ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

বেপরোয়া চালক, অসতর্ক পথচারীতে বাড়ছে দুর্ঘটনা

প্রকাশিত : ০৮:৫২ পিএম, ১৮ এপ্রিল ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ১০:০৯ এএম, ১৯ এপ্রিল ২০১৮ বৃহস্পতিবার

বেপরোয়া চালক আর অসতর্ক পথচারীর যত্রতত্র পারাপার সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাস মালিকরা অর্থবিত্তে বলীয়ান, রাজনৈতিক ক্ষমতায় প্রতাপশালী হওয়ার কারণে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনার মামলা হলেও সুস্থ বিচার পায় না ভুক্তভুগীরা। অনেকেই আবার মামলা করেন না।

জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকা থেকে বিজয় সরণি মোড় ও এর আশপাশের সড়কগুলোতে দুর্ঘটনা বেড়েছে। শাহবাগ, রমনা ও তেজগাঁও থানার তথ্য মতে, শাহবাগ থানায় ২০১৫ সালে বেপরোয়া গাড়ি চাপায় মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয় আটটি। অথচ এর পরের বছর ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৯টি। আর ২০১৭ সালেই মামলা হয়েছে ১৬টি। একই চিত্র তেজগাঁও থানাতেও। ২০১৫ সালে তেজগাঁও থানায় নয়টি মামলা হলেও পরের বছর সড়কে মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৬টি। চলতি বছর শুরু থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত এই তিনটি থানায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনায় আরও ১০টি মামলা করেছে ভুক্তভোগী পরিবার।

এবিষয় সহকারী কমিশনার সাইফুল আলম মোজাহিদ ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগে কর্মরত আছেন। গত ২৬ মার্চ ভোরে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য চকবাজারের বাসা থেকে পুলিশের গাড়িতে করে দারুস সালাম যাচ্ছিলেন। শাহবাগ মোড়ে মৎস্য ভবন থেকে আসা একটি ট্রাক তাঁদের গাড়িকে ধাক্কা দেয়। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ওই গাড়ি থেকে পুলিশ কর্মকর্তা মুজাহিদ ও তাঁর গাড়িচালক পুলিশ কনস্টেবল কামাল উদ্দিনকে উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। কয়েক দিন আগে হাসপাতাল থেকে বাসায় আসা অসুস্থ এই পুলিশ কর্মকর্তা এখনো কাজে যোগ দিতে পারেননি।

দুই যুগের বেশি সময় ধরে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কাজ করে যাচ্ছে নিরাপদ সড়ক চাই নামের সংগঠনটি। এর চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলছিলেন, চালকেরা কোনো মতে গাড়ি চালাতে জানেন। তাঁদের নেই প্রশিক্ষণ আবার অনেকেই মাদকাসক্ত। তাঁদের সংগঠন অনেক শক্তিশালী। এ কারণে তাঁদের অনেক সাহস। তাঁরা ইচ্ছা মতো গাড়ি চালান।

পাঁচজন হেলপার ও গাড়িচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাস মালিককে জমা বাবদ দৈনিক আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা দিতে হয়। এতো টাকা জমা দিয়ে ভালো ভাবে চলার মতো তাদের উপার্জন হয় না।  বাসচালক রশিদ বলছিলেন, পাঁচ বছর আগেও দিনে বাস মালিককে দিতে হতো ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা। অথচ এখন দৈনিক ২৮০০ টাকা দিতে হচ্ছে। তেলের খরচ, হেলপারদের বেতনসহ বিভিন্ন খরচ মেটানোর পর যদি কিছু থাকে, তা নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়।

বিআরটিসি বাসের সুপারভাইজার বিল্লাল হোসেন বলেন, বাস মালিক ভাড়া বাড়ানোর কারণে চালক চাপে থাকেন। দ্রুত যাত্রী তোলার জন্য প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

বাস চালকেরা বেশি লাভের আশায় মালিকদের কাছ থেকে বাস ভাড়া নিচ্ছেন বলে জানান ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।  তিনি বলেন, বেশি লাভের আশায় রাস্তায় চালকেরা তাড়াহুড়ো করে থাকেন। এ কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। আর কম বয়সী অদক্ষ চালকেরাও বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন।

বাস চালকদের কাছে মালিকেরা যাতে এভাবে বাস বাড়া না দিতে পারেন, সে জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।

চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন মনে করেন, কয়েক বছর ধরে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। এর কারণ দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের নিয়ে সরকারের মাথা ব্যথা নেই। ২০০৯ সালের পরপরই  সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যেভাবে কাজ করে, এখন সেভাবে কাজ করছে না।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কাঁচামালের কাজ করতেন বরিশালের বাকেরগঞ্জের খোকন মৃধা। স্ত্রী হাজেরা বেগম এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বরিশালে বাস করেন। সংসার খরচ বাবদ মাসে সাত হাজার টাকা পাঠাতেন খোকন। ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হাজেরা জানতে পারেন, তাঁর স্বামী খোকন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
স্বামীকে হারানোর পর কীভাবে সংসার চলছে, জানতে চাইলে হাজেরা বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে বড় বিপদে আছি। পরের বাড়িতে কাজ করে কোনোমতে বেঁচে আছি।

খোকনের মৃত্যুর বিষয়ে হাজেরা বলেন, প্রাইভেটকারের ধাক্কায় আমার স্বামী মারা যান। তার মালিক অনেক বড়লোক। সেই গাড়িও তিনি ছাড়িয়ে নিয়েছেন। গাড়ির চালকও জামিনে আছেন।

জনতা ব্যাংকের নিরাপত্তারক্ষী আবুল হাশেম জাতীয় জাদুঘরের সামনে মারা যান গত ৭ জানুয়ারি। তাঁর চাচাতো ভাই মিজানুর রহমান বললেন, ঢাকায় চাকরি করে দুই ছেলে সাইদুল ও হাসানের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন তাঁর ভাই। সড়ক দুর্ঘটনায় তার ভাই মারা যাওয়ার কারণে এখন তাঁদের খরচ কে চালাবে? লেখাপড়া ছেড়ে এখন তাঁরা কাজে নেমেছেন।

টিকে