পর্ব-৩
ফাঁস
হাসনাত হারুন
প্রকাশিত : ০৩:২৫ পিএম, ৪ এপ্রিল ২০১৮ বুধবার
বিশিষ্ট শিক্ষাবীদ ও লেখক অধ্যাপক হাসনাত হারুন রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস `ফাঁস`। উপন্যাসটি ধারবাহিকভাবে প্রকাশ করছে ইটিভি অনলাইন। আজ প্রকাশিত হচ্ছে তৃতীয় পর্ব-
সবুজের বাবা ছিল সামান্য একজন সরকারে চাকুরে।উদার প্রকৃতি, নীতিবান আর্দশবাদি, সৎ চরিত্রের মানুষ ।কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখা সম্ভব হয় নি । তবু বই পড়ার প্রতি আছে একটা তীব্র নেশা।সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, দেশি বিদেশী লেখকদের নানা বই ।বেতনের এক চতুর্থাংশ টাকা ব্যয় করেছে এই বই কেনার পেছনে । অর্থ বিত্তের অভাব আছে, কিন্তু মনের দীনতা বলতে কিছু নেই ।
এখন অবসরে আছে । তবু দীর্ঘবছর ধরে মেনে চলা রুটিনের কোন ব্যতিক্রম করে না ।ভোরের আযান হলে মসজিদে যায় । নামাজ শেষ করে মিনিট বিশেক, এদিক ওদিক ঘুরে, ভোরের আলো বাতাসে নিজেকে সতেজ করে নেয় ।ঘরে ফিরে একমুঠো মুড়ি, কখনো আবার একটুকরো বিস্কিট দিয়ে এক কাপ চা খেয়ে নেয় । আবারো অজু করে কোরান শরীফটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে । ‘ফাবি আইয়্যে আলায়ে রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান’ ।
আটটায় তিনটে রুটি, সবজী ও এক কাপ চা খেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে পুকুর পাড়ের বাঁশঝাড়ের তলায় এসে বসে । হাতে থাকে একটি বই । বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে জোহরের ওয়াক্ত হয়ে আসে ।গোসল নামাজ খাওয়া শেষ করে আধঘন্টা সময় বিছানায় গড়াগড়ি ।
সবুজের মা ঘর সংসারের নানা অভিযোগ নিয়ে কোন কথা বলতে আসলে, মুখ চিবিয়ে হাসে ।বলে, ঘর গৃহস্তালী থাকলে অভাব থাকবে । এজন্য তো এর নাম সংসার ।কখনো আবার অপন মনে বলে ওঠে,হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান ।
সংসারে তিন ছেলে দুই মেয়ে । বড় ছেলে বিএ পাশ করে, একটা সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে । মেজটা আই এ পাশ । বছর তিনেক একটা পোশাক কোম্পানিতে চাকরি করেছে ।এখন কোন কাজ কর্ম করে না । রাস্তার মোড়ে, দোকানে বসে দেশ উদ্ধারের প্রয়োজনে, দিনরাত রাজা উজির মারে । দুটি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে, ভাল পরিবারে ।মেয়ে দুটি সুখে আছে ।
ছোট ছেলে সবুজ । ছাত্র হিসেবে বেশ মেধাবী ।পরিবারের নানা অভাব অনটন থাকা সত্বেও নিজ সাধনা বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিটা হাতে নিয়ে এসেছে ।
সবুজের বাবা তার ছেলে মেয়েদেরকে সব সময় শেখাতে চেষ্টা করেছে জীবনের উদ্দেশ্য কি, সৌর্ন্দয, মাহাত্ম্য কোথায় ।
স্কুল কলেজ জীবনে সবুজ তার বাবার এই দর্শনকে সম্মানের সাথে সমীহ করে চলেছে ।বন্ধু বান্ধবের সাথে কথা বলার সময় বাবার উদাহরণ টেনেছে ।বাবার ধ্যান ধারনা ও বিশ্বাসকে নিয়ে সবুজ সেই সময়ে অহংকারও করেছে ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য সবুজকে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে হয় । বড়লোক বাবার ছেলে মেয়েদের সাথে মেলামেশা করতে গিয়ে একটা নিরেট সত্যি সবুজের উপলদ্ধিতে এসেছে, জীবনে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হলে নীতিবাক্যের ফুলঝুড়ি দিয়ে জীবন সাজানো চলবে না ।জীবন চলে টাকার স্রোতে, টাকায় জীবনে গতি আনে, সুখ আনে, সৌর্ন্দয আনে, জীবনকে করে অর্থবহ, সার্থক । টাকাহীন জীবন বদ্ধ জলাশয়, জঙ্গম স্থবির ।
সবুজের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হয় ।তার চোখে স্বপ্ন ভাসে, একদিন সে অনেক অনেক বড়লোক হবে । শহরে বাড়ি হবে, গাড়ি হবে, সুন্দরী বউ হবে ।তবে তার জীবন চলবে সহজ সরল রেখায় । আধুনিকতার ছল করে কোন অশ্লীল উগ্রতায় জড়িয়ে নিজের অতীতকে বিসর্জন দেবে না ।হাজার বছর ধরে তার রক্তে বহমান পুর্ব পুরুষের ঐতিহ্য-সংস্কার বা বিশ্বাসকে ও সে কখনো অবহেলা অসম্মান করবে না ।
সবুজ গ্রামের ছেলে, জীবন হবে তার সবুজ প্রকৃতির মতো পেলব সুন্দর, মসৃণ । তবে তার বাবার মতো টানটান জীবন নয় । তার অর্থ থাকবে ।দুই হাতে মুঠোভরে সে টাকা খরচ করবে । তার ভবিষ্যত বংশধরদেরকে অভাব শব্দটার সাথে কখনো পরিচয় করিয়ে দেবে না ।
গ্রামের বাড়িতেও সে একটা সুন্দর ঘর করবে । এই স্বপ্ন তার সেই শিশু-শৈশবকাল থেকে তার মনের ভেতর সুপ্ত হয়ে আছে । গ্রামের বাড়িতে শহরের মতো করে সুন্দর ঘর করবে । মা বাবাও তার সাথে থাকবে । মা বাবার জন্য দক্ষিণ দিকে থাকবে একটি বড়সড় ঘর । দক্ষিনের খোলা হাওয়ায়, সুখে আনন্দে কেটে যাবে, তাদের শেষ দিনগুলো ।
ইট সিমেন্টের পাকা ঘর হলেও সবুজ গ্রামীন সৌর্ন্দযকে হণন করবে না । সবুজের বাড়ি হবে সবুজে সবুজে সবুজময় ।
বাড়ির চারপাশ ঘিরে থাকবে সুপারি গাছ । গাছগুলো বড় হয়ে ছাদ পযন্ত ওঠে যাবে ।ছাদের ওপর বসে সবুজ চারপাশের সবুজকে তার বুকের গভীরে টেনে নেবে । আকাশের ভাসমান মেঘমালা দেখবে, দেখবে নীল সামিয়ানায় তলে তারাকা রাজির মিটিমিটি লুকোচুরি খেলা ।জোছনায় নিজেকে ভাসিয়ে নেবে দুর দেশের অজানা সৌন্দযে । রবি ঠাকুরের গান শুনবে । নজরুলের কবিতা পড়বে । “ তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না ।”
এসব সে জেগে জেগে ভাবে ।রাতের ঘুমেও সেইসব ভাবনা স্বপ্ন হয়ে তার মনে ভাসে ।
সবুজ তার শিক্ষকদের মুখে শুনেছে, মনীষিদের জীবনীপাঠে জেনেছে, জীবনের সুখস্বপ্ন সত্যি হয়, মেধা শ্রম আর সাধনার বলে । সবুজ মেধাবী, প্রতিটি সার্টিফিকেট পরীক্ষায় সে তার মেধার যোগ্যতা দিয়েছে ।সবুজ পরিশ্রম আর সাধনা ছিল বলেই তো সে আজ তার চারপাশের লোকজনের কাছে সবুজ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে ।
কিন্তু সবুজ কর্মজীবন, কি করবে, কোথা থেকে কিভাবে শুরু করবে । ভাবনার শেষ থাকে না, কিন্তু কোন সিদ্বান্তেই সবুজ স্থির হতে পারে না ।সবচেয়ে বড় সম্যসা-সংকট অর্থের । বহু দিন মাস নানা ভাবনায়, হেলাফেলায় সে শেষ করে । তার পর মধ্যবিত্তের শেষ ভরষার স্থল চাকরি বাজারে যাতায়াত শুরু করে । একটা চাকরির জন্য সে নানা জায়গায় তার পরিচয় ও যোগ্যতার সার্টিফিকেট জমা করে ।
সবুজ চাকরির জন্য এদিক ওদিক হন্য হয়ে চরকী ঘোরা ঘুরে । চাকরি হয় না, কিন্তু, কেন চাকরি হয় না, তার উত্তরও সবুজের জানা হয় না । বছর খানেক পরে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ছোটমাপের একটি চাকরি পাওয়া যায়, তাও নিজের যোগ্যতায় নয়, প্রতিষ্ঠানের বড় সাহেব তার এক নিকটতম বন্ধুর কাকা । বন্ধুর অনুরোধে সবুজকে চাকরিটা পাইয়ে দেয় ।
সবুজের জীবনের সব সুন্দর ইতিবাচক ভাবনাগুলো নেতিয়ে পড়ে । ভাঁটার স্রোতে ভাসতে ভাসতে তার জীবনের জোরালো নীতি-আর্দশগুলোতে গুণেপোকা বাসা বাঁধতে শুরু করে ।
সবুজ নব বিশ্বাসে স্থিত হয়, জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে, মেধা শ্রম সাধনা কিছুই নয়, দরকার ক্ষমতাবান আত্মীয়ের । সামনে এবং পেছনে ডাল তলোয়ার হাতে নিয়ে যারা তার জীবন চলার পথকে করে দেবে মসৃণ, ঝেড়ে মুছে লক্ষ্যে পৌঁছার সিঁড়িগুলোকে করে দেবে ঝকঝকে তকতকে । কেউ একজন হাত ধরে সামনে টেনে নিয়ে যাবে, অন্য একজন পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে তাকে ওপরের দিকে তুলে নিয়ে যাবে ।সবুজ অস্থির হয়ে ভাবে, কেউ একজন, যে আমার সামনে শক্ত হাতে মই ধরে রাখবে, আমি তার ওপর বিশ্বাস করে, নিজেকে সম্পূর্ণরুপে সপে দিয়ে তরতর করে ওপরে ওঠে যাব । কিন্তু, কে সেই, কে ।
অস্থির সব নানা ভাবনায় সবুজ সারাক্ষণ কাটা ঘুড়ির মতো শুন্যে ঘুরপাক খেতে থাকে ।
আলো আঁধারীর ভাবনাকাশে হঠাৎ করে উঁকি দেয়, যদি কোন বড়লোক বাবার অর্থব মেয়ের গলায় ঝুলে যেতে পারা যায়, তাহলে ও হয়তো জীবনের স্বপ্নগুলো সত্যি হয়ে জ্বলে ওঠবে ।
সবুজ তার বন্ধুসম খালাতো ভাইয়ের্ সহযোগিতায় পেয়ে যায় সেই স্বপ্ন পূরণের চাবিকাঠি । চিত্রাই সেই চাবি, যে তাকে পেছন থেকে ঠেলবে, আর তার ব্যবসায়ী শ্বশুর বাবা তাকে সামনে থেকে টেনে নিয়ে যাবে ।
চিত্রার সাথে সবুজের বিয়ে হয় । বিয়ের অনুষ্ঠানে সবুজ বুঝতে পারে, কত বড় ঘরের মেয়েকে সে তার জীবন সঙ্গীনি করে নিয়েছে ।বিয়েতে আগত অতিথিদের পোশাক, বেশভূষা, পরিচয়, জীবন বৃত্তান্ত শুনে দেখে সবুজ বুঝতে পারে, তার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব ।একই অনুষ্ঠানে দুই দুইটি বিয়ে । চিত্রার আর চিত্রার ছোটবোন চয়নার । চিত্রার মা বাবা পুলিশ জামাইকে স্বীকার করে নিয়ে নব সাজে বরণ করে নিয়েছে ।
(চলবে)
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ কুমিল্লা ও রংপুর ক্যাডেট কলেজ।
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব পড়তে
/ এআর/