রাজধানীকে স্থানান্তর করতেই হবে
প্রকাশিত : ১০:২১ পিএম, ৬ এপ্রিল ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ১০:৩১ পিএম, ৬ এপ্রিল ২০১৮ শুক্রবার
নগরজীবনকে গতিশীল করতে রাজধানী স্থানান্তর ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। কারণ, বিনিয়োগবান্ধব রাজধানী হিসেবে যেসব পূর্বশর্ত রাজধানী ঢাকার থাকা দরকার তার কোনটিই এখন অবশিষ্ট নেই। স্মার্ট সিটি হিসেবেও ঢাকা পুরোপুরি অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আর দীর্ঘদিন ধরে অপরিকল্পিতভাবে ঢাকা শহর গড়ে উঠায়, বর্তমানে শহরটি বসবাসেরও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাই নগরজীবনের প্রাণচঞ্চলতা ফিরিয়ে আনতে শিগগিরই রাজধানী স্থানান্তর করা দরকার বলে মনে করেন নগর ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামছুল হক। আর সেই স্মার্ট সিটি হিসেবে পূর্বাচল হতে পারে নতুন রাজধানী। একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ঢাকা বর্তমানে কতটুকু রাজধানীর উপযোগী বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক শামছুল হক: বিশ্বের আধুনিক ও স্মার্ট সিটির মতো ঢাকায় নির্মাণযোগ্য কোনো ভূমি নেই। এখন সব ভরাট করেই নির্মাণ হচ্ছে। ভরাট করলে প্রকৃতি রাগ করে। আর আমাদের যোগাযোগের মেরুদন্ডগুলি এতো আঁকাবাঁকা বলার অপেক্ষা রাখেনা। মেট্রো, বিআরটিএ এগুলো কিন্তু বিনিয়োগবান্ধব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তার রিটার্ন পেতে হলে মেরুদন্ডগুলোকে সোজা হতে হবে। আর আমাদের খামার বাড়ীতে একটা মোড়, ফার্মগেটে একটা মোড়, দোয়েল চত্বরে একটা মোড়, তারপর শিক্ষাভবনের এখানে একটা মোড়, শিক্ষা ভবনের এখানে একটা মোড় দিতে দিতেই কিন্তু ফরেন মিনিস্ট্রির ওখানে একটা মোচড়। এগুলোকে কখনো ভাল অবকাঠামো বলা যায়না। একবিংশ শতাব্দীতে একটা রাজধানীর যে তারকা খচিত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা দরকার তার লেশমাত্র আমাদের নাই। গত পাঁচ ছয়শ বছর ধরে যে নগরী গড়ে উঠেছে তাতে পরিকল্পনার কোনো ছাপ নেই। বিশেষ করে যোগাযোগের যে ফাউন্ডেশনগুলো আছে তা খুব দুর্বল। দক্ষিণ দিকে আমাদের রাজধানী আর উত্তর দিকে আমাদের রেসিডেন্সিলায় এলাকা। আমাদের নদীগুলো মরে যাচ্ছে। পৃথিবীর সবগুলো উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। সেখানে আমরা নদীকে মেরে ফেলছি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: একটি অত্যাধুনিক ও স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, ঢাকা শহরকে কিভাবে সাজানো উচিত?
অধ্যাপক শামছুল হকঃ বিনিয়োগবান্ধব বসবাসযোগ্য নগরী হিসেবে একটি রাজধানী যেমন হওয়া দরকার তার সব কিছুই ঢাকায় অনুপস্থিত। পরিমাণগত বিষয় নয় বরং গুণগত দিক থেকে চিন্তা করতে গেলে আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা ভীষণ নাজুক। আমরা উন্নত বিশ্বে প্রবেশ করবো। কিন্তু সেটার জন্য আমাদের রাজধানী কতটুকু প্রস্তুত তা কিন্তু আমরা ভেবে দেখছি না। আমরা স্বপ্ন দেখছি সিঙ্গাপুর সিটির মতো শহর হবে আমাদের ঢাকা। স্বপ্ন দেখছি উন্নত বিশ্বের মতো স্মার্ট সিটি বানাবো। অবকাঠামোগত দিক থেকে হয়তো তা পারব। কিন্তু এর ট্রাফিক লোড আমরা নিতে পারছি কিনা, তা আমরা কেউ ভাবছি না। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত প্রায় ষাট থেকে সত্তর বছর আগে তাদের রাজধানী নয়া দিল্লীতে নিয়ে গেছে। পাকিস্তান তাদের রাজধানী করাচি থেকে ইসলামাবাদ নিয়ে এসেছে। মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার সবাই রাজধানী স্থানান্তর করেছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নতুন রাজধানীকে কিভাবে সাজানোর কথা বলছেন আপনি?
অধ্যাপক শামছুল হকঃ রাজধানীকে আধুনিক, গোছোনা ও যুগোপযুগী করে তুলার প্রথম শর্ত হলো ভূমি। রাজধানীর ভূমি হতে হবে ফ্ল্যাট ফিট। সেখানে কোনো জলাবদ্ধতা থাকবে না। পাশাপাশি চতুর্দিক থেকে মানুষের যোগাযোগের সুযোগ থাকবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ঢাকার দুর্ভাগ্য যে রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণ দিকেই সব যোগাযোগ ব্যবস্থা। পূর্ব পশ্চিমে সব নিম্নাঞ্চল। একটা স্টেডিয়ামে যেমন চতুর্দিক থেকে অনেক দর্শক আসার সুযোগ থাকে ও যাওয়ার সুযোগ থাকে রাজধানী সিটিও তেমন হওয়া দরকার। তাহলে জট লেগে যাওয়ার ভয় থাকবেনা। সিটির প্রাণকেন্দ্র থাকবে মাঝখানে। সবার জন্য সেই প্রাণকেন্দ্র সম দূরত্বে থাকতে হবে। আমাদের মতিঝিল দক্ষিণে আর উত্তর দিকে থেকে লোক আসা যাওয়া করবে তা কখনো ইকোনোমিকাল সিটির বৈশিষ্ট্য হতে পারেনা। অবশ্যই। যেখানে ঢাকা মরে যাচ্ছে সেখানে পাঁচটা স্কুল বানানো, দশটা হাসপাতাল বানানো কোন ধরনের উন্নয়ন? আমরা আমাদের খালগুলো মেরে ফেলেছি। খালগুলো জীবিত থাকলে হাতিরঝিলের মতো করে ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু করা যেতো। এতে নগর জীবনে যানবাহনের চাপ কমতো।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: মানুষ বাড়ছে। তাল মিলিয়ে বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা। ফলে রাস্তায় যানজট বাড়ছে। নতুন রাজধানীতেও কী একই সমস্যায় পড়তে হবেনা?
অধ্যাপক শামছুল হকঃ একটা নগর নির্ভর করে ভূমি ঘনত্বের উপর। আমাদের এখানে ভূমি ঘনত্ব বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেই। আমাদের এখানে ইচ্ছেমতো নিয়ম না মেনে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নিয়ম হচ্ছে, রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে পঞ্চাশটা একশতলা ভবন থাকবে। বাকি শহরটা থাকবে ফাঁকা। ফাঁকা মানে শহরের বাকি ভবনগুলো হবে দুই-তিন তলা বিশিষ্ট। এর ফলে জায়গা বাঁচবে। ফুটপাতগুলো হবে চওড়া। রাস্তাগুলো হবে প্রশস্ত। ফুটপাতগুলো এতো চওড়া হবে যেন মানুষ দু`কিলোমিটার হেঁটেই চলাচল করতে পারে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে ইচ্ছা করলেই যেখানে সেখানে ভবন নির্মাণ করা যায় না। এক জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো নির্মিত হওয়ায়, তাঁরা পায়ে হেঁটেই এক ভবন থেকে আরেক ভবনে যেতে পারেন। এতে করে সময় বাঁচে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: পরিচ্ছন্ন নগরের জন্য কোন ধরণের যানবাহন ব্যবস্থা দরকার?
অধ্যাপক শামছুল হকঃ মানুষ ক্লিন এন্ড গ্রিন সিটির কথার বলে। কিন্তু একটা নগরীকে ক্লিন ও গ্রিন করার জন্য সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে নগরীর যানবাহন ব্যবস্থাকে। এবং সেটা করতে গেলে গণপরিবহন ভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নাই। কারণ, গণপরিবহন অধিকসংখ্যক মানুষকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে পারে। এতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমে যায়। তাই, পরিবেশ দূষিত হয়না। মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী নানা ধরনের বাহন ব্যবহার করে। আমরা সাধারণত দেখি সেগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু স্মার্ট সিটিতে সেই প্রতিযোগিতা থাকবেনা। প্রত্যেকে প্রত্যেকের সহযোগী হবে। এক টিকেটে অনেকগুলো বাহনের যাত্রী হওয়া যাবে। আমাকে এক বিদেশী সাংবাদিক বলেছিলেন, " আপনাদের দেশে বিশৃংখলা বুঝার জন্য খুব বেশী গবেষণার দরকার নাই। রাস্তা ঘাটের অবস্থা দেখে বুঝা যায় কী পরিমাণ বিশৃংখলা সবার মধ্যে বিরাজ করে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: রাজধানী স্থানান্তরের ব্যপারে আপনি পূর্বাচলের নাম প্রস্তাব করছেন কেন?
অধ্যাপক শামছুল হকঃ একবিংশ শতাব্দীর রাজধানী হিসেবে তাল মিলিয়ে চলার জন্য পূর্বাচল সবদিক থেকে সেরা ছিল। কম জায়গার মধ্যে ভাইব্রেন্ট এ্যাক্টিভিটি করা যায়। অল্প পরিসরে অর্থনৈতিক জোন হিসেবে সমৃদ্ধ করার কথা ভাবলে পূর্বাচল সবচেয়ে ভাল ছিল। ৬ হাজার ৯০০ একরের একটি জায়গা, যেখানে পুত্রজায়া মাত্র ৭০০০ একর। মাহাতির যদি ওই পুত্রজায়ায় মাল্টিসিটি করতে পারে তাহলে পুর্বাচলেও ভাল রাজধানী হওয়া সম্ভব।
এমজে/