ঢাকার দেয়ালে নতুন গ্রাফিতি
রহস্যই থেকে যাচ্ছে ‘সুবোধ’
তবিবুর রহমান
প্রকাশিত : ০৫:২৮ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৫:৩২ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০১৮ সোমবার
‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নে ‘, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না, ‘সুবোধ এখন জেলে! পাপবোধ নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে।’ খাঁচায় বন্দি সূর্য হাতে অগোছালো চুল-দাঁড়ির এক তরুণের নাম ‘সুবোধ’। বিধ্বস্ত আর বিপর্যস্ত চেহারার এই সুবোধ ও তাকে উদ্দেশ্য করে এই লেখা এই গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্রগুলো গত বছর আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে দেখা মেলে। এটি পুরোনো খবর। নতুন সংবাদ হলো রাজধানীতে সুবোধ সিরিজের আবারও নতুন দেয়ালচিত্র চোখে পড়ছে। এবারের দেয়ালচিত্রে দেখা যাচ্ছে বিষাদগ্রস্ত এক কিশোরীর অবয়ব। তার বুকে নকশাদার ফ্রেমে বাঁধানো লাল-সবুজের পতাকা নগরবাসীর মনোযোগ কাড়ছে।
রাজধানীর কাকলীতে পদচারী-সেতুর পূর্ব দিকের ফুটপাত ধরে মহাখালীর দিকে এগোতেই দেয়ালচিত্রটি চোখ পড়বে ফুটপাত-সংলগ্ন সাদা দেয়ালের জমিনে। প্রাচীরের ক্যানভাসে আঁকা বিষাদগ্রস্ত এক কিশোরীর অবয়ব। নকশাদার ফ্রেমে বাঁধানো লাল-সবুজের পতাকা। পতাকার গায়ে ঈষৎ কালো ছায়া। কিশোরী ফ্রেমসমেত সেই পতাকাটি বুকে আঁকড়ে ধরে আছে পরম মমতায়। ছবির পাশে লেখা ‘দিস ইজ মাই মাস্টারপিস (এটা আমার শ্রেষ্ঠ কর্ম) । এই গ্রাফিতি আবারও স্মরণ করে দেয় সুবোধ সিরিজের কথা। কাকলীর নতুন এই দেয়ালচিত্রে বিরূপ সময়ের বার্তা নিয়ে হাজির হওয়া সুবোধের উপস্থিতি নেই। কিন্তু এর অঙ্কনপদ্ধতি একই রকম। সুবোধ সিরিজের চিত্রগুলোর মতো এটাও আঁকা হয়েছে স্টেনসিল (লেখা বা আঁকার জন্য ছিদ্রময় পাত) ব্যবহার করে। আর আগের মতোই এই দেয়ালচিত্রের নিচে লোগো আকারে ব্যবহার করা হয়েছে একটি শব্দ: ‘হবেকি?’ (HOBEKI?)। নতুন এই দেয়ালচিত্র দেখে বোঝা যায়, পলায়নপর চরিত্র সুবোধের আঁকিয়ে আর নতুন এই দেয়ালচিত্রের আঁকিয়ে কিংবা আঁকিয়েরা একই। সুবোধের মতোই যাঁর বা যাঁদের পরিচয় এখন পর্যন্ত উদ্ঘাটিত হয়নি।
নগরের বিভিন্ন এলাকার দেয়ালে আলোচিত এই গ্রাফিতি নিয়ে অনেকের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কেউ বলছেন, কোনো রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার শিল্পিত একটা মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। কেউ বলছেন, সমাজের নানা অসংগতি নানা অসমতা দুর্নীতির প্রতিদান স্বরূপ এই গ্রাফিতি ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদা জামান বলেন, দেয়াল লিখন অনেক ধরনের হতে পারে। তবে সুবোধ সিরিজের গ্রাফিতি কী কারণে করা হচ্ছে আমার ধারণা নেই। অন্যান্য দেশেও দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য। কিন্তু আমাদের দেশে কী জন্য এ গ্রাফিতি করা হচ্ছে তা বুঝার উপায় নেই। এটার মূল কারণ আমাদের বের করা উচিত। তিনি মনে করেন, কোনো কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হলে এমন পদ্ধতিতে প্রতিবাদ করা উচিত যাতে করে মানুষ বুঝে এবং সেই উদ্দেশ্য হাসিল হয়। অন্যান্য দেশে কোনো কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ করলে একটা নির্ধারিত জায়গা ঠিক করে দেওয়া হয়। সেখানেই তার বিভিন্ন ধরনের দেয়াল লিখন বা বিক্ষোভ করে। কিন্তু আমাদের দেয়ার লিখন নামে যে বিষয়গুলো লেখা হয় তাতে সমাজে কোন বিরূপ প্রভাব পড়ে না। আমার মনে হয় জনমনে প্রশ্ন তৈরি না করে সঠিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ করা উচিত।
এ প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) আব্দুর রশিদ একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, ‘রাজনীতির ভিতর থেকে কেউ কেউ ভীতি সৃষ্টি করতে দেয়ালে এ ধরনের গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। এগুলো প্রোপাগান্ডা, মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার কৌশল। তিনি বলেন, ‘জনমনে ভীতি সৃষ্টি করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়। একটি ব্যর্থ হলে আরেকটি নতুন কৌশল নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়। এ ধরনের দেয়াল লিখন তেমনি একটি কৌশল।
সূত্রমতে গোয়েন্দাদের ধারণা, এসব দেয়ালচিত্র যারা আঁকছেন আর যাই হোক তাদের নিশ্চয় কোনো না কোনো উদ্দেশ্য আছে। সে উদ্দেশ্য জানতে গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থার চৌকস টিম মাঠে কাজ করছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য এর রূপকার খুঁজে বের করা। তারা মনে করছেন, সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিশেষ চক্র এমন দেয়ালচিত্রের জন্ম দিয়েছে। তার রহস্য দ্রুত বের করতে না পারলে সচেতন মহলে এক ধরনের ভীতি ও আতঙ্ক বাড়তে পারে।
এর আগে ফেসবুকসহ গণমাধ্যমের নানা পরিসরে সুবোধের গ্রাফিতি নিয়ে আলোচনার মধ্যেই এটা নিয়ে তথ্যচিত্র বানান পার্থ প্রতীম দাস নামের এক শৌখিন নির্মাতা। সুবোধ উঠে আসে অনেক তরুণের টি-শার্টে।
ঢাকার দেয়ালে আঁকা ‘সুবোধ’সিরিজের দেয়ালচিত্রগুলোর অনুপ্রেরণায় কলকাতার প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা তাঁদের ক্যাম্পাসে চিত্রিত করেন একাধিক গ্রাফিতি। এই শিক্ষার্থীরা ঢাকার ‘সুবোধ’কে দেখেছেন তাঁদের দাবি আদায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে। তবে ঢাকার গ্রাফিতি আঁকিয়েরা এখন পর্যন্ত অপ্রকাশ্য ও রহস্যময় হয়ে থাকলেও কলকাতায় যাঁরা সুবোধকে এঁকেছেন, তাঁরা সবাই প্রকাশ্য। আঁকার ঢঙেও রয়েছে পার্থক্য।
গত বছরের ২০ আগস্ট ঢাকায় সুবোধের দেয়ালচিত্রগুলো নিয়ে ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ তাদের সাময়িকী ‘সেভেন ডেজ -এ ‘হবেকি? (HOBEKI?)’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে প্রতিবেদক উপলা সেন ঢাকায় সুবোধের দেয়ালচিত্র নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও দর্শন হাজির করার পাশাপাশি এর অনুপ্রেরণায় কলকাতার গ্রাফিতি আঁকিয়ে ও তাঁদের নিজস্ব ভাবনা তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের এসব দেয়ালচিত্রের রূপকাররা আজও শনাক্তহীন রয়ে গেছেন। তাদের পরিচয়, গ্রাফিতির উদ্দেশ্যে কিংবা অর্থ আজও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। তবে কী অভেদ্যই থেকে যাবে সুবোধ?
/ এআর /