ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

থাইরয়েড ক্যান্সারের লক্ষণ-করণীয় ও প্রতিকার

বিএসএমএমইউর সহযোগী অধ্যাপক ডা. দেলোয়ার হোসেন

প্রকাশিত : ০৬:৫১ পিএম, ৬ এপ্রিল ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ১২:৩৫ পিএম, ৭ এপ্রিল ২০১৮ শনিবার

মানব শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ থাইরয়েড গ্রন্থি। শরীরের নানা হরমোন তৈরিতে এই গ্রন্থি কাজ করে থাকে। তবে থাইরয়েড কোন কারণে আক্রান্ত হলে শরীরে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। থাইরয়েডের অনেকগুলো রোগ আছে। এর মধ্যে থাইরয়েড ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ। থাইরয়েড আক্রান্ত হলে প্রাথমিকভাবে রোগীর তেমন কোন সমস্যা অনুভূত হয় না। দেখা যায় না বড় কোন লক্ষণও। তাই ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার অনেক পরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন । তখন অন্ত্রপাচার ছাড়া চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। এমনটিই জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রিনিউলোজি-হেড এন্ড নেক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. দেলোয়ার হোসেন।


সম্প্রতি একুশে টিভিকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একুশে টিভি-অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান।

একুশে টিভি অনলাইন : থাইরয়েড ক্যান্সার কি
ডা. দেলোয়ার হোসেন: থাইরয়েড একটি হরমোন গ্রন্থি। এটা গলার সামনে থাকে। থাইরয়েডের প্রধান কাজ শরীরে হরমোন তৈরি করা। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গে গঠনে সহযোগিতা করে থাইরয়েড। থাইরয়েড হরমোন দেহের প্রয়োজনের চেয়ে কম তৈরি হলে বলি হাইপো-থাইরয়েড এবং বেশি হলে বলি হাইপার থাইরয়েড রোগ।
এই থাইরয়েড গ্রন্থি যদি কোনো কারণে বড় হয়, আমরা তাকে গলগণ্ড বলি। এটি গ্রাম এলাকার মানুষের বেশি হয়। যেসকল এলাকায় আয়োডিন কম থাকে, সেসব এলাকায় গলগণ্ড রোগ বেশি দেখা দেয়। নিয়মিত সামুদ্রিক মাছ খেলে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়। থাইরয়েড গ্রন্থির কোনো অংশে টিউমারের মতো ফুলে উঠলে বলা হয় থাইরয়েড নোডিউল। এসব থাইরয়েড নোডিউলের ১ শতাংশ থেকে থাইরয়েড ক্যান্সার হতে পারে। থাইরয়েড গ্রন্থির কোনো অংশের কোষসংখ্যা অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেলে তাকে থাইরয়েড ক্যান্সার বলে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থি বা এর অংশবিশেষ ফুলে ওঠা মানেই কিন্তু ক্যান্সার নয়।

একুশে টিভি অনলাইন : থাইরয়েড ক্যান্সার আক্রান্তের লক্ষণগুলো কি কি।
ডা. দেলোয়ার হোসেন: গলার সম্মুখভাগে ফুলে ওঠে, ফোলা অংশটা বেশ শক্ত হয়। একটি বা একাধিক টিউমার হতে পারে, উভয় পাশে টিউমার হতে পারে ও আশপাশের লিম্ফ নোডগুলো ফুলে উঠতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যথা হতে পারে এবং স্থানটা লাল হতে পারে। এর ভেতরে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এ ছাড়া ওজন কমে যায়, খাওয়ার রুচি কমে যেতে পারে এবং কোনো কিছু খেতে বা ঢোক গিলতে অসুবিধা হয়। কাশি হতে পারে, গলার ভেতরে চুলকাতে পারে। গলার স্বর পরিবর্তন হতে পারে। গলার স্বর মোটা বা ফ্যাসফেসে হতে পারে। তবে থাইরয়েড নোডিউল বা ক্যান্সার ছাড়াও গলার সামনে ফুলে উঠতে পারে। শ্বাসনালির ওপর চাপ সৃষ্টির ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। উক্ত লক্ষণগুলো মূলত থাকলে আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করি রোগী থাইরয়েড আক্রান্ত। তবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর আমরা জানতে পারি কোন ধরণের থাইরয়েড আক্রান্ত।

একুশে টিভি অনলাইন: থাইরয়েড ক্যান্সার কত ধরণের হয়ে থাকে?
ডা. দেলোয়ার হোসেন: সাধারণত দুই ধরণের সমস্যা দেখা যায়, গঠনগত ও কার্যগত। গঠনগত সমস্যায় থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যায় যেটাকে গয়টার বল হয়। কার্যগত সমস্যা দুই রকমের হয়ে থাকে তা হল হাইপারথাইরয়ডিজম ও হাইপোথাইরয়ডিজম। হাইপারথাইরয়ডিজমে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড বেশি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে পড়ে ও হাইপোথাইরয়ডিজমে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড কাজ করেনা। থাইরয়েড সমস্যা হওয়ার কারণ ১। হাইপোথাইরয়ডিজম মূলত তিনটি কারণে দেখা যায়। নবজাতক শিশুদের মধ্যে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড তৈরি না হলে কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়ডিজম দেখা যায়। এছাড়া অটোইমিউন হাইপোথাইরয়ডিজম দেখা যায়। থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি সক্রিয় হলে হাইপোথাইরয়ডিজম নষ্ট হয়ে যায়। তখন থাইরয়েড গ্ল্যান্ড কাজ করেনা। চিকিৎসাজনিত কারণেও এই অসুখ হতে পারে। অপারেশনের কারণে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড বাদ দিতে হলে বা অন্য কারণেও থাইরয়েড ক্যান্সার হতে পারে।

একুশে টিভি অনলাইন: কোন বয়সের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকি থাকে?
ডা.দেলোয়ার হোসেন: থাইরয়েড ক্যান্সার মূলত দুই ধরণের হয়ে থাকে। এক অল্প বয়সে হতে পারে আবার শেষ বয়সেও হতে পারে। বয়স্ক অবস্থায় থাইরয়েড আক্রান্ত হলে এর অবস্থা খুব খারাপ হয়। বেশি বয়সের রোগী আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সর্তকতার সঙ্গে অস্ত্রপাচার করার পরামর্শ দিয়ে থাকি। আর যদি মধ্যে বয়স অবস্থায় কারো থাইরয়েড আক্রান্ত হয় তাহলে আমরা অস্ত্রপাচারে সময় অর্ধক রেখে দিই।

একুশে টিভি অনলাইন: থাইরয়েড আক্রান্ত ব্যক্তিকে কি কি পরীক্ষা করে থাকেন?
ডা.দেলোয়ার হোসেন: রোগীকে সম্পূর্ণ মূল্যায়নের জন্য এফটিথ্রি, এফপিফোর, টিএসএইচ, থাইরয়েড গ্রন্থির আল্ট্রাসনোগ্রাম, এফএনএসি ও থাইরয়েড বায়োপসি করার পরামর্শ দিয়ে থাকি। কিছু ক্ষেত্রে থাইরয়েড স্ক্যান করার প্রয়োজন হতে পারে। থাইরয়েড স্ক্যান করার পর যদি কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেডিও আয়োডিন বেশি জমে, তবে এটাকে বলে হট নোডিউল। যদি রেডিও আয়োডিন অন্যান্য স্বাভাবিক এলাকার চেয়েও কম জমা হয়, তবে এটা কোল্ড নোডিউল। এসব কোল্ড নোডিউলগুলোতেই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

একুশে টিভি অনলাইন: কি কারণে থাইরয়েড হয়ে থাকে?
ডা. দেলোয়ার হোসেন: সাধারণরত বিভিন্ন অদৃশ্য তেজষ্ক্রিয়তা বা রেডিয়েশন, রেডিও টেলিভিশন টাওয়ারের অস্বাভাবিক পরিমাণ মাইক্রোওয়েভ জন্য থাইরয়েড ক্যান্সার হতে পারে। গলা বা থাইরয়েডের ওপর রেডিয়েশন দিলে বা পড়লে এই ক্যান্সার দেখা দিতে পারে। কখনো অন্য স্থান থেকে ক্যান্সার সেল এসেও থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত করতে পারে। আবার জীবনধারার স্বাভাবিক গতিতেও এই ক্যান্সার দেখা দিতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্সারপ্রবণতাও বাড়ে। তবে যেকোনো বয়সেই এ রোগ হতে পারে। সাধারণত পুরুষরাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।

একুশে টিভি অনলাইন: এই রোগের চিকিৎসা বা প্রতিকার কি?
ডা. দেলোয়ার হোসেন : থাইরয়েড ক্যান্সার এমন একটি রোগ, যা সময়মতো চিকিৎসা করলে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা যায়। গলার সামনে ফুলে উঠলে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি একজন ডাক্তার দেখানো উচিত। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন এটা কোন ধরণের রোগ। ক্যান্সার শনাক্ত হলে বা ক্যান্সার আছে এমন সন্দেহ হলে অতিদ্রুত নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ বা গলার অপারেশনে পারদর্শী কোনো সার্জনের কাছে যেতে হবে। থাইরয়েড ক্যান্সারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হচ্ছে অপারেশন বা সার্জারি করা। আক্রান্তের ধরনের ওপর নির্ভর করবে থাইরয়েড গ্রন্থির কতটুকু কাটতে হবে। অনেক সময় পুরো থাইরয়েড গ্রন্থি কেটে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে। একে বলে টোটাল থাইরয়েডেকটমি। অপারেশন করে আক্রান্ত অংশ ফেলে দেওয়ার পর সেখানে আর কোনো ক্যান্সার সেল যেন না থাকে তার জন্য রেডিও আয়োডিন থেরাপি বা কখনো কখনো রেডিওথেরাপি দেওয়া লাগতে পারে। এরপর কোনো কোনো রোগীকে আজীবন থাইরয়েড হরমোন সেবন করতে হতে পারে। লেভোথাইরক্সিন দিয়েও অনেক সময় এর চিকিৎসা করা হয়। অনেক সময় টিএসএইচ হরমোন নোডিউল বা টিউমারের বৃদ্ধিতে উত্তেজক পদার্থ হিসেবে কাজ করে। তাই এই হরমোনের পরিমাণ কমাতে পারলে টিউমার বা ক্যান্সারের আকার আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যায়। মনে রাখা ভালো যে এই থাইরয়েড হরমোন সেবন করা দরকার শুধু হরমোনের ঘাটতি পূরণের জন্য নয়—এটা ভবিষ্যতে থাইরয়েড ক্যান্সার হওয়া থেকেও বাঁচায়।

একুশে টিভি অনলাইন: থাইরয়েড অস্ত্রোপচারে কেমন খরচ হয় এবং কোন জায়গায় সব চেয়ে ভাল চিকিৎসা পাওয়া যায়?
ডা. দেলোয়ার হোসেন: থাইরয়েড অস্ত্রোপাচারে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় অস্ত্রোপচার করলে করলে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। এবং বাহিরে কোন প্রাইভেট হাসপাতালে করলে ৫০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। বিভাগীয় শহরে এর এখন ভাল চিকিংসা হচ্ছে। তবে থাইরয়েড অস্ত্রপাচার অনেক সর্তকতার সঙ্গে করতে হয়। এবিষয়ে যারা সবচেয়ে প্রবীণ ও অভিজ্ঞ তাদের দিয়ে অস্ত্রপাচার করাই ভাল।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: একুশে টেলিভিশনকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
ডা. দেলোয়ার হোসেন: একুশে টেলিভিশনকেও ধন্যবাদ।

অনুলিখন: তবিবুর রহমান/ এমজে