রোমাঞ্চকর কেওক্রাডং ভ্রমণ
প্রকাশিত : ০৩:৪৭ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৪:০৯ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০১৮ সোমবার
ভ্রমণ মানেই প্রশান্তি। ভ্রমণ মানেই ক্লান্তি দূর করার প্রাকৃতিক ঔষধ। কিন্তু এমন কিছু ভ্রমণ আছে যা আপনার শরীরের ঘাম ঝড়াবে। তবে এ নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, কষ্ট হলেও আনন্দটা হবে পর্বত চূড়ার উপর। পাহাড়ের চূড়ায় বসে ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন। বলছি- কেওক্রাডং এর কথা।
আজ শুনাবো কেওক্রাডং ভ্রমণের গল্প। দেশের ভ্রমণপিয়াসী মানুষের কাছে বান্দরবান একটি প্রিয় নাম। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণ তালিকায় এ অঞ্চলটি শীর্ষে। যদিও বর্ষা মৌসুমে পাহাড় নিরাপদ নয়, তবে গল্পটা শুনে রাখলে সময় করে ঘুরে আসতে পারবেন।
বান্দরবান শহরের পাশে নীলগিরি, নীলাচল, স্বর্ণ মন্দির, চিম্বুক পাহাড় আর মেঘলা জায়গাগুলো বেশ জনপ্রিয় পর্যটকদের কাছে। পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, ট্রাভেল সঙ্গী কিংবা প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে ঘোরার দারুণ জায়গা এই বান্দরবান। চাইলেই চট করে একটা গাড়ি নিয়ে সবাই মিলে ঘুরে আসা যায়। তবে অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী হলে আপনার যেতে হবে বান্দরবানের গহিনে। তাহলেই পাবেন ট্র্যাকিংয়ের রোমাঞ্চ। দেশের ট্র্যাকারদের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট হচ্ছে বগা লেক-কেওক্রাডং-জাদিপাই। দু-তিন দিন হাতে সময় নিয়ে দুর্দান্ত একটি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে আসতে পারবেন। সেই গ্যারান্টি আমি দিতে পারি।
বান্দরবানে বছরের যেকোনো সময়ই যাওয়া যায়। তবে হালকা বর্ষা আর শীতকালকেই বেশির ভাগ মানুষ বেছে নেন। গরমকালে পাহাড়ে ওঠাটা একটু কষ্টকর। তবে ভরা বর্ষা মৌসুমে পাহাড় বিপদজনক হয়ে উঠছে। যা হোক; রোমাঞ্চ ও অ্যাডভেঞ্চার করতে গেলে একটু ঝুঁকি তো নিতেই হবে। এ ক্ষেত্রে কোনোভাবেই সাহস হারালে চলবে না। কিশোর থেকে বুড়ো কিংবা পাতলা থেকে বেজায় মোটা মানুষও জয় করেছে কেওক্রাডং। এই পাহাড় জয় করতে হলে শরীরের সক্ষমতার চেয়ে মানসিক দৃঢ়তাই জরুরী।
ঢাকা থেকে বান্দরবান যেতে চাইলে বাস এবং ট্রেন, দুভাবেই যাওয়া যায়। তবে সরাসরি যেতে চাইলে যেতে হবে বাসে। বিভিন্ন কোম্পানির বাস আছে, যেগুলো বিভিন্ন সময় ঢাকা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। কল্যাণপুর কিংবা আরামবাগ থেকে বাসে উঠতে হবে। টিকিট করতে হবে অন্তত একদিন আগে। এ জন্য এক হাজার টাকা বাজেট রাখলেই হবে।
ঢাকা থেকে রাতে রওনা দেওয়াই ভালো। আমরাও রাতে রওনা দিয়েছিলাম। এর একটা কারণ রয়েছে। ভোরে বান্দরবান শহরে পৌঁছে দিনে দিনে শুরু করতে পারবেন ভ্রমণ যাত্রা। আবার শহরে একদিন কাটিয়ে পরদিন থেকে শুরু করতে পারেন অ্যাডভেঞ্চার। আমরাও প্রথম দিন বান্দরবান শহরের স্পটগুলো ঘুরে দেখেছি। শহরে যে স্পটগুলো রয়েছে তা একদিনে শেষ করা যায় না। তারপরও অল্প সময় ব্যয় করে সবগুলো স্পটেই পা ছুঁয়ে আসলাম।
বান্দরবান শহরে পৌঁছে আগে ফিরতি টিকিট কেটে নিলাম। টিকিট করে খুঁজতে বের হলমা হোটেল। বলে রাখা ভালো, শহরের হোটেলগুলোর অবস্থা মোটামুটি ভালো। তবে ঢাকা থেকে ফোনে যোগাযোগ করে অনেকেই আগে থেকে হোটেল বুকিং দেয়। আমার অভিজ্ঞতায় একটা কথা বলি- যারা প্রথমবার বান্দরবান ভ্রমণে যাতে চান তারা সেখানে পৌঁছানোর পর নিজের চোখে দেখে তবেই হোটেল বুকিং করবেন। কারণ পছন্দ মত রুম পেতে হলে এটাই উত্তম। তবে হোটেল ম্যানেজারের কাছে আকাশচুম্বী ভাড়া শুনে ভয় পাবেন না। দরদাম করার সব কৌশল কাজে লাগান।
শহরের সব জায়গার খাবার কিন্তু ভালো না। তবে কিছু ভালো রেস্তরা রয়েছে। যা আপনাকে চিনে নিতে হবে।
শহরের পাশে স্বর্ণ মন্দির, নীলাচল কিংবা মেঘলা ঘুরে আসতে পারেন। সে ক্ষেত্রে চলাচলের জন্য ব্যবহার করতে হবে সিএনজি অথবা চান্দের গাড়ি। একেবারে রিজার্ভ করে নিলে ভালো।
আজকের আলোচনা যেহেতু কেওক্রাডং, তাই অন্য স্পটগুলো নিয়ে খুব বেশি বলছি না। সোজা চলে যাচ্ছি অ্যাডভেঞ্চারে। বগা লেক সম্পর্কে তো নিশ্চই ধারণা আছে? অসাধারণ একটি জায়গা। যেখানে যেতে আপনাকে সবার আগে পৌঁছাতে হবে রুমায়। বান্দরবান শহরের যেকোনো জায়গা থেকে একটি অটো কিংবা সিএনজি নিয়ে যান রুমার বাসস্ট্যান্ডে। চালককে বললেই সে আপনাকে পৌঁছে দেবে। সেখানে গিয়ে বাস ধরতে হবে রুমার। দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বাস রুমার উদ্দেশে রওনা হয়। আঁকাবাঁকা আর উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে আপনি এগোতে থাকবেন রুমার উদ্দেশে। এই যাত্রাকে আরামদায়ক করতে চাইলে একটি জিপ রিজার্ভ নিন।
রুমায় নেমে পড়ুন। এবার যেতে হবে রুমা বাজার। সে ক্ষেত্রে চান্দের গাড়ি ছাড়া উপায় নেই। বাজারে এসে সবার আগে ঠিক করতে হবে গাইড। গাইডের বেশ কয়েকটি সমিতি আছে। যেকোনো একটা থেকে বেছে নিন। গাইডের ভাড়া এক হাজার টাকা থেকে শুরু। ঋতুভেদে আরও বাড়বে-কমবে। তবে ভালো হয় আগে থেকে কোনো গাইডের সঙ্গে কথা বলে গেলে। গাইডের সঙ্গে আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে নাম অ্যান্ট্রি করে ফেলুন। মনে রাখবেন, আপনার যাত্রার জায়গায় জায়গায় গাইডসহ ট্যুর টিমের সবার নাম অ্যান্ট্রি করতে হবে। কখনোই এটি ফাঁকি দিতে যাবেন না, কারণ এটি আপনাদের ভালোর জন্য করা হয়। নাম অ্যান্ট্রি শেষে বাজার থেকে কিছু শুকনো খাবার কিনে নিন।
যাত্রা শুরু হলো কমলা বাজারের উদ্দেশে। সেখান থেকে ট্র্যাকিং করে যেতে হয় বগা লেক। কমলা বাজার পর্যন্ত যেতে লাগবে চান্দের গাড়ি। সেটি আপনার গাইডই ঠিক করে দেবে। প্রায় দুই ঘণ্টার ঝাঁকি আর ধুলামিশ্রিত যাত্রা শেষে আপনি পৌঁছাবেন কমলা বাজার। সেখান থেকে লাঠি কিনে নিন। লাঠি পরবর্তীতে অনেক কাজে লাগবে আপনার।
এবার শুরু করুন পাহাড়ে ওঠা। বগা লেক ওঠার পথটা বেশ খাঁড়া। তাই হয়তো অল্প কিছুক্ষণের মাঝে হাঁপিয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু দমে গেলে চলবে না। একটু একটু করে বিশ্রাম নিয়ে আর পানির বোতল খুলে মুখ ভিজিয়ে আবার হাঁটা শুরু করুন। ভুলেও পানি খেয়ে পেট ভারী করবেন না। পেট ভারী হলে আর হাঁটতে পারবেন না। আধাঘণ্টা ট্র্যাকিং শেষে পৌঁছে যাবেন বগা লেক।
ক্লান্তিভরা চোখ জুড়িয়ে যাবে মুহুর্তে। সমুদ্র থেকে প্রায় এক হাজার ৭০০ ফুট ওপরে পাহাড়ের চূড়ায় ১৫ একর জায়গার এ রকম লেক আর কোথায় মিলবে না। এই লেকটি তৈরি হয়েছিল একটি মৃত আগ্নেয়গিরি পানি চুয়ে চুয়ে। তাই একে ড্রাগন লেকও বলা হয়।
বগায় পৌঁছে আর্মির ক্যাম্পে রিপোর্ট শেষে উঠে পড়ুন কোন একটি কটেজে। এগুলো আপনার গাইডই ম্যানেজ করবে। কটেজে ব্যাগগুলো রেখে ঝুপঝাপ লাফিয়ে পড়ুন লেকের পানিতে। স্বচ্ছ আর ঠাণ্ডা পানিতে নিজেকে শীতল করে নিন। বগা লেকের রাতের সৌন্দর্য দেখতে থেকে যান এক রাত। আর যদি সেদিন পূর্ণিমা হয়, তবে তো আর কথাই নেই। চাঁদের আলোতে বগা লেক যেনো নববধুর সাজে সজ্জিত হয়।
রাত শেষে পরদিন ঘুম থেকে উঠুন অনেক সকালে। পারলে সূর্য ওঠার আগেই। ঘুম থেকে উঠে খিচুড়ি আর ডিম ভাজি খেয়ে নিন। ভুলেও পেট খালি রাখবেন না। কারণ এখনই শুরু হতে যাচ্ছে আপনার কেওক্রাডং জয়ের যাত্রা। যাওয়ার সময় ভারী জিনিস সব কটেজে রেখে যাবেন।
কেওক্রাডং যাবার পথে চিংড়ি ঝরনা পড়বে। দেখে নিন ঝরনার আসল রূপ। দুই ঘণ্টা পর এসে পৌঁছাবেন দার্জিলিংপাড়া। এ পাড়ায় দার্জিলিংয়ের মতো ঠাণ্ডা দেখে এমন নামকরণ। গ্রামটি এমনিতে অনেক সুন্দর। এখানে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে শুরু করুন কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশে শেষ যাত্রা। আরও প্রায় আধা ঘণ্টা ট্রেকিং শেষে আপনি পা রাখবেন কেওক্রাডংয়ে। কেওক্রাডং নামটি এসেছে মারমা ভাষা থেকে। মারমা ভাষায় ‘কেও’ মানে পাথর, ‘ক্রা’ মানে পাহাড় আর এবং ‘ডং’ মানে সবচেয়ে উঁচু। অর্থাৎ কেওক্রাডং মানে সবচেয়ে উঁচু পাথরের পাহাড়। কেওক্রাডংয়ে পা রাখাটা হতে পারে আপনার জীবনের অন্যতম সেরা একটি মুহূর্ত।
আশপাশে যা দেখবেন, সবকিছু আপনার পায়ের অনেক নিচে। ইচ্ছামতো লাফালাফি আর ছবি তুলে নিন। যদি কেওক্রাডংয়ে রাত কাটানোর ইচ্ছে থাকে, তাহলে দুপুরে খাওয়ার অর্ডার এবং রাতে কটেজে বুকিং দিয়ে ফেলুন। অনেকে একই দিনে আবার বগাতেই ফিরে যায়। কিন্তু কেওক্রাডংয়ে রাত কাটানোর মতো লোভনীয় সুযোগ আর হবে না। আমরা একটি রাত সেখানেই কটিয়েছিলাম। যদিও আমাদের প্লানে এটি ছিল না। কিন্তু আমরা লোভ সামলাতে পারিনি।
এবার আমাদের শেষ লক্ষ্য জাদিপাই ঝরনা। সারা দিন ট্রেকিং করার কারণে একটু ক্লান্তি এবং দুর্বল লাগবে জাদিপাই নামতে গিয়ে। তবে জয় করা খুব একটা কঠিন না। প্রথমে পাসিংপাড়া এবং এরপর জাদিপাইপাড়া পাড়ি দিয়ে মোট দুই ঘণ্টার মতো লাগবে আপনার জাদিপাই ঝরনা পৌঁছাতে। পথে বেশ দূর থেকেই ঝরনার আওয়াজ শুনতে পাবেন। যদি বর্ষায় আসেন তবে ঝরনার আসল তেজ দেখতে পাবেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ঝরনার নেমে আসা পানিতে দেখা যায় স্পষ্ট রংধনু। এটি একেবারেই বিরল।
আপনার ট্র্যাকিং রুট এখানেই শেষ। এবার সময় হলা ফেরার। ঠিক আগের মতো করেই। তবে এবার ফিরতে একটু কষ্ট হতে পারে। জাদিপাই থেকে কেওক্রাডংয়ে ওঠার রাস্তাটা মোটামুটি বেশ খাড়া। তাই পানি এবং হালকা খাবার নিয়ে গেলে শক্তি পাবেন। কেওক্রাডংয়ে ফিরে খেয়ে আবার বিশ্রাম করুন কটেজে। সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখতে উঠে যান আবার চূড়ায়। অসাধারণ এক অনুভূতি হবে। ঠিক আগের মতোই শেষ করতে থাকুন অসাধারণ এই অ্যাডভেঞ্চার।
পুরো ট্র্যাকিংয়ে আপনাকে মুগ্ধ করবে পায়ের নিচে থাকা মেঘগুলো। মুগ্ধ হবেন স্থানীয় মানুষের সরলতা এবং আন্তরিকতা।
মনে রাখবেন- খুব বেশি জামাকাপড় নেবেন না। শুধু যেগুলো একদম না নিলেই নয়, সেগুলো নেবেন। ব্যাকপ্যাক নেবেন। হাতের কোনো ব্যাগ নিলে চলবে না। পানির বোতল নেবেন হাফ লিটারের। সেটাতে যেন সব সময়ই পানি থাকে। স্যালাইন রাখবেন সঙ্গে। জোঁকের সংক্রমণ আছে। তাই লবণ নেবেন সঙ্গে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে ওডমস ক্রিম রাখুন। ট্র্যাকিংয়ের সময় শুকনা খাবার রাখুন। সারা দিন কলা খান। কলা আপনার পেশিকে কর্মক্ষম রাখবে। হালকা কিছু ওষুধ আর অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম সঙ্গে রাখুন। একটা টর্চলাইট নেবেন কাজে আসবে। মোবাইল চার্জ দেওয়া কিন্তু কঠিন। তাই পারলে একটি পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে নিন।
এসএ/