বিটকয়েন: আগামী দিনের ডিজিটাল মুদ্রা!
আসিফ হাসান
প্রকাশিত : ০২:৫৯ পিএম, ৪ এপ্রিল ২০১৮ বুধবার
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে বিটকয়েন হলো ওপেন সোর্স ক্রিপ্টোগ্রাফিক প্রোটোকলের মাধ্যমে লেনদেন হওয়া এক ধরনের সাঙ্কেতিক মুদ্রা। যাকে কেউ কেউ ডিজিটাল মুদ্রা বলেও অভিহিত করছে। ধারণা করা হয় আগামি দিনে বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এই ডিজিটাল মুদ্রা ব্যাপক প্রভাব রাখবে। এই মুদ্রা দিয়ে লেনদেনে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বা নিকাশ ঘর লাগে না। ২০০৮ সালে সাতোশি নাকামোতো নামের এক বিজ্ঞানী এ মুদ্রাব্যবস্থার প্রচলন করেন। তিনি এ মুদ্রাব্যবস্থাকে ‘পিয়ার-টু-পিয়ার লেনদেন’ নাম দেন।
বিটকয়েন কি বিশ্বটাকে পাল্টে দিতে যাচ্ছে- এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়ার সময় হয়তো এখনও আসেনি। তবে চালু হওয়ার পাঁচ বছরের মাথায় এটাকে নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবা হচ্ছে। অবশ্য তার আগে এটার ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে, সেটাও বোঝার চেষ্টা হচ্ছে। অনেকে এটাকে ‘ডিজিটাল গোল্ড’ আখ্যা দিচ্ছেন। মাদক অথবা অস্ত্রসহ যে কোনো দামি জিনিস কিনতে পশ্চিমা বিশ্বে নগদ ডলার বা ইউরোর চেয়ে বিটকয়েনই এখন বেশি নিরাপদ বলে বিবেচিত হচ্ছে। তারপরও বিনিময়ের নতুন মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত ডলারের এ ভার্চুয়াল প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ ব্যাংকসহ সরকারগুলোকে। তাদেরও প্রশ্ন, বিটকয়েনের ভবিষ্যত কী?
বিটকয়েনের লেনদেন ‘বিটকয়েন মাইনার’ নামে একটি সার্ভারে সুরক্ষিত থাকে। পিয়ার-টু-পিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত থাকা একাধিক কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের মধ্যে বিটকয়েন লেনদেন হলে এর কেন্দ্রীয় সার্ভার ব্যবহারকারীর লেজার হালনাগাদ করে দেয়। একটি লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন বিটকয়েন উৎপন্ন হয়। ২১৪০ সাল পর্যন্ত নতুন সৃষ্ট বিটকয়েনগুলো চার বছর পর পর অর্ধেকে নেমে আসবে। ২১৪০ সালের পর ২১ মিলিয়ন বিটকয়েন তৈরি হয়ে গেলে আর কোনো নতুন বিটকয়েন তৈরি করা হবে না।
বিটকয়েনের লানদেন হয় পিয়ার টু পিয়ার বা গ্রাহক থেকে গ্রাহকের কম্পিউটারে। এটি কোন কেন্দ্রীয় নিকাশঘরের মধ্য দিয়ে যায় না কিংবা এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান নেই। বিটকয়েনের সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় অনলাইনে একটি উন্মুক্ত সোর্স সফটওয়্যারের মাধ্যমে। বিটকয়েন মাইনারের মাধ্যমে যে কেউ বিটকয়েন উৎপন্ন করতে পারে। বিটকয়েন উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়াটা সবসময় অনুমানযোগ্য এবং সীমিত। বিটকয়েন উৎপন্ন হওয়ার সাথে সাথে এটি গ্রাহকের ডিজিটাল ওয়ালেটে সংরক্ষিত থাকে। এই সংরক্ষিত বিটকয়েন যদি গ্রাহক কর্তৃক অন্য কারও একাউন্টে পাঠানো হয় তাহলে এই লেনদেনের জন্য একটি স্বতন্ত্র ইলেক্ট্রনিক সিগনেচার তৈরি হয়ে যায়-যা অন্যান্য মাইনার কর্তৃক নিরীক্ষিত হয় এবং নেটওয়ার্কের মধ্যে গোপন অথচ সুরক্ষিতভাবে সংরক্ষিত হয়। একই সাথে গ্রাহকদের বর্তমান লেজার কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে হালনাগাদ হয়। বিটকয়েন দিয়ে কোন পণ্য কেনা হলে তা বিক্রেতার একাউন্টে পাঠানো হয় এবং বিক্রেতা পরবর্তীতে সেই বিটকয়েন দিয়ে পুনরায় পণ্য কিনতে পারেন। অপরদিকে সমান পরিমাণ বিটকয়েন ক্রেতার লেজার থেকে কমিয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেক চার বছর পর পর বিটকয়েনের মোট সংখ্যা পুনঃনির্ধারন করা হয় যাতে করে বাস্তব মুদ্রার সাথে সামঞ্জস্য রাখা যায়।
বিটকয়েন ডিজিটাল কারেন্সি হিসেবে ইতিমধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মুদ্রার বিপরীতে এর দর মারাত্মক ওঠানামা, দু®প্রাপ্যতা এবং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে সীমিত ব্যবহারের কারণে এটা নিয়ে নানা শঙ্কাও কাজ করে। তবে বিটকয়েনকে বিভিন্ন দেশ মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও বাণিজ্যিক মহাকাশ পর্যটক প্রতিষ্ঠান ভার্জিন গ্যালাক্টিকের ফ্লাইটের মূল্য হিসেবে তা ব্যবহার করা যাবে। স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন তার বাণিজ্যিক স্পেস ফ্লাইট ভার্জিন গ্যালাক্টিকের মূল্য পরিশোধে মুদ্রাটি ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে জার্মানিই বিটকয়েনকে ব্যক্তিগত মুদ্রা বা ‘প্রাইভেট কারেন্সি’ ঘোষণা করেছে। সানফ্রান্সিসকো, বার্লিন ও আর্জেন্টিনায় ব্যাপক জনপ্রিয় এ বিটকয়েন। সম্প্রতি কানাডার ভ্যানকুভারে বিটকয়েনের প্রথম এটিএম মেশিন চালু হয়। ধারণা করা হচ্ছে মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এটি বিটকয়েনকে আরও এগিয়ে নেবে। অন্যদিকে মাদক, চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা ও অন্যান্য বেআইনি ব্যবহার ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সরকার বিটকয়েন গ্রাহকদের নিবন্ধনের আওতায় আনার চিন্তাভাবনা করছে। ২০০৯ সালের শুরুতে ভার্চুয়াল এ মুদ্রার ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল প্রযুক্তিপাগলদের মধ্যে। হঠাৎ করে চলতি বছরের ফেব্র“য়ারির পর থেকে মুদ্রাটির দাম ১০ গুণ বেড়ে যায়। তাতে এ মুদ্রাব্যবস্থার দিকে নজর দিতে বাধ্য হন নিয়ন্ত্রক, বিনিয়োগকারী ও সাধারণ জনগণ।
বিভিন্ন ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতির মাধ্যমে বিটকয়েন একটি বিকল্প মুদ্রার যোগ্যতা অর্জন করেছে। অ্যামাজনের মতো শীর্ষ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানও বিটকয়েনে তাদের পণ্যের মূল্য পরিশোধের সুযোগ করে দিয়েছে। অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি অনেক অ-অনলাইন প্রতিষ্ঠানও বিটকয়েন মেনে নিয়েছে। বর্তমানে বিটকয়েনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যেভাবে কথাবার্তা হচ্ছে, তাতে তারাই হতাশ হচ্ছেন, যারা ভেবেছিলেন কোনো অবস্থাতেই বিটকয়েন কোনো ধরনের পর্যবেক্ষণ বা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে না। কিন্তু বিশ্বের বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে। তাদের মতে, একটি পরিষ্কার আইনি সংজ্ঞায়ন বিটকয়েনের চলার পথকে আরও মসৃণ করবে। এ মুদ্রাসংশ্লিষ্ট আইনগুলো যত দ্রুত পরিষ্কার হবে, ততই ভালো হবে। এটা ঠিক, অনলাইন ‘কালোবাজার’ হিসেবে পরিচিত ‘সিল্ক রোড ওয়েবসাইট’ বন্ধের সময় সেখানে লেনদেনে ব্যবহৃত বিটকয়েন বিশেষজ্ঞদের নজরে আসে। ইতিমধ্যে সিল্ক রোডের ঘটনায় বিটকয়েন আইনি ব্যবস্থার দিক থেকেও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা এটা জোর গলায় দাবি করছেন, যদি প্রশ্ন করা হয়, বিটকয়েন প্রযুক্তি কি আগামীদিনের লেনদেনের সর্বোত্তম মাধ্যম, তাহলে উত্তরটি হবে ‘হ্যাঁ’। আর যদি প্রশ্ন করা হয়, লেনদেনের ভবিষ্যৎ কি বিটকয়েনের ওপর নির্ভর করবে? উত্তরটি হবে ‘না
লেখক : আমাদের মানচিত্র`র প্রধান সম্পাদক