এলডিসি থেকে উত্তরণ
উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে: নিয়াজ আহমেদ
প্রকাশিত : ০১:১১ পিএম, ৬ এপ্রিল ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:৪৯ পিএম, ৭ এপ্রিল ২০১৮ শনিবার
নিয়াজ আহমেদ খান
নিয়াজ আহমেদ খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান। তিনি ব্রাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্টের একাডেমিক ফেলো। সম্প্রতি স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলের কাতারে বাংলাদেশের উত্তরণ, বিশাল এ অর্জনের পেছনে চ্যালেঞ্জ ও তা মোকাবেলার উপায়, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট, বেকারত্ব, কর্মসংস্থান, শিক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষাক্ষেত্রে বাণিজ্য, কোটা পদ্ধতি ও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমাসহ নানা বিষয় নিয়ে একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় তার। তার কথায় উঠে এসেছে সল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনের চ্যালেঞ্জ ও তা মোকাবেলার উপায়। উঠে এসেছে প্রশ্নফাঁস, কোচিং বাণিজ্য, কোটা পদ্ধতির সংস্কার, শিক্ষার্থীদের চাকরির সমস্যাসহ শিক্ষাব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি-গলদ ও তা থেকে বেরিয়ে আসার পন্থা। নিয়াজ আহমেদ খান মনে করেন, আমাদের সামনে এখনও ২০২১ ও ২০২৪ সালের দুটি মাইলস্টোন আছে। তবে এটাতে কোন সন্দেহ নেই যে আমরা একটা আনন্দের যাত্রা শুরু করেছি। কিন্তু এটা নিয়ে এখনই আমাদের খুব বেশি আপ্লুত হওয়ার সময় আসেনি। এটা আমাদের জাতীয় অর্জন হিসেবেই নিতে পারি। কিন্তু সেই একইভাবে এটাকে সাবধনতার সঙ্গে নিতে হবে। সে অনুযায়ী উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। বেশি আবেগে যেন আমরা ভেসে না যাই। সেটা খেয়াল রাখতে হবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব তুলে ধরা হলো-
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হয়েছে। এখন বাংলাদেশকে ছয় বছর পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। পর্যবেক্ষণে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেতে গিয়ে আমাদের কী ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা লাগতে পারে? এবং তা মোকাবেলায় আমাদের করণীয়টায় বা কী হতে পারে?
নিয়াজ আহমেদ: আমাদের সামনে এখনও ২০২১ ও ২০২৪ সালের দুটি মাইলস্টোন আছে। তবে এটাতে কোন সন্দেহ নেই যে আমরা একটা আনন্দের যাত্রা শুরু করেছি। কিন্তু এটা নিয়ে এখনই আমাদের খুব বেশি আপ্লুত হওয়ার সময় আসেনি। এটা আমাদের জাতীয় অর্জন হিসেবেই নিতে পারি। কিন্তু সেই একইভাবে এটাকে সাবধনতার সঙ্গে নিতে হবে। বেশি আবেগে যেন আমরা ভেসে না যাই। সেটা খেয়াল রাখতে হবে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ ২৪ সাল পর্যন্ত কঠিন পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়েই আমাদের যেতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে এটার একটা পরম্পরা আছে। এটা ১৯৭৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে। জাতিসংঘ কঠিন পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়েই আমাদের এ ঘোষণা দিয়েছে। সামনে আরও পর্যবেক্ষণ আসছে।
সেজন্য এটা ধরে রাখতে বা অর্জনে আমাদের সামনে মোটা দাগে কয়েকটা চ্যালেঞ্জ আছে। একটা হচ্ছে আমাদের অবকাঠামো নেই। অবকাঠামোর আবার দুইটি দিক। এর একটি হচ্ছে আমাদের ফিজিক্যাল ইনফ্রাস্টাকচার বা ভৌত অবকাঠামো। আমাদের রাস্তাঘাট হচ্ছে, ব্রিজ হচ্ছে। কিন্তু এর কোনটাই আমরা সঠিক ও নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে পারছি না। যেমন ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ের ক্ষেত্রে আমরা আট দফা সময় বাড়িয়েছি। অর্থাৎ আমাদের সময় এবং উৎপাদন দক্ষতা নেই। নির্দিষ্ট খরচের চেয়েও বেশি খরচ করছি কাজের শেষ নামাতে। তার মানে খরচের ক্ষেত্রেও দক্ষতা দেখাতে পারছি না।
দ্বিতীয় হচ্ছে আমাদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য। এই ক্ষেত্রে আমাদের আশার কথা হচ্ছে কোন কোন শাখাতে আমরা ভারতের চেয়েও ভালো করেছি। এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে আমাদের অগ্রগতি ভালো। কিন্তু এখনও এটি আশ্বস্থ হওয়ার মতো ভালো জায়গাতে যায়নি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে দেশের একটি বড় অংশ এখনও নূন্যতম স্বাস্থসেবা থেকে বঞ্ছিত। পিছিয়ে পড়া চর এলাকাগুলোতে স্বাস্থসেবা অনেক পিছিয়ে।
এছাড়া ব্যবসা ও রফতানি বাণিজ্যেও আমাদের বড় রকমের দূর্বলতা আছে। আমরা পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে একমুখী হয়ে পড়েছি। রফতানির শতকরা ৮০ ভাগ গার্মেন্টস শিল্পের দখলে। এখানে কোন কারণে যদি গার্মেন্টস খাতে ধ্স নামে তো আমাদের রফতানি আয় শূন্যের কোঠায় উঠবে। যা একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুবই হুমকি। এছাড়া আমাদের আমদানি-রফতানিতে কোন ভারসাম্য নেই। আমরা যে পরিমান আমদানি করি আর যে পরিমান রফতানি করি এর মধ্যে ন্যূনতম কোন ভারসাম্য নেই। এর কারণে আমরা কিছু কিছু দেশের ওপর মারাত্মকভাবে নির্ভর্শীল হয়ে পড়েছি।
আমাদের কিছু আ্ইনে এখনও ব্রিটিশ ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। এ আইনগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপেন টু ইন্টারপ্রিটিশন বা ব্যাখ্যা নির্ভর। স্পষ্টতা রাখা হয়নি। আইনটি ব্যাখ্যা নির্ভর বা অস্পষ্ট থাকার কারণে ইচ্ছা করলে এ আইন দিয়ে কাউকে বাঁচানোও যাচ্ছে আবার কাউকে মেরে ফেলাও যাচ্ছে। এসব আইনে স্পষ্টতা আনতে হবে। একই আইন দিয়ে হয়রানি করা যাচ্ছে। আবার একই আইন দিয়ে স্বস্তিও দেওয়া যাচ্ছে। এ কারণে আমাদের আইনগত একটা বড় ধরণের রিফরম লাগবে। যা করলে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে টেকসই স্বীকৃতি পাবো।
পরিকল্পিতভাবে কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য আমাদের কোনো শিল্পায়ন হয়নি। আমাদের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে ছেলেমেয়েদের কাজে লাগাতে পারিনি। আমাদের কৃষক, পোশাক শ্রমিক আর সেবাদাতাদের ওপর নির্ভর করেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি। আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্ত কর্মসংস্থান সে হারে হচ্ছে না। এ বৈপরিত্বও উন্নয়নশীর দেশের জন্য হুমকি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এতোদিন স্বল্পোন্নত দেশ থাকার কারণে আমরা বিশ্বের অনেক দেশ থেকে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছিলাম। এখন কি সে সুযোগগুলো থাকবে কী না?
নিয়াজ আহমেদ: স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমরা কিছু কিছু দেশে বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা পেতাম। সেই সুবিধাগুলো এখন হয়তো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে। অথবা সে সুবিধাগুলো পেতে হলে আমাদের নতুন কিছু শর্ত দেওয়া হবে। যা পালনের মাধ্যমে আমাদের সুবিধাগুলো নিতে হবে। এ সুযোগগুলো হারালে সিপিডির হিসেব অনুযায়ী আমাদের ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় কমতে পারে। তবে সার্বিকভাবে আমি বলবো আমরা যদি আমাদের উন্নয়নের গতি ধরে রাখতে পারি বা আরো একটু গতি বাড়াতে পারি আগামী ২০২৪ সালে আমরা টার্গেট পূরণ করতে পারবো।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: জনসংখ্যার বোনাস যুগ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) অতিবাহিত করছে দেশ। এ সুযোগ বাংলাদেশ কতটা কাজে লাগাতে পারছে বলে আপনি মনে করেন?
নিয়াজ আহমেদ: আমাদের বেশিদিন এ সুযোগ থাকবে না। আগামী ২০৫০-৫২ সালে এটা শেষ হয়ে যাবে। আমাদের শিক্ষা এ সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য উপযুক্ত না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দক্ষতা মাপার পদ্ধতিটাই ঠিক না। আমি সার্টিফিকেট পাচ্ছি, পাশ করে যাচ্ছি। কিন্তু যখন আমাকে বলা হচ্ছে তুমি্ একটি ইমেইল লিখ। তখন কিন্তু পারছি না। প্রাইভেট সেক্টরেও বিনিয়োগ ছাড়া তো এদের চাকরি দেওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় দক্ষতা মাপার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। সেক্টরের চাহিদা অনুযায়ী ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা দিতে হবে। সেই খাতগুলোতে তাদের কাজের দক্ষতা দেখেই তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। তবেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টকে আমরা কাজে লাগাতে পারবো। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানে দক্ষ যুব সমাজ সরবরাহ করতে পারবো।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখেরও বেশি। বিবিএসের রিপোর্ট অনুযায়ী গত এক বছরে আরও ৮০ হাজার বেকার বেড়েছে। দেশের এই বিশাল জনশক্তিকে আমরা কেন কাজে লাগাতে পারছি না? মূল সমস্যা ও সমাধান কোথায়? কেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ডিগ্রি নেওয়ার পরও চাকরি মিলছে না?
নিয়াজ আহমেদ: এছাড়া আমরা আমাদের মানবসম্পদকে পূর্ণ ব্যবহার করতে পরিনি। তার কারণ হচ্ছে যে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এ প্রজন্মকে গড়ে তুলছি সে শিক্ষা ব্যবস্থা কাজের জন্য উপযুক্ত না। ছেলেমেয়েদের কাজে লাগানোর জন্য জাতীয় পর্যায়ে কাজে লাগানোর জন্য যে পদক্ষেপ দরকরা তাও আমরা নিতে পারিনি। জাতি বা সমাজ হিসেবে আমরা তাদের সেটা দিচ্ছি না। ২২ লাখ শিক্ষিত বেকার। সেখানে দেড় লাখ চাকরিও আমরা দিতে পারছি না। যে শিক্ষাটা আমরা দিচ্ছি তাদের সেটাও নৈতিক ও সামাজিকভাবে অর্থপূর্ণ করে না। এদেরকে কাজে লাগানোর জন্য জাতীয়ভাবে যে পরিকল্পনা দরকার, যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সেটাও আমরা করতে পারছি না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের দেশে এতো শিক্ষিত যোগ্য লোক, অথচ পোশাক শিল্পসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় বিদেশি এক্সপার্টদের বেশি বেতনে আনা হচ্ছে। কেন আমরা সে জায়গাটা নিতে পারছি না?
নিয়াজ আহমেদ: আমরা প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজারিয়াল দায়িত্বগুলো বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। বিশেষভাবে গার্মেন্টসগুলোতে এ প্রবণতা আনেক বেশি। আমাদের ছেলেমেয়েগুলো দিনদিন বেকার হচ্ছে আর আমরা এ দায়িত্বগুলো দিচ্ছি বিদেশিদের হাতে। আমার ব্যক্তিগতভাবে কোন বিদেশের সঙ্গে বিরোধ নেই। তবে চিন্তার বিষয় হলো প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে বিদেশিদের বসানোর কারণে আমাদের তরুণরা বেকার থাকছে। সুতরাং ওইসব গুরুত্বপূর্ণ পদে বিদেশ নির্ভরতা কমাতে হবে। সেখানে আমাদের ছেলেমেয়েদের যোগ্য করে তুলতে হবে।
এসএইচ/