বর্ণিল শতবর্ষে শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়
সৈয়দ আবদাল আহমদ
প্রকাশিত : ০৯:৩৫ পিএম, ৮ এপ্রিল ২০১৮ রবিবার
গল্পটা আমার স্কুলের। সে এক বর্ণিল শতবর্ষের গল্প। বৃহত্তর সিলেটের অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়। আমার প্রাণের বিদ্যাপীঠ। গল্পটা এ বিদ্যাপীঠেরই। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর আজ শতবর্ষ পূর্ণ করেছে। এই ১০০ বছরে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়েছে এ স্কুল। মহাকালের হিসেবে এ সময় হয়ত তেমন কিছু নয়, তবুও অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলার যে ইতিহাস। তাও কালের নিরিখে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং প্রারম্ভকালীন সময় থেকেই আমার এ স্কুল গৌরব ও সৌরভ আলোকিত করে দশ দিগন্ত, খ্যাতি পরায়-এর ললাটে মর্যাদার তিলক।
আমার স্কুল শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয় শুধু কালের সাক্ষীই নয়, ইতিহাসের-এ নিজেই এক ইতিহাস। কেবল জ্ঞানের আলো বিতরণই নয়, আছে আরো অনন্য ভূমিকাও। এ স্কুলের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ অবস্থানে সকলেই সমুজ্জ্বল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলো ছড়াচ্ছেন অনেক মেধাবী মুখ। বয়ে এনেছেন অনেক খ্যাতিও। বাংলাদেশের সাবেক দু’জন প্রধান বিচারপতি এ স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। একজন হলেন বিচাপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন, দেশের দ্বিতীয়তম প্রধান বিচারপতি। শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৩১ সালের এসএসসি ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। অন্যজন বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছের হোসেন যিনি দেশের ১৪তম প্রধান বিচারপতি। শায়েস্তাগঞ্জ স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন ১৯৫৬ এসএসসি ব্যাচের। এ স্কুলেরই একজন ছাত্র এনামুল হক মোস্তফা শহিদ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। সরকারের সচিব, পুলিশের অতিরিক্ত আইজি ও র্যাবের মহাপরিচালক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর, ব্যাংকের এমডি, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসা বিজ্ঞানী, যুক্তরাষ্ট্রের নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক, খ্যাতিমান আইনজ্ঞ, শিল্প উদ্যোক্তা, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক- এমন বহুমুখী ও কীর্তিমান মানুষ সৃষ্টির সূতিকাগার- শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ স্কুলের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ স্কুলের অনকে শিক্ষার্থীই রণাঙ্গণে যুদ্ধ করেছেন বীরত্বের সঙ্গে।
দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ বৃহত্তর সিলেট। এই সিলেট এবং হবিগঞ্জের প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত শায়েস্তাগঞ্জ। এখানকার গঙ্গানগরের জমিদার সতীশ চন্দ্র দেবের দানকরা ৮.২৫ একর জমির ওপর ১৯১৮ সালে যাত্রা শুরু করে শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়। এ সময় অবিভক্ত ভারতবর্ষের আসাম প্রদেশের শ্রীহট্ট জেলার রেভিনিউ ডিস্ট্রিক্ট লস্করপুরের অধীনে ছিল দক্ষিণ হবিগঞ্জের এই শায়েস্তাগঞ্জ। পূর্বদিকে প্রবাহমান খোয়াই নদী, দক্ষিণে রেল লাইন, পশ্চিমে রেলওয়ে জংশনের কিছুটা কোলাহল মুখর শহুরে পরিবেশ এবং উত্তরে নিরিবিলি গ্রামীন পরিবেশের মধ্যে স্কুলের অবস্থান। সেটিই আমার প্রাণের বিদ্যাপীঠ। স্বপ্নের কৈশোর কেটেছে এ স্কুলকে ঘিরে। এ স্কুলের শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ায় আমি তাই রোমাঞ্চিত, শিহরিত এবং গর্ব অনুভব করছি। প্রাণের বিদ্যাপীঠের শতবর্ষ উৎসবের অংশীদার হওয়া কম গৌরবের নয়।
শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বর্ণাঢ্য উৎসবের আয়োজন চলছে। আর একদিন পর ৩১ মার্চ শনিবার স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় শতবর্ষের বর্ণিল উৎসব। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী এবং স্কুল সংশ্লিষ্টরা এখন আনন্দে উদ্বেলিত। জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এই বর্ণাঢ্য উৎসবে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন। তার বাবা সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এবি মাহমুদ হোসেন এ স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। সংবর্ধিত অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জেআর মোদাচ্ছির হোসেন। শতবর্ষ উৎসবে ১১জন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বকে শতবর্ষ স্মারক সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। এদের মধ্যে স্কুলের ৮জন সেরা ছাত্র রয়েছেন, যারা তাদের মেধা, সৃজনশীলতা ও কর্মের দ্বারা স্কুল, দেশ ও জাতির জন্য বয়ে এনেছেন বিরল সম্মান। আছেন স্কুলের কিংবদন্তীতুল্য দু’জন প্রধান শিক্ষক এবং স্কুলকে জমিদানকারী একজন সমাজসেবক। শতবর্ষ উৎসবে ‘স্বপ্নিল শতবর্ষ’ নামে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচিত হয়। এটি উপস্থিত পাঁচ হাজারেরও বেশি অতিথির হাতে তুলে দেওয়া হয়। স্মৃতিচারণ, প্রামাণ্য ছবি প্রদর্শনী এবং প্রবীণ শিক্ষক ও কৃতী শিক্ষার্থীদের সম্মাননার পাশাপাশি নাচ-গান-নৃত্যের মনোরম সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনের মাধ্যমে স্মরণীয় করে রাখা হবে শতবর্ষ উৎসব। শুক্রবার শায়েস্তাগঞ্জে বের হবে শতবর্ষ উৎসব পূর্ব আনন্দ র্যালি। উৎসবের শ্লোগানে-”শতবর্ষ শত প্রাণ, ঐতিহ্যে অম্লান।” সত্যিই ঐতিহ্যে অম্লান আমার স্কুল।
নানা রঙের দিনগুলি
শায়েস্তাগঞ্জ হাইস্কুলের স্মৃতিটা খুব প্রিয় ও স্নিগ্ধ হয়ে বেঁচে আছে আমার মনে। হ্যাঁ, ফিরে যেতে চাই স্কুলের সেই দিনগুলোয়। স্কুলের নানা রঙের দিনগুলি সত্যিই আমার জীবনের সোনালি অধ্যায়। শতবর্ষের এই আনন্দ মুহূর্তে কত অসংখ্য স্মৃতির কথা মনে পড়ছে আজ! কাগজে তার কতুটুকুই বা লেখা যায়? সেই দিনগুলোর পরে ৪০ বছরের বেশি সময় কেটে গেছে। কিন্তু কিছুই যেন হারাইনি। মনি-মাণিক্যের মতো সবকিছুই আছে মনের মনিকোঠায়। স্কুল, ছাত্র, শিক্ষক, সহপাঠী সবার কথাই মনে আছে।
শিক্ষকদের মধ্যে কয়েকজনের কথা খুব উজ্জ্বলভাবে মনে পড়ছে। আবার কয়েকজনের স্মৃতি কিছুটা ধূসর হয়ে গেছে। অল্প দিনের আগের কথা তো নয়, সেই ৪০ বছর আগের কথা। সহপাঠীদের অনেকেরই মুখ মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। শোয়েব, ফারুক, হীরেন্দ্র, ফখরুদ্দিন, জয়ন্ত, মোতাকাব্বির, তরুণ, শেখর, রামপাল, সমিরণ, রহম আলী প্রমুখ। কিছু উজ্জ্বল, কিছু অনুজ্জ্বল। সব মিলিয়ে এরাই তো আমার পাঁচ বছরের সহচর।
আমার স্কুলটা দেখতে ছিল নিরিবিলি ছবির মতো। বড় বড় শিরিষ গাছের সুশীতল ছায়ায় আবৃত ছিল প্রাঙ্গণ। আমার মন কাড়ত স্কুলের পূব পাশ দিয়ে খলখল করে বয়ে যাওয়া তীব্র রাতের খোয়াই আর দক্ষিণ পাশের সমান্তরাল রেল লাইন। এই রেল লাইন ধরেই বাসা থেকে স্কুলে যেতাম এবং বাসায় ফিরে আসতাম। রেললাইনের টেলিগ্রাফের তারের ওপর বসে থাকা লম্বা লেজওয়ালা ফিঙে, শালিক, কখনো দুই-একটা কাক, চড়ুই কিংবা অন্যান্য পাখি আমার চোখে বিস্ময় জাগাত। হঠাৎ করে ঝম্ ঝমাঝম্ শব্দ করে চলে যেতো রেলগাড়ি। কখনো সবুজ, কখনো সোনালি ধানের ক্ষেত চোখকে মুগ্ধ করত। আকস্মিক বন্যায় খোয়াই নদী রুদ্রমূর্তি ধারণ করত। তীর ভেঙ্গে বন্যার পানিতে সয়লাব হয়ে যেতে পুরো এলাকা। গ্রামের ছেলেরা, তরুণরা মাছ ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। খুব আনন্দ লাগত আমার।
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র অবস্থায়ই শায়েস্তাগঞ্জ হাইস্কুলে পড়ার স্বপ্ন ভেতরে ভেতরে উঁকি দিচ্ছিল। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিশাল ব্যক্তিত্বের আকর্ষণই সম্ভবত আমাকে এ স্বপ্ন দেখিয়েছিল। বড় বোনের বাসায় কেটেছে আমার স্কুল ও কলেজের জীবন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের কয়েক মাসের মধ্যে আমরা চুনারুঘাটের পীরের গাঁও থেকে শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন বাসায় চলে আসি। আমাকে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হয় শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে কলোনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দুলাভাইয়ের (সৈয়দ সবুজ মিয়া) বইয়ের ব্যবসা ছিল। জংশন সংলগ্ন রোডেই ছিল ‘গ্রীন বুক হাউস’ নামে বইয়ের লাইব্রেরি। অত্র এলাকার সব স্কুলের বই এ লাইব্রেরিতে পাওয়া যেতো। শিক্ষকদেরও আড্ডার অন্যতম প্রধান জায়গা ছিল এ লাইব্রেরি। এ লাইব্রেরিতে মাঝে-মধ্যেই আসতেন শায়েস্তাগঞ্জ হাইস্কুলের কিংবদন্তীতুল্য প্রধান শিক্ষক আবদুন নূর চৌধুরী। দীর্ঘদেহী, সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী একজন মানুষ। যেমন সুপুরুষ, তেমনি প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। দেবতুল্য, ঋষিতুল্য বললেও সামান্য বাড়িয়ে বলা হবে না।
সবার কাছেই তিনি স্যার। শায়েস্তাগঞ্জের গণ্যমান্য সবাই পরম শ্রদ্ধায় তাকে মান্য করত। ‘স্যার’ সম্বোধন করে তাকে বিনয় শ্রদ্ধা ঢেলে দিতেন তারা। আমাদের লাইব্রেরির বড় হাতাওয়ালা চেয়ারটিতে তিনি এসে বসতেন। পুরো চেয়ারটাই ভরে যেতো, একটুও ফাঁক থাকত না। তাকে ঘিরে চলত মুরুব্বীদের প্রাণবন্ত আড্ডা। চোখে চশমা, মাথায় পশমী টুপি। অপূর্ব এক মধুর ব্যক্তিত্ব। আমার মনে হতো ওই সময়টায় আমাদের লাইব্রেরিটা যেনো আলোর ঝলকে নেচে নেচে উঠছে। আমি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতাম তার দিকে। মনে মনে ভাবতাম এই মহতী প্রধান শিক্ষকের স্কুলে যদি পড়ার সৌভাগ্য হতো। একদিন স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিল। পঞ্চম শ্রেণী পাস করার পর শায়েস্তাগঞ্জ হাইস্কুলে ভর্তির সুযোগ এলো। সত্যিই সেটা ছিল আমার স্বপ্নের স্কুল। ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘খ’ শাখায় ভর্তি হই। শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশই নয়, পরীক্ষার রেজাল্ট, শিক্ষকদের মান, সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা, শৃংখলা, নিয়ম-কানুন সব দিক থেকেই একটা আদর্শ স্কুল। এর পেছনে ছিল একজন মানুষেরই কর্মনিষ্ঠা। মূলত তিনিই ছিলেন এ স্কুলের প্রাণ ভোমরা। হেডস্যার হিসেবে তার বিরল যোগ্যতা ও অসামান্য ব্যক্তিত্ব যে কাউকে আকৃষ্ট করত। এমন আদর্শ শিক্ষক, এমন অতুলনীয় শিক্ষা প্রশাসক আমার জীবনে আমি কমই দেখেছি। শুধু স্কুলই নয়, শায়েস্তাগঞ্জের যেকোন সমস্যা সমাধানে তিনিই ছিলেন ভরসার স্থল।
শিক্ষা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার শিক্ষা আমরা তিনি এবং তার নেতৃত্বাধীন একদল আদর্শ শিক্ষকের কাছ থেকেই পেয়েছি। প্রতিদিন স্কুলের ক্লাশ শুরু হতো অ্যাসেম্বলি হওয়ার পর। সেখানে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে দেশমাতৃকাকে আমরা শ্রদ্ধা জানাতাম। কখনো কখনো জাতীয় সঙ্গীতের পর হেড স্যার উপদেশমূলক বক্তব্য দিতেন। একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন আমরা রাতজেগে শহীদ মিনার তৈরি করতাম তারই অনুপ্রেরণায়। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন তিনিই করতেন। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) এবং সরস্বতী পূজা আয়োজনও যথারীতি স্কুলে হয়েছে। গ্রীষ্মের ছুটির সময় প্রতিটি শ্রেণীকক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা সাজানো হতো। হেড স্যার তার সহকর্মীদের নিয়ে প্রতিটি কক্ষে যেতেন এবং সুন্দর সাজ-সজ্জার জন্য প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কারের ব্যবস্থা করতেন। নান্দনিকতা এবং সৌন্দর্যবোধের শিক্ষা এখান থেকেই আমরা পেয়েছি। আমাদের স্কুলে ছাত্র সংসদ ছিল। ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকার সময়ই আমি ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। নির্বাচন করার শিক্ষাটা আমার রক্তে হয়ত সেখান থেকেই। আমাদের প্রিয় হেড স্যারকে ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন অসম্ভব ভালোবাসত, তেমনি ভয়ও পেতো। তার অসামান্য ব্যক্তিত্বের কারণেই ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা ছিল সবার। হেড স্যার তার কক্ষ থেকে বের হয়ে এলে পুরো স্কুলজুড়ে নেমে আসত পিনপতন নীরবতা।
ছাত্র-ছাত্রীদের সুপ্ত মেধার বিকাশ এবং সৃজনশীলতায় উদ্বুদ্ধ করতেন হেড স্যার। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, স্কাউটে যাওয়া, রচনা প্রতিযোগিতা এমন নানা আয়োজন হতো স্কুলে। একদিনের একটি ঘটনা। ক্লাস করছি, এমন সময় চাপরাশি করিম হোসেন বিজ্ঞপ্তির খাতা নিয়ে হাজির। স্যার পড়ে শোনালেন, স্কুলে একজন কবি এসেছেন। বিকাল তিনটায় হেড স্যার স্কুল প্রাঙ্গণে ছাত্র-ছাত্রীদের ডেকেছেন কবির কবিতা শুনতে। আমাদের যে কী আনন্দ! কবি এসেছেন মৌলভীবাজার থেকে। ঝাকড়া চুলের বাবরি দুলানো সেই কবি আমাদের চোখে যেনো নজরুল। তাৎক্ষণিক কবিতা রচনা করে কবি আমাদের শোনালেন ‘চায়ের কাপ, চায়ের কাপ’।
স্কুলে আমার খুব প্রিয় একজন শিক্ষক ছিলেন নৃপেন্দ্র স্যার। আমাদের বাংলা পড়াতেন। বেশভূষা ও ব্যবহারে এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। ইস্ত্রিকরা ধুতি ও সাদা পাঞ্জাবি পরতেন। কখনো পরতেন ঘিয়ে রংয়ের খদ্দেরের পাঞ্জাবি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। শুদ্ধ ভাষায় স্পষ্ট উচ্চারণে তার কণ্ঠ থেকে যেন মধু বর্ষিত হত। এমনভাবে পড়াতেন আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা অনুসরণ করতাম। বৃষ্টিমুখর একটি দিনে তিনি বর্ষা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। মেঘদূত কাব্য থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছিলেন। তখন আমরা নবম শ্রেণীতে। যক্ষ মেঘকে দূত করে কীভাবে প্রিয়ার কাছে তার প্রেমের বাণী পাঠান সে কাহিনী। আমরা তন্ময় হয়ে তা শুনছিলাম। সেদিন অনেকের মনেই একটা প্রেম প্রেম ভাব উঁকি দিচ্ছিল। আমাদের মেয়ে বন্ধুদের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে মনে হয়েছিল তারা যেনো স্বপ্নের জগতে বিচরণ করছে।
সুরেশ স্যার অংক পড়াতেন। জমিদার পরিবারের সন্তান এই স্যার ছিলেন একজন অসাধারণ মানুষ। ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমরা প্রথম তাকে ক্লাস চিটার হিসেবে পেয়েছিলাম। সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। আজীবন ছিলেন একজন নিরহংকারী মানুষ। চেয়ারে বসা কিংবা বোর্ডে অংক করানোর সময়ও পা নাড়াতেন।
রশীদ স্যার ছিলেন ধর্মীয় শিক্ষক। মুখ ভরা সাদা দাঁড়ি আর পায়জামা-পাঞ্জাবি টুপিতে ছিলেন উজ্জ্বল এক শিক্ষক। রশীদ স্যারের ‘বেতের বাড়ি’ স্কুলের এক কিংবদন্তি হয়ে আছে। বেতের বাড়ি খায়নি এমন ছাত্র-ছাত্রী খুব কমই আছে। ছাত্ররা তার বেতের বাড়ি প্রকৃতপক্ষে উপভোগ করত। কখনো কখনো তিনি ছাত্রদের পাইকারি হারে বেত মারতেন। নামাজে না গেলে তার বেতমারা ছিল অপরিহার্য ঘটনা। যারা জোহরের নামাজে যায়নি, ক্লাশ ক্যাপ্টেনকে নাম লিখে স্যারকে দিতে হতো। ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবে আমি প্রথমেই যে নামটি লিখতাম সে আমার বন্ধু মুজিবুল হক শামীম। সে নামাজে যেতো না। স্যার ক্লাশে আসার পর শামীম পাক্কা মুসল্লী সেজে মাথায় টুপি দিয়ে আল্পু মিয়ার দোকান থেকে এক কাপ চা ও একটা বান নিয়ে ক্লাশে ঢুকত। টেবিলে চায়ের কাপ রাখার পরপরই স্যার তাকে কয়েকটি বেত মেরে চেয়ারে এসে বসে চা খেতেন। আমরা বেশ মজা পেতাম। শামীম বলতো এই বেত না খেলে নাকি ওর ভালোই লাগত না।
আমার বন্ধু ফারুকের কথা খুব মনে পড়ে। সে কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে। রেললাইন ধরে এক সঙ্গে আমরা স্কুলে যেতাম। মাঝে-মধ্যে ঝগড়াঝাটিও হতো। একদিন সে আমাকে রেল লাইনে ফেলে পিঠ কামড়ে দিয়েছিল। ওর একটি টকটকে হলুদ রংয়ের ফুলহাতা শার্ট ছিল। ওই শার্টের প্রতি আমার ভীষণ লোভ ছিল। প্রায় সময়ই ওর কাছ থেকে শার্টটি এনে পরেছি।
ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই শোয়েব আমার প্রাণের বন্ধু। আমি বলতাম ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’। প্রধান শিক্ষকের ছেলে হিসেবে সবার কাছেই সে ছিল প্রিয়। স্কুলের ফাস্ট বয় ছিল সে। স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে মঞ্চস্থ চোর নাটকে শোয়েব ও আমি অভিনয় করেছিলাম। আইনজীবী মিস্টার মর্গানের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে গাউন হিসেবে পরেছিলাম আমার বড় বোনের কালো বোরখা। হবিগঞ্জে একসঙ্গে থেকেই আমি ও শোয়েব এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষার শেষ দিন রাতে আবদুল আলী স্যারকে নিয়ে আমরা যাত্রা দেখেছি। সে যখন বাসায় চলে যায়, মনে আছে ওই রাতে আমি ঘুমোতে পারিনি। সবসময় ভাবতাম সে যেনো আমার চিরদিনের বন্ধু হয়ে থাকে। দু’জন দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। শোয়েব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিষ্ট্রিতে, আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রিতে পড়েছি। জাহাঙ্গীরনগরে আমার মীর মোশাররফ হোসেন হলের চেয়েও আমি শোয়েবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদুল্লাহ হলে এসে বেশি থেকেছি। এরপর এমন কায়দা করেছি যেনো আমদের বন্ধুত্ব কোনোদিন আর ছুটতে না পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে মানুষের স্মৃতিশক্তি বাড়ানো নিয়ে গবেষণায় সে জড়িত ছিল। ওই গবেষণা টীমে দু’জন নোবেল বিজয়ী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন। ঢাকায় এলে এ নিয়ে আমি আমার বন্ধু ডক্টর শোয়েব চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। আমার জন্য এটি ছিল এক স্মরণীয় মুহূর্ত।
এবার আমাদের মেয়ে বন্ধুদের কথা বলি। না, ওই সময় শায়েস্তাগঞ্জ স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বাক্যালাপের রেওয়াজ ছিল না। অনেকটা অবরোধবাসিনীর মতো। সৌজন্যমূলক আলাপ হতো কালেভাদ্রে। হয়ত স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় কিংবা কেউ কারো বাসায় বেড়াতে গেলে। স্কুলে ছাত্রীদের জন্য ছিল আলাদা কমনরুম। ছাত্রীরা টিচারের সঙ্গে ক্লাসে ঢুকত, ক্লাশ শেষে টিচারের সঙ্গে বেরিয়ে যেতো। ক্লাসের এক পাশে আলাদা কয়েকটি বেঞ্চে তারা বসত।
আমাদের সঙ্গে যেসব মেয়ে বন্ধু পড়তো, তারা সবাই ভারী সুন্দরী ছিল। তাদের কারো চোখ ট্যারা ছিল না, কারো পা খোঁড়া ছিল না। তবে দুধে-আলতা গায়ের রংও ছিল না। অবশ্য দেখতে ওদের অপূর্ব লাগত, যেনো শ্যামলী বাংলার রূপ ওদের শরীরে ঝরে পড়ছে। নামও ছিল বেশ সুন্দর। চাঁদ চিনু সুলতানা, নিলু, অর্চনা, প্রতিমা, স্মৃতি, শরীফা, শামসুন্নাহার আর কত কি! আজ কে কোথায় কেমন আছে জানি না। যেখানেই থাকো, ভালো থেকো বন্ধুরা।
আমাদের স্কুলে দুপুরে টিফিন দেওয়া হতো। নানা ধরনের বিস্কুট, বান রুটি, কলা। ফল হিসেবে যেদিন কলা দেয়া হতো, দেখতাম অনেকেই আমার পাশে এসে বসছে। কারণ আমি কলা খাই না। আমার কলা ফলটি বন্ধুদের দিতে পেরে খুব ভালো লাগত। স্মৃতি সুখের এবং গৌরবের। চোখ বুঝলে আজও দেখতে পাই বন্ধুদের হাস্যোজ্জ্বল মায়াভরা মুখ, উচ্ছ্বলতা-চঞ্চলতা। এ মুহুর্তে রবী ঠাকুরের গানটি গাইতে ইচ্ছে করছে-
“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়
ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়...”
স্মৃতিময় শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়
আমার অগ্রজ রণবীর কুমার পাল। ১৯৬৬ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। জজ হিসেবে দায়িত্বপালন শেষে এখন আইন পেশায় নিয়োজিত। তার স্মৃতিতে সে সময়ের স্কুল:
১৯৫৯ সালে বাবা আমাকে শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে তার কক্ষে নিয়ে যান। গিয়ে দেখি চেয়ারে আসীন দীর্ঘকায়, নবনীবর্ণ, তীক্ষ্ণ নাসা, টানা টানা চোখের মনি দু’টির রং সমুদ্রের মতো নীল’ স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুর নূর চৌধুরীকে। মাথায় হাত রেখে আমাকে আদর করে নিয়মিত স্কুলে আসতে বললেন। শুরু হলো স্কুলে আসা-যাওয়া। পর্যায়ক্রমে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলাম। দুরন্ত কৈশোর কিছুতেই বাধ মানে না। সহপাঠী এবং বন্ধু জুটে গেছে বেশ। দুষ্টুমিও ভর করেছে। দুপুরে দলবেঁধে মাইল্লা ভাইয়ের কাছে মুড়ির মোয়া খেতে ভিড় করতাম। সেই মোয়ার স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে। সুরেশ স্যার বাংলা পড়াতেন। ক্লাসে এসে কিছু পড়া মুখস্ত করার নির্দেশ দিয়ে চেয়ারে বসে পা দোলাতেন, যেন নৌকা দুলছে। শৈলেন স্যার পড়াতেন ভূগোল। এমনভাবে পড়াতেন ক্লাশেই পড়া শিখে নিতাম। পড়া না পারলে ডেকে নিয়ে পিঠে মারতেন একটা কিল।”
পুলিশের অতিরিক্ত আইজি এবং র্যাবের ডিজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এস এম মিজানুর রহমান। ১৯৬৭ ব্যাচের মেধাবী শিক্ষার্থী। বোর্ডে মেথা তালিকায় স্থান করে নেন। তার চোখে তার প্রিয় স্কুল: আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং শিক্ষাজীবনের সবচাইতে বড় অংশ শায়েস্তাগঞ্জে অতিবাহিত হয়েছে। বাবার চাকরির সুবাদেই শায়েস্তাগঞ্জে বসবাস। সতীর্থ ও বন্ধু মহলে এজন্যে আমি দীর্ঘদিন সিলেটি হিসেবেই পরিচিত ছিলাম। স্কুলে সতীর্থ বন্ধুদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করা নিয়ে আমার সাথে শাহজামান ও আবিদুরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। ছাত্রজীবনে আমরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেও ব্যক্তিগত জীবনে ছিলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আজ ৫৬ বছর পরও আমাদের বন্ধুত্ব অটুট আছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসা বিজ্ঞানী দেওয়ান সৈয়দ আবদুল মজিদ। ১৯৬৯ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের তুলানে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনে অধ্যাপক ও গবেষক হিসেবে কর্মরত। তার স্মৃতিতে স্কুল: মনে পড়ে ১৯৬৪ সালের কথা। সবেমাত্র স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে ভর্তি হয়েছি, আদ্যপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে। নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধুদের উচ্ছ্বল-উদ্দীপনার মাঝে নতুন জীবন শুরুর প্রাক্কালে প্রথম সপ্তাহেই এমন একটা ঘটনা ঘটল, যার রেশ ধরে একটা ভয় আমাকে খুব আচ্ছন্ন করে তুলেছি-আমাদের প্রধান শিক্ষক আবদুন নূর চৌধুরী স্যারকে ঘিরে। ষষ্ঠ শ্রেণীর আমাদের ক্লাশ রুমটা ছিল হেড স্যারের অফিসের উল্টো দিকের বিল্ডিংয়ে। ক্লাসে বসেই পরিষ্কার দেখতে পেতাম স্যারের অফিসের সামনের বারান্দাটুকু। একদিন হঠাৎ এক আর্তচিৎকারে ভয়ে তটস্থ হয়ে লক্ষ করি হেডমাস্টার স্যার একজন ছাত্রকে (সম্ভবত নবম শ্রেণির) অফিসের সামনে দাঁড় করিয়ে একটার পর একটা বেত মারছেন। ছাত্রটি আর্তনাদ করে স্যারের কাছে মাফ চাইছে। ভয়ে আমরা সবাই কুঁকড়ে গেছি। কিছুক্ষণ পরেই স্কুলের চাপরাশি করিম হোসেন একটা লাল খাতার বিজ্ঞপ্তি নিয়ে ক্লাসের স্যারের কাছে হাজির। স্যার বিজ্ঞপ্তটি পড়ে শোনালেন। অন্য একজন ছাত্রের সাথে অসদাচারণের জন্য ওই ছাত্রকে বেত্রাঘাত করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের খারাপ আচরণে, শৃংখলাভঙ্গের অপরাধ এবং নৈতিক স্মলজনিত অপরাধে হেড স্যার এমন কঠোরই হতেন। তবে তিনি সব ছাত্র-ছাত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। তার প্রতি প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধাবোধ ছিল। কিন্তু তিনি ভেতরে ভেতরে ছিলেন খুবই নরম মনের মানুষ। ভালো ছাত্রদের শুধু পড়াশোনার পুঁথিগত মানদণ্ডই নয়, স্কুলে খেলাধূলা, সাংস্কৃতি কর্মকাণ্ড বা অন্য যেকোন গুণে গুনান্বিত ছাত্র-ছাত্রীরা তার স্নেহ-মমতা, উৎসাহ-উদ্দীপনার যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছে।
রশীদ স্যার ছিলেন আমাদের ধর্মশিক্ষার শিক্ষক। উনি সব ছাত্রকেই স্নেহ করতেন। তবে উনার কাছে কেউ যদি অন্য ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে যেত, তখন উনি দু’পক্ষকেই ডেকে আনতেন। ওনার একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল। প্রথমেই উনি অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত দু’জনকেই দু’টি বেত্রাঘাত করে শাস্তি দিতেন। তারপর সব ঘটনা শুনে দোষীকে তার দোষ অনুযায়ী শাস্তি দিতেন। অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত দু’জনকে প্রথম বেত্রাঘাতের কারণ, ওনার বিশ্বাস এক হাতে তালি বাজে না। দু’জনই কিছুনা কিছু দোষ করেছে, তাই এ অভিযোগের কারণ সৃষ্টি হয়েছে।
আমার বন্ধু ১৯৭৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী ড. শোয়েব চৌধুরী। স্কুল নিয়ে তার স্মৃতি: স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে শায়েস্তাগঞ্জ স্কুলে এসে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। আমার জায়গা হলো ‘গ’ শাখায়। মালেক স্যার ছিলেন আমাদের ক্লাস টিচার। অসুস্থতার কারণে তার ভারী শরীর। সমাজ বিজ্ঞানের বই তখনও পাওয়া যায়নি। মালেক স্যার নিজে নিজেই সাবজেক্ট বানিয়ে আমাদের পড়াতেন। একটি বিষয় ছিল হরষপুর থেকে সিলেট পর্যন্ত সব রেলওয়ে স্টেশনের নাম জানা। আমার কিন্তু এখনো সবগুলো স্টেশনের নাম মুখস্ত আছে। মালেক স্যার ও রশিদ স্যার সম্পর্কে নানা প্রবাদ ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে মুখে ছিল। যেমন ‘মালেক স্যারের কিল, বৈশাখ মাইয়া হিল’ (শিলাবৃষ্টি), ‘রশীদ স্যারের বেতের বাড়ি ফুইল্লা উঠে তাড়াতাড়ি।” তেমনি রহিম আলী স্যার নিজের জীবনের খেলাধুলার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলতেন’ ‘বাঘ যায় বারো হাত, হরিণ যায় তেরো হাত, আর রহিম আলী যায় সাড়ে চৌদ্দ হাত।’
৭৫ ব্যাচের ছাত্রী মনোয়ারা বেগমের স্মৃতি: আমাদের টিফিনের সময়টা ছিল সবচেয়ে আনন্দের। একেক দিন একেক ক্লাস মেয়েদের মাঝে টিফিন ভাগ করে দিত। যেদিন আমার ওপর বর্তাতো সেদিন কী যে খুশি লাগত। কারণ আমি হয়তো ৬-৭টা বিস্কুট বেশি পাব। এই বিস্কুটের স্বাদ যে কোনোদিন ভুলতে পারিনি!
১৯৮১ ব্যাচের শিক্ষার্থী অনুজ জাহেদ চৌধুরী সাংবাদিকতায় আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী। স্কুল নিয়ে তার স্মৃতি: শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের ধুলোমাটির গন্ধ লেগে আছে আমার অস্তিত্বে। কারণ আমার জন্ম স্কুল সংলগ্ন প্রধান শিক্ষকের বাসভবনে। আঁতুরঘরেই আমি গন্ধ শুঁকেছি এ স্কুলের।
অগ্রজ এবং একইসঙ্গে ভাগ্নে হুমায়ুন কবীর সৈকতের কিছু লাইন উদ্ধৃত করেই লেখা শেষ করছি। তিনি শতবর্ষ উৎসবের স্মরনিকা কমিটির আহ্বায়কও। ‘স্বপ্নিল শতবর্ষ’ স্মরণিকার সম্পাদকীয়তে সৈকত লিখেছেন “আমাদের কৈশোরবেলার মননকে গড়ে তুলেছিল যে বিদ্যাপীঠ, আমাদের আলোর পথের যাত্রী করেছিল যে বিদ্যাপীঠ, আজ যে শতায়ু, পরিণত এক ঋদ্ধ ভাস্বর বাস্তবতা। স্বাধীনতার মাস এই মার্চে আমাদের প্রাণের বিদ্যপীঠের শতবর্ষ পূর্তির উৎসবে ছড়িয়ে পড়ুক স্বাধীনতার প্রাপ্তির অনাবিল আনন্দ, উচ্ছ্বাস। কবিগুরুর ভাষায়
‘আজিকার বসন্তের আনন্দ অভিবাদন
পাঠায়ে দিলাম তার করে
আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে
ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে
আজি হতে শতবর্ষ পরে।’
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেসক্লাব।
টিকে