কোটার কারণে মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে : ড. আনিসুজ্জামান
প্রকাশিত : ০৫:৩১ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৭:১৪ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০১৮ বৃহস্পতিবার
‘যেদেশে গুণীর কদর হয় না, সেদেশে গুণীরা জন্মায় না’- এমন কথা বলে গেছেন কবিরা। বর্তমান সময় চাকরিতে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থার কারণে আমাদের দেশে প্রশাসনে মেধাবীদের চেয়ে কোটাধারী কম মেধাবীরা বেশি জায়গা করে নিচ্ছেন। আর শুধু সাধারণ ক্যাডার কেন, কলেজের শিক্ষক, বিচার বিভাগ সবখানেই তো কোটার কারণে অতি মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। কাজেই কোটা পদ্ধতির অবশ্যই সংস্কার হওয়া উচিত। কিছু কোটা থাকতে পারে শারীরিক প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য। তবে সব মিলিয়ে ১০ শতাংশের বেশি কোটা থাকা উচিত নয়। এমনটাই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
সম্প্রতি একুশে টিভি অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি এসব কথা বলেন।
দেশবরেণ্য এ শিক্ষাবিদনের কথায় উঠে এসেছে কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের চাকরির সমস্যাসহ শিক্ষাব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি-গলদ। এছাড়া সাম্প্রতিক সময় চাকরি, বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা ও চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের সমালোচনা এবং এ থেকে বেরিয়ে আসার দিশাও খুঁজে পাওয়া যাবে তার সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন একুশে টিভি অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান।
একুশে টিভি অনলাইন: সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটার সংস্কারে ভূক্তভোগীরা দাবি জানিয়ে আসছেন, আন্দোলন করছেন, বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন ?
ড. আনিসুজ্জামান: আমি মনে করি যে, তাদের আন্দোলনের অবশ্যই যৌক্তিকতা আছে। তাদের দাবি অযৌক্তিক নয়। সব মিলিয়ে শতকরা ১০ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে। এর বেশি রাখা উচিত নয়। তাহলে মেধার অবমূল্যায়ন হয়। দেশে বর্তমানে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ২৫৮ ধরনের কোটা বিদ্যমান। শতাংশের হিসাবে যেটি ৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি একশ জন চাকুরিপ্রার্থী থেকে ৫৬ জন কোটা ও ৪৪ জন মেধা অনুসারে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই অনুপাত মেধাবীদের প্রতি অবিচার। সারাদেশে কোটাবিরোধী যে দাবি উঠছে-আন্দোলন চলছে তার যৌক্তিকতা রয়েছে।
একুশে টিভি অনলাইন : সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানোর জন্য চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ আন্দোলন করছে। এটি কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন ?
ড.আনিসুজ্জামান: তারা অনেক বেশি বয়স পর্যন্ত চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা করতে আবেদন করবে এটা তেমন যৌক্তিক না হলেও যেহেতু পড়াশুনা শেষ করতে অনেকটা সময় চলে যায় সেক্ষেতে কিছুটা হলেও বাড়ানও উচিত বলে আমি মনে করি।
একুশে টিভি অনলাইন: বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি? শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিতে শিক্ষার আমূল পরিবর্তন দরকার আছে কি না ?
ড. আনিসুজ্জামান: আমাদের দেশে শিক্ষার মান নিয়ে গত ১৫০ বছরে অনেক দু:চিন্তা চলছে। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা শিক্ষার যথাযথ মান নিয়ে বেড়ে উঠছে না। বিশেষ করে যারা উচ্চ শিক্ষা লাভ করছে। তারা বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এখানে থেকে বুঝা যায়। তাদের শিক্ষার মান উন্নয়ন করা দরকার। তারা যে বিষয় গবেষণা করতে চায় সে বিষয়গুলোর সুযোগ কেমন আছে তা দেখার বিষয়। অনেক সময় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাস করার জন্য পড়ালেখা করান। ফলে শিক্ষকরা ইচ্ছা করলেও যথাযথ শিক্ষা নিশ্চিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। আমাদের কর্তব্য হবে শিক্ষার্থীরা যারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে আসতে চায় তাদের উচ্চ শিক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
একুশে টিভি অনলাইন: সৃজনশীল পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যথাযথ শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে কি না ?
ড. আনিসুজ্জামান: সৃজনশীলের মাধ্যমে কিভাবে পাঠদান করে এ বিষয় আমার তেমন ধারণা নেই। তবে আমার মনে হয় শিক্ষার্থীদের আগে সৃজনশীল পদ্ধতি সর্ম্পকে শিক্ষকদের ধারণা দিতে হতে। শিক্ষকদের এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদেরকে নিজেদের মতো করে লিখতে আগ্রহ তৈরি করেন না। তার চান ছাত্ররা মুখস্ত করে এসে পরীক্ষা দিক। ছাত্ররা নিজেদের থেকে লিখলে লিখার মান একটু খারাপ হবে এটাই স্বাভাবিক। এটাকে তার মেনে নিতে চাই না ফলে। সৃজনশীল মুখস্ত করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর অনেক চাপ পড়ছে। ফলে শিক্ষার সঠিক মান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
একুশে টিভি অনলাইন: অনেকের অভিমত শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে অনেকটাই সনদনির্ভর। দেশপ্রেম নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ প্রচুর ঘাটতি রয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। এগুলো চর্চার অভাবে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে অভিশাপে পরিণত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে কিভাবে উত্তরণ ঘটনো যায় ?
ড.আনিসুজ্জামান: একথা অবশ্যই ঠিক বর্তমানে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা পাশ করার জন্য লেখাপড়া করছে। নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার উপর তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। নৈতিক শিক্ষা দিতে শিক্ষকদের আগ্রহ নেই। আমার মনে হয় শিক্ষা ব্যবস্থা নৈতিক শিক্ষা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আর শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। এজন্য প্রত্যেক শিক্ষক শ্রেনিকক্ষে যদি অল্প সময় ধরে ধর্মীয় ও নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। এছাড়া ক্লাস রুমের বাহিরেও শিক্ষার্থীকে এ সামাজ পরিবার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নৈকিত শিক্ষা নিতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কী কারণে বারবার প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটছে, এটা থেকে উত্তরণের উপায় কি হতে পারে?
ড. আনিসুজ্জামান : প্রশ্নফাঁস হবার মূল কারণ আমাদের শিক্ষার্থীরা সবাই পরীক্ষার্থী হয়ে যাচ্ছে। তাই পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার কারার জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা কাজ করছে। ফলে তারা যেভাবেই হক প্রশ্নে সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সরকারের উচিত প্রশ্নফাঁসের মূল কারণ বের করে। এবং এর সাথে যারা জড়িত তাদের কঠোর শাস্তি আওয়াত আনা উচিত। সম্প্রতি সময় শিক্ষা মন্ত্রণায়ন বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এখন দেখার বিষয় এধরনের পদক্ষেপ কোন কাজে আসে কি না। পদক্ষেপ যদি ইতিবাচক মনে হয় তাহলে প্রশ্নফাঁস রোধ হবে।
একুশে টিভি অনলাইন : আমাদের দেশে কোচিংয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। বাণিজ্য থেকে বেরিয়ে শিক্ষা কিভাবে নিরেট সেবায় রূপান্তর করা যায়।
ড. আনিসুজ্জামান : সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা অনেকটাই সনদ বাণিজ্য করে। সব শিক্ষাটা পরীক্ষা পদ্ধতি হওয়ার কারণে লেখাপড়া সদননির্ভর হয়ে পড়েছে। আমি আশা করব শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যারা শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করছে তাদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। আর যারা শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে তাদের ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
একুশে টিভি অনলাইন : বাংলাদেশে ডোমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে (জনসংখ্যার বোনাসকালে) প্রবেশ করছে। এবিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে আমরা কিভাবে নিশ্চিত করতে পারি। এছাড়া প্রতিবছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশুনা শেষ করে ২২ লাখ শিক্ষার্থী বের হলেও তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারছি না। এর কারণ কি?
ড. আনিসুজ্জামান: শিল্প উদ্যোক্তা তৈরি না করতে পারলে কর্মসংস্থান বাড়নো যাবে না। কিন্তু আমাদের দেশে উদ্যোক্তা তৈরি করতে তেমন কোন উদ্যোগ নেই। সেটা সরকার বলেন আর বেসরকারি। তরুণ সমাজকে সঠিকভাবে কাজে লাগতে আমাদের অবশ্যই শিক্ষা ব্যবস্থা ও কারিগরি ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আমাদের দেশে অনেক শিক্ষার্থী আছে। যারা নিজেরা উদ্যোক্তা হতে চাই। তাদের যদি সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। তাহলে উদ্যোক্ত বৃদ্ধি পাবে। বছরে সে যে হারে শিক্ষার্থী বের হচ্ছে সেহারে আমাদের কর্মসংস্থান বাড়ছে না যে কারণে অনেক শিক্ষার্থীর পড়াশুনা করে চাকরি পাচ্ছে। ফলে তরুণ সমাজের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। এছাড়া শিক্ষাব্যবস্থা বাজারমুখী করতে হবে। তাহলে আমার সফল লাভ করতে পারবো।
একুশে টিভি অললাইন: মূল্যাবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. আনিসুজ্জামান : একুশে পরিবারকেও ধন্যবাদ।
‘‘আনিসুজ্জামান একজন শিক্ষাবিদ ও লেখক। তিনি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তাঁর গবেষণা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম এ টি এম মোয়াজ্জেম। তিনি ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিনী হলেও লেখালেখির অভ্যাস ছিল।
কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে শিক্ষাজীবনের শুরু করেন আনিসুজ্জামান। ওখানে পড়েছেন তৃতীয় শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। পরে এদেশে চলে আসার পর অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে। কিন্তু বেশিদিন এখানে পড়া হয় নি। একবছর পরই পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় ভর্তি হন প্রিয়নাথ হাইস্কুলে। আনিসুজ্জামান ছিলেন প্রিয়নাথ স্কুলের শেষ ব্যাচ। কারণ তাঁদের ব্যাচের পরেই ওই স্কুলটি সরকারি হয়ে যায় এবং এর নাম-পরিবর্তন করে রাখা হয় নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল। সেখান থেকে ১৯৫১ সালে প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ড. আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৫৩খ্রিষ্টাব্দে। সে সময়ে বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শহিদ মুনীর চৌধুরীকে। ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক সম্মান এবং এমএতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। অনার্সে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার কৃতিত্বস্বরূপ "নীলকান্ত সরকার" বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। গবেষণার বিষয় ছিল `উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস।
আনিসুজ্জামান শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। প্রবন্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। শিক্ষায় অবদানের জন্য তাঁকে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তাঁকে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ পদক প্রদান করা হয়। ’’