কোটা সংস্কার
প্রজ্ঞাপনের দিকে তাকিয়ে শিক্ষার্থীরা
তবিবুর রহমান
প্রকাশিত : ০৩:২৬ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৫:৩১ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০১৮ সোমবার
সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কারে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ১২দিন পার হলেও জারি হয়নি প্রজ্ঞাপন। কবে নাগাদ প্রজ্ঞাপন জারি হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারছেন না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। তাই আশা-নিরাশার দোলাচলে আন্দোলনকারীরা। হতাশা থেকে তাদের মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভও।
কোটার সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারি করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ বিষয় জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাঁদের কাছে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা নেই। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা পেলে কাজ শুরু করবেন তারা।
সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। শিক্ষার্থীদের টানা ৪ দিনের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের অন্যভাবে চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় আন্দোলন এক মাসের জন্য স্থগিত করে শিক্ষার্থীরা। তারা ঘরে ফিরে যায়।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ১২দিন কেটে গেলেও আজও প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করার কথা থাকলেও এখনও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আরব ও যুক্তরাজ্যে সফরে রয়েছেন। আট দিনের সফর শেষে আগামীকাল সোমবার তাঁর দেশে ফেরার কথা। ফলে এ বিষয়ে আরও সময় লাগতে পারে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা গত বৃহস্পতিবার বলেছিলেন, একটু সময় লাগলেও প্রজ্ঞাপন জারিতে কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ এখন কোনো নিয়োগ পরীক্ষা নেই।
এদিকে এই আন্দোলন আর যেন দানা বাঁধতে না পারে সেজন্য নানামুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্মের তিন নেতাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি। তাদের ছেড়ে দেওয়া হলেও আন্দোলনকারীদের মধ্যে এক ধরণের উদ্বেগ ও ক্ষোভ কাজ করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আন্দোলনকারীদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র বলেন, আন্দোলন যেন আর জমে না উঠে এ নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তা জোরদারের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। কাউকে কাউকে হল থেকে বেরও করে দেওয়া হচ্ছে।
একসময় ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ নিলেও আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেক শিক্ষার্থীকে ছাত্রদল-শিবির বানাতে মরিয়া একটি পক্ষ। ফলে আতঙ্কে হল ছাড়ছেন অনেক শিক্ষার্থী। আবার কেউ কেউ নিজেকে বিপদমুক্ত রাখতে আগের স্ট্যাটাস ডিলিট করে আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে মুঠোফোন তল্লাশি করে গভীর রাতে সুফিয়া কামাল হল থেকে তিন ছাত্রীকে তাদের অভিভাবকের হাতে তুলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যদিও সমলোচনার মুখে তিন ছাত্রীকে গতরাতে হলে ফিরিয়ে এসেছে প্রশাসন। ক্যাম্পাসে বাড়ানো হয়েছে ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের নজরদারি। হলে হলে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের তালিকাও তৈরি করা হচ্ছে গোপনে। অনেক শিক্ষার্থীর অভিযোগ অনেককে গেস্টরুমে ডেকে হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলনের পক্ষে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন তাদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, সবসময় আতঙ্কের মধ্যে থাকি। দিনের বেলায় হলে থাকি না। রাতে হলে আসার পর আতঙ্ক বেশি কাজ করে। কারণ সিনিয়ররা কখন ডাকেন এ চিন্তায় ঘুম হয় না। মাস্টার দা সূর্য সেন হলের এক শিক্ষার্থী জানান, হলে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বড় ভাইয়েরা আগের মতো আচরণ করছেন। তবে কেমন যেন ভয়ের মধ্যে থাকি। কখন কি হয় সেটা তো বলা যায় না। এমন চিত্র অন্যান্য হলগুলোতেও। তবে বেশি ভীতি ছড়িয়েছে কবি সুফিয়া কামাল হলে। ওই হলে গত ১০ই এপ্রিল আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রীদের মারধরের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রলীগ থেকে বহিস্কৃত হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান এশার বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। একই হল থেকে গভীর রাতে তিন শিক্ষার্থীকে অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক-উৎকন্ঠা বাড়ছে।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, হলে হলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও মাস্টার দা সূর্য সেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। তিনি বলেন, প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভা হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা যেকোনো মূল্যে নিশ্চিত করা হবে। হলগুলোতে যাতে একটা স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করে সেজন্য হলে হলে কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম করা হবে।
এদিকে আন্দোলনে যাতে শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে না পারে সেজন্য হলের পাশাপাশি লাইব্রেরিগুলোতে অবস্থান নিচ্ছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এই উদ্বেগ-আতঙ্কের মধ্যেও নতুন আলটিমেটাম দিয়েছেন আন্দোলনকারীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। গত শুক্রবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে গভীর রাতে হলে থেকে বের করে দেওয়া প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করছে শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিল থেকে হল থেকে যেসব ছাত্রীদের করে দেওয়া হয়েছে তাদেরকে হলে প্রত্যাবাসনের দাবি জানানো হয়েছে। এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে তারা আগামী সাতদিনের মধ্যে মামলা প্রত্যাহার না করলে সারা দেশে আবারও ছাত্র ধর্মঘটে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
গভীর রাতে ছাত্রীদের ‘বের করে দেওয়া’ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের হয়রানি করা হয়নি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রীদের অভিভাবক ডেকে এনে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, হল কর্তৃপক্ষ অভিভাবক সুলভ আচরণ করেছে। তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে অভিভাবকদের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ফেসবুকে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে এটি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে গুজব, উসকানি ও মিথ্যা কথা ছড়ানো হচ্ছে। কোনো গুজবে কান দেবেন না।
প্রসঙ্গত, সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটার সংস্কার চেয়ে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্দোলন করে আসছেন। ৮ এপ্রিল শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার কারণে আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। এর জের ধরে সারা দেশেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এ অবস্থায় ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের পক্ষে মত দেন। এই ঘোষণার পর প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিত করেন আন্দোলনকারী।
বর্তমানে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত; এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ।
/টিআর/ এআর