পরপর তিনবার করলাম, ঠিক আছে। সবুজ বাতি জ্বলেছে কয়েকবার, তাদের সেবাও করেছি। কিন্ত লালবাতির দেখা নেই। মনে হল, আশির দশকে জার্মানিতে মেমসাহেব-বান্ধবীর ফোনের প্রতীক্ষা এভাবেই করতাম। তখনও একত্রে থাকা শুরু হয়নি। অপেক্ষা মনে হত অনন্তকাল! রাতের বাবুর্চি হেনরী জানাল, ম্যান্ডেলা নাকি মহা ভালো লোক। হোটেলের কর্মচারীদের সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে পরিচয় করেছেন, তাকেও ধরেছিলেন। ‘আবদুল্লাহ দশ সেকেন্ডের কম হবে না, তার বুকে ছিলাম। আহা! মনে হল স্বর্গে আছি।’ আমি জানতাম ওর দিনের শিফট চলছে। বললাম, দিনেও কাজ করেছ, রাতেও আবার? বলল, এরকম লোকের সেবা করাটা ভাগ্যের ব্যাপার। আমি হেড কুকের সাথে ব্যবস্থা করেছি। সামনের তিনদিন বেলা তিনটায় এসে সারারাত থেকে সকালে তোমার সাথে বিদায় নেব। রাতে যদি তিনি কিছু খেতে চান, আমার সেরা ডিশ বানিয়ে তাকে খাওয়াব। ম্যান্ডেলার যে জগতজোড়া খ্যাতি, জনপ্রিয়তা, বাবুর্চির কথা থেকেই বোঝা যায়। আমার রাগ হল ভীষণ। শালা বাবুর্চি তার কোলাকুলি পেল, আর আমি এখনও-।
ভাগ্যের শিকা খুলল তৃতীয় রাতে। রাত তিনটার দিকে হিসাবের খাতা খুলে সারাদিনের আয়-ব্যয়ের যোগ-বিয়োগ শুরু করি। মহা হাঙ্গামার কাজ। মোটেই ভালো লাগে না। আমি বরাবরই অংকে কাঁচা। ভাগ্য ভালো যে এসব এখন কম্পুটারেই করা যায়। বেশ সহজ হয়ে গেছে। কিন্ত ১৯৮০ দশকে যখন হাতে কলমে, আঙ্গুলের কড়া গুণে হিসাব করতে হত, অনেক সময় একটা সামান্য যোগই বার বার ভুল হয়ে যেত। এবং আমি প্রায়ই চাকরিতে ইস্তফা দিতাম। ম্যানেজারের কাকুতি-মিনতিতে (সারারাত কে চাকরি করবে?) থেকে যেতাম। এখন তো হোটেলে গেস্ট কম। কক্ষ-ভাড়ার আয় মুখে মুখেই করা যায়। মোট তিনটি রেস্টুরেন্ট হোটেলে এবং দুটি বার। তবে এসবেও রোজগার কমে গেছে গত দুদিন ধরে। বাইরের অতিথিরা পুলিশ-কন্ট্রোলের ভয়ে আসেই না। রাত নটায় বার বন্ধ হয়ে এখন। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙ্গল ঝড়ে’ গুণ গুণ করে গাইতে গাইতে হিসাব করছি, এমন সময় কৃষ্ণের বাঁশি বাজল। লাল বাতি! সাথে মধুর একটা পোঁ শব্দও হয়। মনে হল, বিশ্বের সর্বোত্তম সঙ্গীত। না, ঘরের দুয়ার ভাঙ্গেনি, দুয়ার খুলেছে। বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দ নিজের কানে শুনলাম। এত নার্ভাস জীবনে হইনি।
‘হ্যাঁলো, আমি রাতের রিসেপশন স্টাফ, আবদুল্লাহ, স্যার আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?’ ইংরেজিতে বললাম। বুকের শব্দে গলা তলিয়ে গেল।
‘ও হ্যাঁলো, শুভসন্ধ্যা, আমি ম্যান্ডেলা’- আমি ভীষণ বেকুব হয়ে গেলাম, উত্তেজনায় আমি তো গুড ইভিনিং বলিনি। এদেশে যত রাতই হয়, সকাল হওয়া পর্যন্ত শুভসন্ধ্যা এবং কথাশেষে গুডনাইট। ভীষণ রাগ হল আমার নিজের উপর। সখ্ত বেয়াদবি, তাও ম্যান্ডেলার সাথে। পরে আমি তার কাছে মাফ চেয়েছি। উনি স্মিত হেসে বলেছেন, আমি টেরই পাইনি।
‘নাম কি বললেন, আবদুল্লাহ?’
‘হ্যাঁ স্যার, আমি আবদুল্লাহ।’
‘আপনার পুরো নামটি কি জানতে পারি?’ ম্যান্ডেলার গলাটি কিন্ত কিছুটা মেয়েলি (রবীন্দ্রনাথেরও সেরকম ছিল)। শুনেছি দীর্ঘদিন জেলে থেকে গলাটি বসে গিয়েছিল। খসখসে কিন্ত কন্ঠে অদ্ভুত একটি মায়াবী আকুলতা।
‘আবদুল্লাহ আল-হারুন, স্যার’
‘কিছু মনে করবেন না, আপনি কি আরব দেশের?, ইউরোপের তো নন।’
‘স্যার আপনি কিছুটা ঠিক। নামটি পুরোই আরবি। তবে আমি বাংলাদেশের।’
‘বাংলাদেশ? শেখ মুজিবর রহমান? আপনারা তো যোদ্ধা-জাতি, আমাদের ভাই। রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। আপনাদের আমাদের ইতিহাস এক।’
শুনে আমার চোখে পানি এসে গেল। আভিভূত হয়ে গেলাম। আসলেই মহাপুরুষ। আমার মুখে কোন কথা নেই। কি বলব এখন?
কিছুক্ষণ পরে বললেন, ‘আমার কথায় কি কষ্ট পেলেন? আমি সত্যি কথাই বলেছি। আমরা সব নিপীড়িত, সব ভাই ভাই। তা ভাই আবদুল্লাহ, আপনাকে এত রাতে ডিসটার্ব করছি, কিছু মনে করবেন না। আমার ভীষণ মাথা ধরেছে, কোন অষুধ আছে কি হাতের কাছে?’
‘স্যার, শুনেছি আপনি অসুখে ভুগছেন। আপনি চাইলেই আমি আপনাকে ডাক্তারকে না বলে কোন ট্যাবলেট দেব না। আমার এখানে কয়েক রকম মাথা ব্যথার বড়ি আছে। কিছু মনে করবেন না। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমাদের হোটেলের ডাক্তারের কাছে ফোন করে জেনে নেই, আপনার জন্য কোনটি ভাল হবে।’
’আবদুল্লাহ ভাই, আপনি দেখছি ভীষণ কড়া লোক। তা আপনাদের ডাক্তার কি হোটেলেই থাকেন?
‘না তিনি তার বাসায় এখন।’
‘তাহলে এত রাতে আর তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। একটা কফি ম্যানেজ করতে পারবেন?’
‘স্যার মাথা ব্যথায় কফি বিষ। ওটা খেলে আরও বাড়বে। কিছু মনে না করলে আমার মায়ের একটা টোটকা আপনাকে বলি। কাজ হবে। ছোট সময়ে রাতে আমাদের মাথা ধরলে আমরা তার কথামত ঘরের জানালা খুলে বাইরের বাতাসে নিঃশ্বাস নিতাম। কাপড়ের ন্যাকড়া পানিতে চুবিয়ে মা কপালের ঘাম মুছে দিতেন। আপনি সেক্রেটারিকে ডেকে বলুন এটার ব্যবস্থা করতে।’ প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটে মোট পাঁচটি ঘর। একটি বড় বেড রুম, ড্রয়িং রুম, সেক্রেটারির ঘর এবং দুজন বডিগার্ডের থাকার ঘর। একটা রান্না ঘরও আছে। মোটামুটি একটি বাড়ি।
‘সেক্রেটারি তো মা নয়। ওকে আর এত রাতে ডাকব না। বেচারী সারাদিনই আমার নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। এখন ঘুমাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে আপনার মা আপনাদের খুব যতœ নিতেন। আর কোন ব্যবস্থা কি নিতেন, মাথা ধরা সারানোর জন্য?’ বোঝা গেল সাংঘাতিক সহজ সরল এবং কৌতুহূলী লোক এই বিশ্ববরেণ্য নেতা।
‘স্যার, আমাদের মাথা ব্যাথা ভোলানোর জন্য তিনি মজার মজার গল্প করতেন। আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনে একসময় দেখতাম ব্যথা চলে গেছে।’
’হো হো, প্রাণখুলে অট্টহাসি হাসলেন। মাই ডিয়ার আপনিও আপনার মায়ের মতই মজার লোক। কতদিন আছেন সুইটজারল্যান্ডে?। না উত্তর দিবেন না। আমি নিচে আসছি। আপনি তো রিসেপশন ছেড়ে আমার এখানে আসতে পারবেন না। আপনার মায়ের দুই নম্বর ওষুধ কাজে লাগাই। আপনার সাথে গল্প করলে এ ব্যথা সেরে যাবে। বহুদিন পর একজন মনের মত কথা বলার লোক পেয়েছি। সারা দিনরাত- রাজনীতির ঘ্যনর ঘ্যানর আর ভালো লাগে না।’
আমি আঁৎকে উঠলাম। তিনি এলে আমার হিসাবের কি হবে?
‘স্যার ক্ষমা করবেন, কিছু মনে করবেন না, আমি এখন হোটেলের সারাদিনের আয়-ব্যয়ের হিসাব করছি। আমার পোস্টের নাম নাইট-অডিটর। এটাই বলতে গেলে প্রধান কাজ। আরও ঘন্টাখানেক লাগবে শেষ করতে। আরেকটা পরামর্শ আছে। হাতের কাছে কোন হালকা বই থাকলে পড়তে পারেন। ওতেও কাজ হয়।’
’ও হোঃ ওহোঃ ওহোঃ!, হেসে আর কুল পান না ম্যান্ডেলা। আপনি খুব চালাক লোক। এবং অত্যন্ত দায়িত্বশীল। ঠিক আছে এখন আর আপনাকে ডিসটার্ব করব না। আপনার কাজ কখন শেষ?’
‘সকাল ছয়টায় স্যার।’
‘তারপর তো বাসায় গিয়ে ঘুমান, নাকি আপনি হোটেলেই থাকেন?’
‘হ্যাঁ স্যার। আমার একটা এক রুমের ছোট্ট এপার্টমেন্ট আছে। কাছেই, হেঁটেই যাই আসি।’
‘গুড, কিন্ত আগামি রাতে আপনি আমাকে কিছু সময় অবশ্যই দেবেন, যেভাবেই হোক। আপনার সাথে আমার পরিচয় করতেই হবে। খুবই ইন্টারেস্টিং লোক আপনি। আপনি নিশ্চয়ই রাজনীতি করতেন না। রাজনীতির লোকরা এভাবে সরাসরি কথা বলে না।’
‘স্যার কি যে বলেন, বর্তমান পৃথিবীতে আপনি এখন সবচেয়ে বড় রাজনীতিক, আপনার ধারেকাছেও কেউ নেই। ইন্টারেস্টিং কথাটার সৃষ্টিই হয়েছে আপনার জন্য। আপনি আকর্ষণীয় হিসেবেও সবার সেরা। স্যার, ছাত্রজীবনে আমি সামান্য রাজনীতি করেছি। আমাদের দেশে সব ছাত্রই রাজনীতি করে। তারপর ওটা বাদ পড়ে গেছে। ঠিক আছে স্যার, আগামিকাল আপনি সম্ভব হলে রাত একটার মধ্যে কল করবেন। আমি রাত দশটায় কাজে আসি। ঐ পর্যন্ত আমি প্রায় ফ্র্রি থাকি। আপনার মত মহান লোকের সাথে কথা বলতে পারলে আমি ধন্য হয়ে যাবো।’
‘কথাটি আমারও। আপনার সাথে কথা বলে আমিও অত্যন্ত গর্ববোধ করব। কাল কথা হবে। গুড নাইট। ভালো থাকুন। ও হ্যাঁ, আমার মাথা ধরা সেরে গেছে। আপনার মায়ের চিকিৎসার তুলনা নেই। এতক্ষণ আপনার সাথে কথা বলে এখন দেখছি কোন ব্যথা নেই। মিরাক্ল, ধন্যবাদ, গুডবাই।’ বলে টেলিফোন ছেড়ে দিলেন। সকালে বাসায় ফিরে সারাদিনে ভাল ঘুম হল না। কথাগুলি তিনি বলেছেন, না স্বপ্নে শুনেছি?
পরদিন কাজে এসে দেখি, ডিরেক্টর বসে আছেন। এ সময় তিনি থাকেন না। ’তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি, আবদুল্লাহ।’ বুক কেঁপে উঠল, আবার কি করলাম? ‘ম্যান্ডেলা তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আজ দুপুরে খাবার সময় ভাইস-প্রিমিয়ারের সামনে, সবার সামনে বললেন, ডিরেক্টর সাহেব আপনি ভাগ্যবান। আবদুল্লাহর মত একজন আপনার হোটেলে কাজ করে। স্পিরিচুয়াল লোক। অদ্ভুত তার মনোসমীক্ষা। গতরাতে তার সাথে টেলিফোনে কথা বলে আমার মাথা ধরা ছেড়ে গেছে! আজ তোমার সাথে কথা বলবেন। নিজেই বলেছেন, নিচে আসবেন। গার্ডদের বলে দেয়া হয়েছে। আবদুল্লাহ, ম্যান্ডেলা থাকা পর্যন্ত আজ থেকে সামনের দু’দিন তোমার সবসময়ের ডিউটি তাকে নিয়ে। হিসেব করার জন্য গতরাতে তাকে নিচে আসতে দাওনি। তুমি কি একটা লোক হে? ওর সাথে কথা বলার জন্য, সারা দুনিয়ার সবাই পাগল। আর তুমি কিনা সামান্য একটা হিসাবের জন্য, তাঁকে বলেছ, এখন আমি অনেক ব্যস্ত!’ গলায় তার বিদ্রুপের সুর। তার ভয়, হোটেলের একজন স্টাফ ম্যান্ডেলার কথা শুনেনি! তিনি কি মনে করেন! আমি বললাম, ‘ডিরেক্টর সাহেব, হিসাব না করলে প্রথম বকাটি তো আপনিই দিতেন। আমি তো ম্যান্ডেলার চাকরি করিনা। চাকরি করি আপনার।’ এবার ডিরেক্টর সাহেব অপ্রস্তুত হলেন। ‘ঠিক আছে, তিনি থাকা পর্যন্ত তোমাকে আর হিসাব করতে হবে না। সকালের ওরা এসে করবে। আমি বলে দিচ্ছি। এখন থেকে তুমি -নাইট অডিটর অন স্পেশাল উিউটি এন্ড অনলি ফর ম্যান্ডেলা-। শুধুমাত্র তাকেই এটেন্ড করবে।’ এ ধরনের যাদুকরী ঘটনা আমার জীবনে বহুবার ঘটেছে। আমি আর আশ্চর্য হই না। আমার জীবনে উত্থানও যেমন বহুবার হয়েছে, আবার সশব্দে পতনও আছে অনেক।
রাত এগারোটার দিকে লালবাতি জ্বলল। সারাদিন আমি মক্শ করেছি আজ প্রথম ডায়ালগটি কি দেব। শেষবার সেটা মনে মনে রিহার্সেল দিয়ে টেলিফোন তুলতেই ওপাশ থেকে নারী কন্ঠ, ‘হ্যালো রিসেপশন, আপনি কি মিঃ আবদুল্লাহ? আমি রিংকি সায়গল, মিঃ ম্যান্ডেলার সেক্রেটারি।’ আমি মুহূর্তে হতাশ হয়ে গেলাম। তবে কি তিনি আজ আর নিচে আসবেন না? হয়ত শরীর খারাপ। ‘হ্যালো, আপনি কি শুনছেন?’ রিংকি আমার সাড়া না পেয়ে একটু অস্থির। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘হ্যাঁ, হ্যালো, সরি, আমি আবদুল্লাহ, বলুন, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?‘ (রিসেপশনের গৎ বাঁধা কথা, কয়েক হাজারবার বলা হয়ে গেছে।)
‘মিঃ ম্যান্ডেলা এখন সাউথ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের সাথে ভিডিও কনফারেন্স করছেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে বলছেন, আপনি কি এখন ফ্রি?’ ‘হ্যাঁ আমি তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছি। তিনি কেমন আছেন?’ ‘মোটামুটি। কনফারেন্স শেষ হলেই আমি তাকে নিয়ে আসছি।’
মাহেন্দ্রক্ষণটি আসন্ন। নার্ভাস তো হলামই, বুকের ঢিপ ঢিপ ছাড়াও মনে হল, আমার জিহ্বাটি প্রায়ই আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আজ অত্যন্ত সতর্ক হয়ে কথা বলতে হবে। রাজনীতির আকাশে তিনি সূর্য। আর আমি টিমটিমে মাটির প্রদীপ। কোনো বেয়াদপি যেন না হয়।
লবীতে বাইরে থেকে আরও দুজন পুলিশ এল। এখন মোট ছয়জন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। নিশ্চয়ই ওদের জানানো হয়েছে, তিনি নিচে আসছেন। আমি রাতের বাবুর্চি হেনরীকে টেলিফোন করে ডেকে নিয়ে এসে রিসেপশনে থাকতে বললাম। কেউ টেলিফোন করলে যেন ফোন রিসিভ করে। কারণ শুনে তো ওর চক্ষু কপালে উঠে গেল। তারপর শেষবারের মত কোটটি টেনেটুনে, টাইটি ঠিক করে লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এক একটি মুহূর্ত যেন এক একটি ঘন্টা। আইনস্টাইনের থিয়োরী অব রিলেটিভিটি আবার নতুন করে হৃদয়ঙ্গম হল।
লিফট খুলে গেল। ডান হাতে লাঠি এবং বাঁ হাতটি সেক্রেটারির কাঁধে রেখে মহামানব দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে সেই শিশুর মত বিশ্বজয়ের হাসি। মনে হল বিশ্ব দুলে উঠল। চারদিকে শতসহস্ত্র কাঁসার ঘন্টা, ঢোল বাজছে। দু কান লাল হয়ে গেল। চোখে পানি আসে আর কি। ম্যান্ডেলা আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য সুইট থেকে নেমে এলেন। এ তো নিজের চোখে দেখেই বিশ্বাস হয়না, কেউ শুনলে কি বিশ্বাস করবে? পুলিশরা, হেনরী সবাই বজ্রাহত, বাকরুদ্ধ হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে। এর আগেও আরও অনেক মহারথির সাথে এখানেই দেখা হয়েছে, আমার এরকম বিহ্বলতা বোধ হয়নি।
হাস্যমুখে বাইরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কত সেকেন্ড, দশ-বিশ-তিরিশ! বললেন, ‘গুড ইভিনিং ব্রাদার আবদুল্লাহ, কেমন আছেন ভাই?’ গায়ে সবুজ-লাল-সাদা রঙের চেক-ফুল হাতা সার্ট। তার উপরে একটা সোয়েটার। পরনে গরম রাতের পাজামা। চারদিক সুগন্ধে ভরে গেল। চমৎকার একটা হালকা আর মিষ্টি সেন্ট মেখেছেন। ‘ধন্যবাদ, ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন,’ বলতে বলতে আমরা হেটে কোনায় টেবিলের দিকে গেলাম। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম, আমরা কোথায় বসব। মুখোমুখি বসার পর, তার হাত থেকে লাঠিটি নিয়ে রিংকি একটু দূরে আর একটি টেবিলে গিয়ে বসল।
বহুদিন আগের কথা, প্রায় নয় বছর। কথা কি হল তার বিস্তারিত আর এখন মনে নেই। সেক্রেটারির হাতে একটা প্যাকেট ছিল। ইশারা করতেই ওটা নিয়ে এসে ম্যান্ডেলাকে দিল। প্যাকেটটি আমার হাতে দিয়ে তিনি বললেন, ‘সামান্য একটা উপহার, আপনার জন্য। আমার নাতনির প্রিটোরিয়াতে স্যুভেনিরের দোকান আছে। ও নিজের হাতে এসব বানায়। খুলে দেখেন।’ আমি সৌজন্যের সাথে ধন্যবাদ দিয়ে, এ সময় যা বলতে হয়, ‘এটার আবার কি দরকার ছিল’, বলে প্যাকেট খুলে দেখি একটা নানা রঙের খুচরো কাপড় দিয়ে তৈরি করা পুতুল। নৃত্যরতা এক কিশোরি। অদ্ভুত সুন্দর। দেখে খুব ভাল লাগল। আমি বললাম, ‘আমি তো আপনাকে কোন উপহার দিতে পারছিনা, এজন্য দুঃখ লাগছে।’
’আপনার মার শেখানো মাথা ব্যথা সারার যে অব্যর্থ ওষুধটি শিখিয়ে দিলেন, তাই আপনার উপহার।’
তারপর আমার ব্যাপারে জানতে চাইলেন। কতদিন বিদেশে আছি। ২৭ বছর শুনে বললেন, ঠিক আমার জেলখাটার সময়। কারণ জেনে দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, আপনার মত সম্ভাবনাময় লোকরা যদি দেশ ছেড়ে বাইরে চলে আসেন, দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। কিন্ত তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র ভয়াবহ এবং এমন একটি সমস্যা যার সমাধান সে দেশের জনতার হাতে নেই। ধনী দেশগুলি গরীব দেশগুলির ভাগ্যনিয়ন্তা। তারা চায় না, এরা স্বাবলম্বী হোক। তাহলে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হবে। এই দুষ্ট শয়তানী খেলার শেষ হবে কি কোনদিন?
বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই একা থাকেন?’
‘কি করে বুঝলেন?’ আমি বললাম।
‘আপনার কথাবার্তায় বোঝা যায়। ভেতরে ভেতরে আপনি খুবই অস্থির এবং অশান্ত। একটা ভালো সঙ্গিনী খুঁজে নিন। মানুষ একা অপূর্ণাঙ্গ। কোনে ভালো কাজ তাকে দিয়ে হয় না। জীবনে প্রকৃত সুখ শুধু বন্টন করেই আসে। এবং এর শুরু পরিবার দিয়ে। স্ত্রী, সন্তান এদের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগ করার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা।’
আমি বললাম আমার সঙ্গিনী ছিল জার্মানিতে। আঠারো বছর পরে সে ঘর ভেঙ্গে গেছে। শুনে বললেন, একবার-দুবার ঘর ভাঙ্গলে তো জীবন শেষ হয়ে যায় না। আমিও উইনির সাথে ২৭ বছর জেলে থেকে জীবন ভাগ করে নিয়েছিলাম। জেল থেকে বের হয়ে আসার পর, সে ঘর ভেঙ্গে গেল। আমি আবার ঘর বেঁধেছি এবং এখন খুব ভালো আছি। মজা করে বললেন, জেলে থাকলে হয়ত উইনিই আমার ঘরণী থেকে যেত।’
‘তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকা তো স্বাধীন হত না।’
‘স্বাধীনতা কারো জন্য বসে থাকে না। আমার জায়গায় অন্য কেউ ঠিকই আসত, সংগ্রাম সফল করার জন্য।’
এ কথা সে কথা। রিংকি এক সময় উঠে এসে বলল, ‘স্যার বলেছিলেন এক ঘন্টার বেশি কথা বলবেন না। সাড়ে বারোটা বাজে। আপনার ঘুমের দরকার আছে।’
আমিও বলললাম, স্যার আপনি অসুস্থ। এতটা রাত জাগা ঠিক না। এখন শুতে যাওয়াটাই ভালো হবে।’
তার মুখটা করুণ হয়ে গেল। মনে হল, আড্ডাবাজ লোক। কথা বলতে ভালোবাসেন। যাই হোক, বললেন, ‘কাল তো আমি সেন্ট মরিস স্যানোটোরিয়ামে যাব চার দিনের জন্য। ফিরব ১৭ তারিখে। পরদিন বিকেলে এখানে বাচ্চাদের স্কুলে একটা অনুষ্ঠানে যাবো। তারপর সন্ধ্যায় হেলিকপ্টারে জুরিখ গিয়ে রাত নটার প্লেনে দেশে ফিরব। ঠিক আছে, ঐ দিনে আমি বেলা একটা থেকে তিনটা অবধি কোন এপয়েন্টমেন্ট রাখবো না। রিংকি তুমি এখানে একটা নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে আমাদের তিনজনের জন্য একটা টেবিল রিজার্ভ কর। এখানে তো আমার বাড়ি নেই। আবদুল্লাহকে রেস্টুরেন্টেই খাওয়াতে হবে। তুমি আগামিকাল রিজার্ভ করে আবদুল্লাহর জন্য রিসিপশনে একটা মেসেজ রেখে দিও। গুডবাই আবদুল্লাহ। আবার আমাদের রেস্টুরেন্টে দেখা হবে। আপনারতো দিনে ঘুমাতে হয়। সেদিন একটু কম ঘুমাবেন। আমার জন্য দয়া করে না হয় একটা দিন একটু কষ্ট করলেন, কি বলেন?‘ এমন আন্তরিকভাবে বললেন, আমি যে তার আমন্ত্রণটি না করব তার উপায় রইল না, সময়ও নেই। করমর্দন করে রিংকির কাঁধে ভর দিয়ে তিনি লিফটের দিকে রওনা হয়ে গেছেন। বুঝলাম নেতৃত্ব দেবার অভ্যাস, কোন কিছু নির্ধারন করে, তার ব্যত্যয় সহ্য করার অভ্যাস তার নেই।
কিন্ত যা যা তাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম, তার একটাও বলা হয়নি। কথাবার্তা ব্যক্তিগত সীমারেখার মধ্যেই ছিল। দেখি খাবার দিন কথাগুলো তুলতে পারি কিনা।
রিসেপশনে হেনরী বলল, ‘তোমরা কি আগে থেকেই পরিচিত?’ ‘কেন?’ ‘না, তোমাদের কথাবার্তা শুনে মনে হল বহুদিনের পরিচিত তোমরা।’ আমার এসব মনে হয়নি। আমি আপনজনের মতই কথা বলে গেছি। আসলে পরিচিত হবার জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। কারো সাথে বহু বছর কথা বলেও তাকে পরিচিত মনে হয় না। আবার একজনের সাথে প্রথম দেখায় একবার কিছুক্ষণ কথা বললেই ‘মনে হয় চিনি উহারে’। মনের ভেতরে একটা মানুষ চেনার মেশিন আছে। ওটাই বলে দেয়, কে তোমার আপন, কে নয়।
পরের দিন কাজে এসে রিংকির একটা নোট পেলাম। ১৭ তারিখ দুপুর একটায় রেস্টুরেন্ট ফিয়ার ইয়ারেসাইটেনে লাঞ্চের ব্যবস্থা হয়েছে। রেস্টুরেন্টটি একটি পাহাড়ি এলাকায়। দাভোজ শহর থেকে একটু বাইরে। সামনে একটা ঝরনা আছে। চারদিকে জঙ্গল। নিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশ। যার কাছে খোঁজ নিয়েছিল, রিংকিকে সে ভাল পরামর্শই দিয়েছে। বাসে যাতায়াত করা যায়। শুনলাম ম্যান্ডেলা দুপুরের পর হেলিকপ্টারে সেন্ট মরিস চলে গেছেন। যাবার সময় রিসেপশনে কারিনের কাছে আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেছেন। বলেছেন ১৭ তারিখে দেখা হবে। ওর শীতল আর নিস্পৃহ গলায় হিংসার স্পর্শ। ম্যান্ডেলা একজন দরিদ্র এশিয়ানকে এত খাতির করেন কেন? জানি এ হৃদয়ের টান তারা বুঝবে না। সুখে নয়, দুঃখে আমরা একে অপরের সুহৃদ। সুখ একজন আরেকজনের প্রতিদ্বন্দ্বি করে, বন্ধু নয়। প্রথম দিনেই টেলিফোনে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার নিপীড়িত কালো জনসাধারণ বাংলাদেশীদের ভাই। এটা বৈভবের ভ্রাতৃত্ব নয়। বরং শোষিত আর নিগৃহিতদের বন্ধন। সাম্রাজ্যবাদ যাদের সম্পদের ভিত্তি, ১৭-১৮ দশকে রাজার আশীর্বাদে যারা সমুদ্রে পরের ধন লুন্ঠন করে নিজেদের প্রাসাদ গড়েছে, সে জলদস্যুরা এ সহমর্মিতা বোঝার ক্ষমতা রাখে না। প্রথম-দ্বিতীয় বিশ্ব কোনদিনই তৃতীয় বিশ্বকে নিজের মত হতে দেবে না। বরঞ্চ এদের কল্যাণে তৃতীয় বিশ্ব আরও নিচে নেমে চতুর্থ-পঞ্চম ধাপে চলে যাবে। নেলসন ম্যান্ডেলা এ পতনের বিরুদ্ধে। দরিদ্র বিশ্বের সখা।
বেলা একটার আগেই ঝরনার পাশে বাস থেকে নামলাম। রাতে কাজ করে এসে মোটেই ঘুম হয়নি। আজ থেকে আমার তিনদিন ছুটি শুরু হবে। সেজন্য ঘুমের তেমন তাড়াও ছিল না। ভেতরে ঢুকতেই সুশ্রী পরিচারিকা এসে বলল, ’আবদুল্লাহ, মিঃ ম্যান্ডেলার গেস্ট?’ রিংকি ভালমতই বলে রেখেছে। কোনার দিকে জঙ্গলমুখি একটি টেবিলে নিয়ে গেল। তিনটি চেয়ার। বসার পর বলল, কোন ড্রিংক পান করব কিনা। আমি মাথা নেড়ে নিষেধ করলাম। যা কিছু পান বা খাবার, মহামানব এলেই করব। চেয়ারে বসে মনে হয় একটা নিদ্রার আমেজ হয়েছিল। হঠাৎ সাইরেনের শব্দে চমকে উঠলাম। মেইন গেট দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি, একটি পুলিশের খোলা জীপ আস্তে আস্তে চলে গেল। পেছনে একটি লম্বা কালো লিমু্যুজিন। ভিআইপি কার। দরজা জানালা বন্ধ। নিশ্চয়ই বুলেট প্র“ফ। হোটেলের দ্বাররক্ষী মটরের দরজা এক পাশে খুলে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমে রিংকি তারপর ম্যান্ডেলা নামলেন। রক্ষীটি পা ঠুকে একটা প্রবল স্যালুট করল। ম্যান্ডেলা তার সেই বিখ্যাত হাসি দিয়ে তার সাথে করমর্দন করলেন। বেচারী তো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কোন ভিআইপি (এবং ম্যান্ডেলার মত উচ্চতর সারির) তার সাথে এ পর্যন্ত নিশ্চয়ই করমর্দন করেনি। মনে মনে ভাবলাম, এখানেই ম্যান্ডেলার সাথে বিশ্বের সব বড় মাপের রাজনীতিকদের পার্থক্য। তিনি জনতার নেতা আর অন্যরা জনতা থেকে যতটা পারেন দূরে থাকেন। সদা গুপ্ত খুন হওয়ার আশংকায় থাকেন। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার দৌড়ে এসে তাকে সাথে করে ভেতরে নিয়ে এলেন। ঢুকেই ম্যান্ডেলা কি বলতেই ম্যানেজার আমাদের টেবিলটি দেখিয়ে দিল। ম্যান্ডেলা ডান হাতে লাঠি আর বাম হাত রিংিকর কাঁধে রেখে আস্তে আস্তে হেঁটে এলেন। মনে হল, চারদিনের স্যানোটেরিয়ামবাসে তার উপর দিয়ে নানাধরনের টেস্টের ঝড় বয়ে গেছে। একটা বিধ্বস্ত চেহারা। আমি নিশ্চিত, অন্য কোন নেতা হলে আজ কোনমতেই এখানে আসতেন না। জীবনে কত অবহেলা, অনাদর, অসম্মানের শিকার হয়েছি। আশা পূরণের চেয়ে আশাভঙ্গের বেদনার ভাগই বেশি। আজ তিনি না এলে মোটেও দুঃখিত হতাম না। কিন্ত, বুঝতে পারছি, তার কষ্ট হচ্ছে, তবুও এসেছেন। চোখের জল আর বাঁধ মানে না। আমার ইঁদুরের মত জীবনে আজ মহা রাজাধিরাজের আগমন। এ সুখ আমি কোথায় রাখি?
করমর্দন করে লাঠিটি রিংকির হাতে ধরিয়ে দিয়ে সামনের চেয়ারে বসে বিশ্ব আলো করা হাসিটি দিয়ে বললেন, ‘আমি খুবই দুঃখিত আপনার দুপরের ঘুমটি নষ্ট করেছি। সারারাত কাজ করে আপনি এখানে এসেছেন, আমি লজ্জা পাচ্ছি।’ এ কথার জবাব আমার জানা নাই। আমি রিক্ত, নিঃস্ব, বাস্তুচ্যুত। এই বিশ্বের নয়নমণিকে আমি কি বলব? ভাবলাম, গুরুদেবের ভাষায় বলি, ‘ওই আসনতলের মাটির পরে লুটিয়ে রব, তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধুসর হব।-’ কিছুই বলা হল না। পরিচারিকা মেনু নিয়ে এসে আমাদের সবাইকে একটা করে দিল। রিংকি ইতিমধ্যেই তৃতীয় চেয়ারে বসে পড়েছে। ম্যান্ডেলা টের পেলেন না মনে হয়, আমি এখনও কোনও কথাই বলিনি। আমি আরও মুষড়ে পড়লাম। কথায় আমি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান, এখন বলার মত কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। সমস্ত ক্ষমতা নিঃশেষ। মনে হল ম্যান্ডেলার এসবে মন নেই। তিনি বললেন, ‘খাদ্য-নির্বাচন মেয়েদের দায়িত্ব, পুরুষের কাজ খাওয়া। রিংকি তুমি তোমার সাথে আমাদের দু’জনেরও বাছাইটা করে দাও। দুজনেই আমরা তার দিকে তাকালাম। সে মেনু থেকে বেশ দ্রুতই একটি আইটেম বেছে নিয়ে, তিনজনের জন্য আনতে বলে দিল। পানীয় হিসেবে সবাই আমরা সাদা পানির কথা বললাম। অনেক কষ্টে এখন বললাম, ‘আপনি মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত, না আসলেই পারতেন এখানে। আবার তো বাচ্চাদের একটা ফাংশানে যাবেন। তারপরই জুরিখে যাবেন হেলিকপ্টারে। রাতেই দক্ষিণ আফ্রিকা উড়বেন। বিরাট একটা ধকল হয়ে গেল না?’
‘সত্যি বলতে কি কোন রাজনীতিক বা মন্ত্রির সাথে খাবার কথা থাকলে মনে হয় ড্রপ করতাম। রিংকিরও তাই ইচ্ছা ছিল। কিন্ত আমার ভাইকে কথা দিয়ে তো আমি ভাঙ্গতে পারি না। আপনার সাথে আমার সম্পর্কটি সমস্ত স্বাথর্, রাজনীতির ঊর্ধে। মনুষ্যত্যের একটা প্রকাণ্ড জোর আছে। সে জোরেই আমি এসেছি ভাই। হ্যাঁ শরীরটা বিরুদ্ধে কিন্ত মন ষোলো আনার চাইতে বেশি পক্ষে।’ আমি যদি জানতাম আপনার মত একজনের সাথে আমার দাভোজে দেখা হবে, তাহলে আমি সেন্ট মরিসের এপয়েন্টমেন্টটা না করে আপনার হোটেলেই থাকতাম। আরও অনেক আলাপ করতাম আপনার সাথে।’ মাথা থেকে পা অবধি আনন্দ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঢেউ বয়ে গেল। এসব কি শুনছি? সারাজীবন শুনে এসেছি, আমি একটা অপদার্থ, নিষ্কর্মা, দায়িত্বজ্ঞানহীন। আজ রাজার রাজা কি বলছেন? যথারীতি তার এ কথারও কোন জবাব আমি খুঁজে পেলাম না।
‘জানেন কি, রিংকি ভারতীয় বংশোদ্ভুত?’ তিনি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এতক্ষণ যেন তিনি তার মনের সব কথা উজাড় করে দিয়ে আমাকে একটা অচেনা-অজানা দেশে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যে দেশ আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে, সেখানে আমাকে টেনে নিয়ে অধিষ্ঠিত করছিলেন। একজন অযোগ্যকে যোগ্যতার পোশাক পড়াচ্ছিলেন। কেন জানি আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।
‘তাই নাকি?’ এখন তার টাইটেল সায়গল বুঝতে পারলাম। এটা তো ভারতীয়। এ নামে একজন প্রথিতযশা গায়কও ছিলেন অবিভক্ত ভারতে। আমার খুব প্রিয়। আমি রিংকিকে কথাটা বলতেই সে বলল, হ্যঁাঁ সে বাবার কাছে ওর কথা শুনেছে। তবে তার গান খুব একটা পছন্দ নয় তার। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, হিন্দি জানা আছে কি? বলল, ‘নমস্তে, ক্যায়ছে হ্যায়, আচ্ছা হ্যায় জাতীয় কিছু জানি। আর বেশি না। আমার জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়। এ পর্যন্ত দু’বার ভারতে গিয়েছি।’
‘গেলে কেমন লাগে?‘
‘কিছু মনে করবেন না, বিদেশ বলে মনে হয়। আমি তো বাবা-মার জন্য ভারতীয়। কিন্ত আর সব কিছুই তো আমার দক্ষিণ আফ্রিকার। স্যারের কাছে শুনেছি, আপনি ২৭ বছর ধরে দেশের বাইরে। এর মধ্যে একবারও যাননি। আপনি কি দেশকে মিস করেন?’ এর উত্তর কি দেব? মিস তাকেই করা যায়, যাকে মাঝে মাঝে ভুলে যাই। কিন্ত আমি আমার প্রিয় দেশকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলি না। মিস করব কেন তাহলে? জানি এসব কথা বোঝার মানসিকতা ওর নেই। বললাম, ‘অবশ্যই মিস করি।’
‘দেশে যান না কেন? আপনি কি পলিটিক্যাল রিফিউজি?’
‘হ্যাঁ সেরকমই অনেকটা।’
রিংকির মুখটা ম্লান হয়ে গেল। মহিলা তো, সব দেশেই এরা এসব কথা শুনলে বিষণœ হয়ে যায়।
খাবার আসার আগেই এক যুগল এল। হাতে নোট বুক। ম্যান্ডেলার সই নেবে। ওরা যাবার পর আরেকজন। বুঝলাম, রিংকি টেবিল বুক করার পর, এরা ভালই পাবলিসিটি দিয়েছে। কারণ আমি এসে এদের দেখিনি। ম্যান্ডেলা আসার পরই এরা ঢুকেছে। তিনজনের একটি দল এসে, ম্যান্ডেলাকে নানা প্রশ্ন শুরু করে দিল। বুঝলাম সংবাদপত্রের লোক। হাতের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে। ম্যান্ডেলার চোখেমুখে বিরক্তি। ভালমানুষিরও একটা শেষ আছে। একসময়ে তিনি কিছুটা উচ্চস্বরেই বললেন, তিনি এখানে এসেছেন তার এক ভাইকে নিয়ে খেতে। রাজনীতির আলোচনা করতে নয়। আপনারা দয়া করে চলে যান। লোকগুলি বিরস বদনে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চলে গেল। এরমধ্যে রিংকি ফোন করে একজন দেহরক্ষীকে ভেতরে ডেকে আনল। তাকে বলল, ম্যান্ডেলার কাছে যেন কেউ আর আসতে না পারে।
খাবার এসেছে। তিনজনেই ধীরে ধীরে খাওয়া শুরু করেছি। ভেজিটারিয়েন ডিশ। বুঝলাম, রিংকি জৈন সম্প্রদায়ের হতে পারে। ওরা মাছ-মাংস খায় না। জিজ্ঞেস করলাম না। এসব ব্যক্তিগত প্রশ্ন অনেকেই পছন্দ করে না। ম্যান্ডেলা আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘খাবার মজা লাগছে তো?’ দুজনেই সানন্দে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। ‘আপনার কেমন লাগছে?’ আমি বললাম। ‘দুজনে তোমরা মজা পাচ্ছ, আমি আর বিপরীত বলব কেন? আমি গণতন্ত্রী। আমারও ভালো লাগছে।’ কথায় কথায় রস করেন ম্যান্ডেলা। মনে যাদের কোন ঘোরপ্যাঁচ নেই, তারাই এমন সহজ কথা বলতে পারে।
‘ভাই আবদুল্লাহ, আমার মনে হয় আপনি অদূর ভবিষ্যতে দেশে যাবেন না। আপনার সমস্যা আমি আন্দাজ করতে পারি। আপনি তো দুনিয়া ঘোরা লোক। কত জায়গায় গেছেন এ ২৭ বছর। কিন্ত আফ্রিকা এখনও যাননি। দয়া করে দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়ে এ ফাঁকটি পূরণ করা শুরু করুন। রিংকি, ভাইকে আমার একটা প্রাইভেট কার্ড দাও। রিংকি সাথে সাথে তার ব্যাগ থেকে একটা সুদৃশ রঙিন কার্ড বের করে দিল। চোখেমুখে তার বিষ্ময়ের ছাপ। এরকম কার্ড প্রদান সে সচরাচর করে না। আমার সাথে মাত্র একবার ফোনে, আরেকবার হোটেলে সামান্য আলাপ। কিন্ত ম্যান্ডেলার ব্যক্তিগত কার্ড পেয়ে গেলাম আমি। কার্ডটি খুবই ছোট। শুধুমাত্র লেখাঃ নেলসন ম্যান্ডেলা মাদিবা, তার পরের লাইনে একটা মোবাইল নাম্বার। আর কিছু নেই। ঠিকানা বা দেশের নাম বা তার পদবী প্রেসিডেন্ট (একবার প্রেসিডেন্ট তো আজীবন পদবী প্রেসিডেন্ট) নেই।
‘আপনি দক্ষিণ আফ্রিকাতে গেলে এ নম্বরে ফোন করবেন। রিংকি বা অন্য কোন সেক্রেটারি ধরবে। রিংকির তো জানাই আছে। অন্যরাও বুঝতে পারবে, এ আমার কোন নিজস্ব লোকের ফোন। কারণ এ নাম্বারটি খুব বেশি লোকের কাছে নেই। (আবার গৌরবে রোমাঞ্চিত হয়ে গেলাম) ওরাই জানাবে আপনি আমার কাছে কিভাবে আসবেন। আসুন একবার, খুব খুশি হবো। কয়েকদিন দুই ভাই বসে মনের আঁশ মিটিয়ে গপ্পো করব। আমার বর্তমান স্ত্রী খুব ভালো রাঁধেন। তার হাতের রান্না খাবেন। আমার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতিনদের সাথে পরিচিত হবেন। আমি সবাইকে আপনার কথ বলব। ওরাও খুশি হবে। আপনার মার আরও নিশ্চয়ই অনেক টোটকা আপনার জানা আছে। সব আমাকে বলবেন। আপনার মাথা ব্যথার মহৌষধটি তো আমি কখনই ভুলব না। সারাজীবন কাজে লাগাবো। সবাইকে বলব।’
আরো অনেক কথা হল। কিন্ত কিছুতেই আমি আমার সাজানো প্রশ্নগুলি বলার সুযোগ পেলাম না। ওগুলি ছিল সবই রাজনৈতিক। কিন্ত ম্যান্ডেলা কেন জানি রাজনীতি একদম এড়িয়ে গিয়ে, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তার জীবনের কিছু কথা যার সাথে বর্তমান রাজনীতির কোনই সম্পর্ক নেই, সেসবই শুধু বলে গেলেন। একবার টেলিফোনে, দু‘বার সামনাসামনি আলাপে তার হৃদয়ের উষ্ণতা ছিল পুরোপুরি। তিনি আমাকে সহোদরের মত মনে করে কথা বলেছেন। আমার দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন, নতুন করে বাঁচার, প্রেরণা যুগিয়েছেন, জীবনকে নতুন রঙে রঙিন করতে। আমাকে মনস্তাত্ত্বিকের মত সঙ্গ দিয়েছেন, রাজনীতিকের মত বক্তৃতা দেননি।
বিকেল তিনটার দিকে দাভোজের মেয়র এবং বাচ্চাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা এলেন। আগেভাগেই বোধহয় এরকমই কর্মসূচি করা ছিল। ম্যান্ডেলা বিল আনতে বললেন। এবার শুরু হল আরেক নাটক। ম্যানেজার দৌড়ে এসে বলল, স্যার আপনারা আমার অতিথি।
‘ভুল বললেন, আমরা আপনার অতিথি নই-বললেন ম্যান্ডেলা। আমি আমার ভাইকে লাঞ্চের দাওয়াত দিয়েছি। এখানে ও হল আমার অতিথি এবং আমার সেক্রেটারি হল আমার কেয়ারটেকার। আপনি যদি আমাকে বিল না দিতে দেন, আমার ভাইকে অপমান করা হবে। কোন মূল্যেই তা আমি মেনে নেব না।’ সবাই হতভম্ব। ম্যানেজার নতমস্তকে গিয়ে বিল নিয়ে আসলেন। টাকা শোধ করে, ম্যান্ডেলা আমাদের পরিচারিকাকে ভালো টিপসও দিলেন। আমি চিত্রার্পিতের মত স্থির হয়ে সব দেখছি। এবার ম্যান্ডেলা ফেরার পথে তার বাম হাত আমার কাঁধে রাখলেন। রিংকি তাকে ধরতে এসে পিছিয়ে গেল। ডান হাতে লাঠি নিয়ে ম্যান্ডেলা বললেন, ‘শেষ যাত্রায় তুমি সঙ্গ দাও ভাই। আবার আমাদের দেখা হয় কিনা হয়, কে জানে।’ শিউরে উঠলাম। তার কথাই সত্য হয়েছে, আমাদের আর দেখা হয় নাই।
গেট খুলে দ্বাররক্ষী দাঁড়িয়ে। লাঠি রিংকির হাতে দিয়ে তার সাথে করমর্দন করলেন। বললেন, আমি তোমার শুভকামনা করি (I wish your best)। রক্ষীর চোখ সজল হয়ে গেল। এমন ব্যবহার সে নিশ্চয়ই আগে পায়নি। গড়িতে উঠা পর্যন্ত তার বাম হাত আমার কাঁধে। শেষ কথা, ‘চেষ্টা করবেন সাউথ আফ্রিকা আসতে। আমার তো শরীর খারাপ, আর হয়ত বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারব না। হ্যাঁ ভালো কথা, সম্ভব হলে দেশে যাবেন, আপনি অসম্ভব দেশপ্রেমিক। এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সঙ্গিনী খুঁজে নিন। আপনার মন ভালো, খুঁজলে নিশ্চয়ই পাবেন। আমার অনন্ত শুভকামনা আপনার জন্য।’ আমি চেষ্টা করলাম কিছু বলতে। কিন্ত বাকরুদ্ধ। কথা বলার জন্য বিশ্ববিখ্যাত আবদুল্লাহ আল হারুন এই বিশ্বমানবকে বিদায়বেলায় কিছুই বলতে পারল না। এত বড় ব্যর্থতা আমার জীবনে আর নেই। গাড়িতে উঠার আগে আবার সেই, দশ-বিশ না তিরিশ সেকেন্ড! অত বড় বিশাল বুকে আমি যেন মহাশূন্যে একটি ক্ষুদ্র গ্রহ। আমার হাতে দৃঢ়ভাবে চাপ দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন। রিংকি পাশ দিয়ে আগেই উঠেছে। সে অস্ফুট স্বরে কি যেন বলল। বোধহয় গুডবাই। চোখ নত। পুলিশের খোলা জীপে প্রাণ এসে গেছে। ম্যান্ডেলার গাড়ি এগিয়ে গেল। এই প্রথম এইসব লম্বা ভিআইপি গাড়ির উপরে ভীষণ রাগ হল। জানালা সব কালো, বন্ধ। ভেতরে যারা আছেন, তাদের কিছুই দেখা যায় না। পেছনে আরও চারটি গাড়ি। ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। আমি নিরবে পোর্টিকোতে দাঁড়িয়ে। কোন কিছুই ভাবছি না। মন শূন্য, দেহ শূন্য, ভাবনা শূন্য, সারা পৃথিবীই শূন্য।
‘আপনি কোথায় যাবেন? চলুন, আপনাকে নামিয়ে দেব। তিন বেহায়া সাংবাদিকের একজন। কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতেই পারিনি। আপনি বলুন, তাঁর সাথে কি কথা হল। আমার পত্রিকায় একটা ভালো কভারেজ হবে। আপনার ছবিও নেব। দেখলাম আপনার সাথে অত্যন্ত হৃদ্যতা। অনেকদিন ধরে চেনেন নাকি? আপনি কি দক্ষিণ আফ্রিকার?’ এই কথা? আমাকে লিফট দেবে আর ম্যান্ডেলার নিউজ বানাবে আমার কাছে শুনে। রাগে চারপাশে অন্ধকার দেখলাম। ’ধন্যবাদ, আমি হেঁটে যাবো। আমার অন্যত্র কাজ আছে।’ বেচারি মুখ বিষণœ করে চলে গেল।
ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, দুনিয়ায় কথা বলার লোকের বড় অভাব। সবাই কোনো না কোনো মতলবে কথা বলতে আসে। আপনার মত নিঃস্বার্থ সঙ্গ দেবার মত লোক খুব বেশি নেই। আমার এবারে সুইটজারল্যান্ডে আসার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলেন আপনি। আপনাদের মত লোকদের কখনও ভোলা যায় না।’
এসব কথা ম্যান্ডেলা আমাকে একবার একবাক্যে বলেননি। বহুদিন আগের কথা। কোনটার পরে কোনটা শুনেছি তা ঠিকমত মনে নেই। মনের গভীরে ঢুকে স্মৃতির বোঝা আলগা করে এসব কথা বের করে আনতে হয়েছে। অনেক কথা নিজেই ভুলে গেছি। কখনও বোধহয় আর মনে হবে না। কোনদিন ভাবিনি এসব নিয়ে আবার লিখতে হবে। মানচিত্রের প্রধান সম্পাদক আসিফ হাসানের খোঁচায় লিখতে হল।
তার উপহার পুতুল, কার্ড, কবে হারিয়ে ফেলেছি। দক্ষিণ আফ্রিকা যাবার তার সাদর আমন্ত্রণ, দুএক বছর পরেই ভুলে গিয়েছিলাম। আমার এই এক বড় দোষ। সব কিছুই দ্রুত ভুলে যাই। বন্ধুরা এজন্য ভুল বোঝেন। কতজনে নিমন্ত্রণ করেছিল। এই বেলেভেদ্রে হোটেলেই প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন বিশ মিনিটের আলাপের পর নিউ ইয়র্ক যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যাইনি। কতজনে আমার সামনেই ম্যান্ডেলার সই নিয়েছে। কিন্ত তার জীবনীতে একটা সই নেবার কথা আমার মনেও হয়নি। কেন এসব হয় আমার? আমি কেন মানুষের প্রেম-ভালোবাসা ভুলে যাই?
যাক, দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার আর দরকার হবে না। ম্যান্ডেলা দুনিয়াকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন কিছুদিন আগেই। খবরটি শুনে তেমন ব্যথা পাইনি, যতটা তার সাথে কথা বলার সময় পেয়েছিলাম। কেন জানি মনে হয়, ৯৫ বছর বয়সে তাঁর বেঁচে থাকতে খুবই কষ্ট হত। মাঝে মাঝে মৃত্যু পরিত্রাতা। আমি কোন ধর্মীয় দৃষ্টিকোনে মৃত্যুর পরে জীবনে বিশ্বাস করি না। তবে আমার দৃঢ় ধারনা, এ পৃথিবীতে মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যায় না। কোথাও আমাদের আত্মা চলে যায়ই। সেখানেই ম্যান্ডেলার সাথে আমার একদিন দেখা হবে, তার কার্ড ছাড়াই।
তবে তার একটা কথা দেরি করে হলেও রেখেছি। দীর্ঘ দশ বছরের একাকিত্বের পর ২০১২ সালে দেশে বিয়ে করেছি। আমার মনের মানুষটিকে পেয়ে গেছি। ম্যান্ডেলার ভবিষৎদ্বাণী সফল হয়েছে।
লেখক : জার্মান প্রবাসী
E-mail: al-harun-abdullah@online.de