ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

স্মার্টফোন আসক্তি, বাড়ছে অশান্তি

 আলী আদনান

প্রকাশিত : ০৪:২১ পিএম, ২১ এপ্রিল ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৪:২৯ পিএম, ২১ এপ্রিল ২০১৮ শনিবার

রাজধানীর একটি স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ছে শমসের আলী জিতু। তার বাবা তৃতীয় গ্রেডে সরকারি চাকরি করেন। মা গৃহিণী। জিতু`র বড় বোন ঢাকার একটি কলেজের ছাত্রী। আর ছোট ভাই ক্লাস ফোরে পড়ে। ইদানীং জিতুর খুব মন খারাপ। ক্লাসে বন্ধুদের সাথে আগের মতো মেশেনা। বাসায় আগের সেই হৈ-হুল্লোড় নেই। জিতুর মা প্রথম দিকে বুঝে উঠতে পারেন নি বিষয়টি কী। কিন্তু কয়েকদিন পর তার কাছে আসল ব্যাপার পরিষ্কার হয়। জিতুর সহপাঠীদের সবার হাতেই স্মার্ট ফোন আছে। জিতু এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বায়না করেছে তাকে একটি স্মার্ট ফোন কিনে দেওয়ার জন্য।


তার বাবা ধমক দিয়ে বলেছেন, ‘ভাল করে পড়। এখন তুই স্মার্ট ফোন দিয়ে কী করবি’? জিতু এখন ক্লাসে হীনমন্যতায় ভোগে। সবাই ক্লাসে ফোন নিয়ে আসে। ক্লাসে সুযোগ পেলেই মোবাইল ফোনে নানা ধরণের গেমস নিয়ে মেতে থাকে তারা। বন্ধুদের অনেকের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। তারা ফেসবুকে নানা ধরনের ছবি পোষ্ট দেয়। কিন্তু জিতু পারে না। তাই নিজেকে ছোট মনে হয় জিতুর।

এদিকে রাজধানীর একটি কলেজে সবে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে জিতুর বোন শারমিন।বন্ধুদের সবাই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক বা হোয়াটসএ্যাপ ব্যবহার করে। এরইমধ্যে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রাখতে মন দেওয়া নেওয়া করে ফেলেছেন শারমিন। তবে ইচ্ছে করলেই সে মনের মানুষটির সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতে পারেনা, ছবি শেয়ার করতে পারে না।বাবা-মায়ের কাছে বলে লাভ নেই, জিতুর ঘটনা থেকে টের পায় সে।

তবে এসএসসি পরীক্ষার পর মা তাকে কানের দুল পড়িয়ে দিয়েছিল। দুলগুলো তার নানীর স্মৃতি।শারমিন দুল জোড়া পড়েনা। আলমারীতে পড়ে আছে। স্মার্ট ফোনের টাকা জোগাড় করতে দুল জোড়ার দিকে হাত বাড়ায় শারমিন। কোনো রকমে মায়ের হাতে ধরা খেলে কেমন অভিনয় করবে তাও মনে মনে রিহার্সেল করতে থাকে শারমিন।

এবার আসা যাক মাহফুযের কথায়। মাহফুয ডিগ্রী পাশ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করছে গত আট মাস। তার গাড়ি ভাড়া ছাড়া বাকি টাকাটা সে খুব যত্ন করে জমায়। জমানোর কারণ তার একটি ভাল এন্ড্রয়েড ফোন চায়-ই চায়। দৈনন্দিন জীবনে আর কিছু দরকার নেই। শুধু চায়, একটি স্মার্ট ফোন।

জিতু, শারমিন বা মাহফুয নয়। দেশের সব বয়সের ছেলে-মেয়েদের কাছে আকর্ষণের বস্তু স্মার্ট ফোন। স্মার্ট ফোন হাতে না থাকলে স্মার্ট হওয়া যাবেনা, এমনটাই বিশ্বাস সকলের। দৈনন্দিন জীবনে কাপড়-চোপড় বা খাওয়া দাওয়ার চাইতে স্মার্ট ফোনের গুরুত্ব কম নয়। তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের সূত্র অনুযায়ী দেশে স্মার্টফোন ব্যবহার কারীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। এদের বড় একটি অংশ অপ্রাপ্ত বয়স্ক তরুণ-তরুণী।

স্মার্ট ফোন আমাদের জীবনের একটি অনুসঙ্গ। প্রযুক্তির প্রসারে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ট্যাঙ্গো, টুইটার, ইনস্ট্রাগ্রাম, গুগল, মেইল এসব এখন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর এসবের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ নিশ্চিত করে স্মার্ট ফোন। কিন্তু স্মার্ট ফোনের জন্য মরিয়া হয়ে যাওয়া বা স্মার্ট ফোন না থাকলে হীণমন্যতায় ভোগা তরুণদের জীবন অনেকটা অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।

মনোবিদদের ভাষ্য অনুযায়ী হীনমন্যতায় ভোগার ফলে মানুষ তার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। সব কিছুতেই তার মধ্যে `না` বোধক মনোভাব তৈরী হয়। অতিরিক্ত হীনমন্যতা তার মধ্যে বিষন্নতার জন্ম দেয়।স্মার্ট ফোনের অতিরিক্তি আসক্তি তরুণদেরকে অপরাধে উৎসাহী করে। তারা স্মার্ট ফোন কেনার টাকা যোগাড় করতে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে পা বাড়ায়।

একটি জরিপে দেখা গেছে, গত এক বছরে দেশে শিশু- কিশোররা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে খুন হওয়ার সংখ্যা ২২৩টি। এর মধ্যে ১০৬ টি ঘটনা ঘটেছে মোবাইল ফোন কেনার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে। যা শেষ পর্যন্ত হাতাহাতি থেকে খুনাখুনি পর্যন্ত গড়ায়। রাজধানীর একটি স্কুলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষিকা জানান, ক্লাসে একজনের ব্যাগ থেকে অন্যজন মোবাইল চুরি হওয়ার বা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাও প্রায়ই ঘটে।

রাশেদা আকতার একজন গৃহিনী। স্বামী সন্তান নিয়ে মোটামুটি সুখের সংসার ছিল তার। তার বড় ছেলে অভ্র এবার ক্লাস টেনে পড়ছে। স্মার্ট ফোন কেনার বায়না মেটাতে শেষ পর্যন্ত হাত দিতে হয় দীর্ঘদিনের জমানো ব্যাংক এ্যাকাউন্টে। কিন্তু মোবাইল ফোন কেনার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে তা ছিনতাই হয়। অভ্র এখন আবার বায়না করছে তাকে নতুন স্মার্ট ফোন কিনে দেওয়ার জন্য।

বাজারে বর্তমানে হরেক রকমের স্মার্ট ফোন পাওয়া যায়। মোটামুটি চলনসই একটি স্মার্ট ফোন কিনতে গুনতে হয় কমপক্ষে আট হাজার টাকা। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য এটাকাটা অনেক সময় পুরো এক মাসের খরচ বা খরচের একটি অংশ। সেখানে সন্তানদের স্মার্ট ফোন কেনার বায়না, বা স্মার্ট ফোন না থাকলে হীন মন্যতায় ভোগা ওই পরিবারের জন্য অশান্তি ডেকে আনে। যা
আমাদের কারো কাম্য নয়।

এএ/ এমজে