ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

রাজীবের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড়

আলী আদনান

প্রকাশিত : ০৯:০৮ পিএম, ১৭ এপ্রিল ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ১০:১০ এএম, ১৯ এপ্রিল ২০১৮ বৃহস্পতিবার

জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে- এ তিন কাজ সৃষ্টিকর্তার হাত দিয়ে। এমনটাই বিশ্বাস করেন নিয়তিবাদীরা। তবে নিয়তি নির্ধারিত হলেও অনেক কিছুই মেনে নেওয়া কষ্টের। মেনে নেওয়া যায় না। সমাজ জীবনে প্রতিনিয়ত এরকম মেনে নিতে না পারা অসংখ্য ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। অনাকাঙি্ক্ষত অনেক ঘটনা আমাদের মনে যেমন ক্ষোভ জন্ম দেয় তেমনি রক্তক্ষরণ বাড়ে হৃদয়ের। আমাদের তেমনি একটি রক্তক্ষরণ হচ্ছে রাজীব হোসেনের জন্য। গতকাল রাত পৌঁনে একটায় রাজীব মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পন করেন। এর আগে পনের দিন রাজীব লড়াই করেছে মৃত্যুর সাথে।

প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের নাগরিক জীবনের বড় প্রতিচ্ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। আমাদের আনন্দ বেদনা, হাসি কান্না, ভালো লাগা বা খারপ লাগা, নিজের মতামত প্রকাশ করে থাকি ভার্চুয়াল জগতে। রাজীবও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রধান বিষয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকে রাজীবকে হারানোর বেদনায় চলছে রাগ, ক্ষোভ, হতাশার বহি:প্রকাশ। চলছে অশ্রুপাত।

সাংবাদিক শুভ কিবরিয়া তার ফেসবুকে লিখেছেন, "যেভাবে বাসের হাতলে তোমার হাত চাপা পড়েছিল তার দায় কার? তোমার নাকি এই বল্গাহীন, আইনের শাসনরহিত রাষ্ট্র বা সমাজের? এখন তুমি এসবের ঊর্ধ্বে। অনেক দূরে…বাসের চিপায় তোমার হাতের ছবি, বগল থেকে পড়ে যাওয়া হাত দেখে প্রার্থনা করেছিলাম, তুমি যেনো আর ফিরে না আসো। কর্তনকৃত হাত, রুগ্ন সমাজ, সন্ত্রস্ত রাষ্ট্র তোমাকে আরও অনেক কষ্ট দিত। অ-নে-ক কষ্ট। আপাতত সেই কষ্ট থেকে মুক্তি। ভাই আমার, যেখানে থাকো ভাল থেকো।"

এই স্ট্যাটাসে রাজীবের হাত হারানোর যন্ত্রনা শুধু রাজীবের নয়, বরং সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ার অভিব্যাক্তি লক্ষ্য করা যায়। রাজীবকে নিয়ে যে স্ট্যাটাসগুলো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এসেছে তার অনেকগুলোতে দেখা গেছে ক্ষোভ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ যখন উল্টো ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় থাকেনা, তেমনি ঘুরে দাঁড়ানোর আহবানও দেখা যায় কোনো কোনো স্ট্যাটাসে।

তেমনি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন স্নিগ্ধা দাস গুপ্ত নামে একজন সমাজকর্মী। তিনি তার স্ট্যাটাসে বলেন, "এটা শুধু নিছক একটা নিউজ হওয়ার কথা না। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় যাওয়া একটা দেশের ভবিষ্যৎ চলে গেছে। প্রতিটি ছাত্রের উচিত ওলট পালট করা ভূমিকম্প করা। তারপর প্রশাসন কি করবে তা দেখা।"

ফেসবুকে শরীফ নিজাম নামে একজন তার অনুভূতি প্রকাশ ককরেছেন এভাবে। "একদা এ শহরে রাজীব ছিল, সাথে স্বপ্নরাও ....... জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে বেড়ে উঠা রাজীব চলে গেলেন। জীবনের আঁকাবাঁকা পথে চলতে চলতে দানব বাস রাজীবের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। অনেকটা অভিমান করেই..... দুই সপ্তাহ আগে প্রাণ–টগবগে দুচোখে স্বপ্ন জ্বলজ্বল করা রাজীব এখন স্মৃতি হয়ে গেলেন।

দুর্ঘটনার পর অনেক অভিমান করে হাসপাতালে একবার বলেছিলেন, ‘রাজীব কে? রাজীব মারা গেছে!’ কার সঙ্গে অভিমান করেছিলেন, সেটা আর কখনো জানা হবে না। লড়াই করে বড় হয়েছিলেন। এই শহর তাঁর লড়াইকে সম্মান দিয়ে দাঁড়ানোর মতো এক চুল জায়গাও দিল না। এখন শেষ আশ্রয়ের জন্য তিনি চলে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে। আর কখনো স্বপ্ন দেখার জন্য তাঁকে ফিরতে হবে না ইট-কাঠের এই শহরে...."

তবে রাজীবকে নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসটি দিয়েছেন জামিল আল ফয়সাল নামে একজন। তাঁর স্ট্যাটাসে উঠে আসে রাজীবের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক অজানা কথা। স্ট্যাটাসটি হলো "আর কত জীবন অকালে ঝরে যাবে? খুব ভালো করে পৃথিবীটাকে বুঝার আগেই “মা” পৃথিবী থেকে চলে যায়, ছোট দুই ভাই আর বাবা। মা মারা যাবার কিছুদিন পর বাবা অনেকটা পাগলের মতো হয়ে যায়, বাড়ি থেকে হয়ে যায় নিরুদ্দেশ। একদিন পাওয়া যায় মৃতদেহ! কি নিষ্ঠুর বাস্তবতা!! পৃথিবীতে বাবা-মা দুজনের কেউ নেই। ছোট দুই ভাই সহ নানী বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কিছুদিন পরে আবার নানিও মারা যায়। বাবা-মা মারা যাবার পর দাদা-দাদী বা নানা-নানীই আশ্রয়স্থল, কিন্তু দাদী বা নানী মারা যাবার পরে আসলে দূষিত অক্সিজেন ছাড়া আর কিছুই থাকে না দুনিয়ায়। নানা-দাদা অথবা মামা-কাকারা কখনোই সেভাবে আপন হয়ে উঠে না। নানী মারা যাবার পর ঢাকায় খালার বাসায় থেকে হাই স্কুল। আর ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকে ভর্তি হয়। ছোট দুই ভাই এতীমখানায়। নিয়মিত টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতো আর এক্সট্রা কিছু ইনকাম করতে কম্পিউটার কম্পোজ, গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ। উদ্দেশ্য একটাই নিজে কিছু করা। মা-বাবা কেউ নেই ছোট দুইটা ভাই এতীমখানায়..... সেদিন খালার কাছে গেলে খালা বিয়ে করে জীবন শুরু করতে বলে কিন্তু তার উত্তর “খালা সবকিছুই গুছিয়ে নিয়ে এসেছি, অল্প কিছুদিন পরেই সব সমাধান হয়ে যাবে। ঠিক তার পরের দিন দুই বাসের প্রতিযোগিতায় ডান হাত ছিড়ে যায়। লেগে থাকে অন্য গাড়িতে, মাথার খুলি ভেঙ্গে যায়। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। একটানা ৭ দিন অচেতন। গতকাল রাত ১২টা ৪০ মিনিটে পৃথিবী ছেড়ে মা-বাবার কাছে চলে যায় রাজীব। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ছোট দুই ভাই এখনো এতীমখানায়... গরু-ছাগল চিনতে পারলেই হয়তো আমরা ড্রাইভারি লাইসেন্স দিয়ে দিবো, দুই-তিন হাজার টাকা এক্সট্রা দালালকে দিয়েই করিয়ে নিবো ড্রাইভারি লাইসেন্স। কিন্তু এমন হাজার হাজার রাজিবের কাছে কি জবাব দিবো? তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।"

জীবন সংগ্রামকে পুঁজি করে স্বপ্ন পূরণের পথে ছিল তার যাত্রা। সে যাত্রা পিষ্ঠ হয় রাস্তায়। এখনই আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সময়।

টিকে