ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

রমজানপণ্যের বাজার এখনও স্থিতিশীল, কমেছে চিনির দাম

রিজাউল করিম

প্রকাশিত : ০৭:০২ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৭:০৯ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০১৮ সোমবার

পবিত্র রমজানের এখনও সপ্তাহ তিনেক বাকি। ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে রোযার প্রস্তুতি। রমজানে প্রয়োজনীয় পণ্য আগেভাগে ক্রয় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নগরবাসী। যার ফলে বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে মাংস, ডিম ও মাছসহ কিছু পণ্য। তবে রমজানকে ঘিরে প্রতিবছর ছোলা, বুট, ডাল, রসুন, সয়াবিন, চিনি ও খেজুরের দাম বাড়লেও এবার উল্টো। রমজান নির্ভর ওইসব পণ্যের কোনো কোনোটিতে দাম কমেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে সিন্ডিকেট  ও কারসাজি চক্র এখনও নিস্ক্রিয় আছে। আগের রমজানগুলোতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে খুচরা ব্যবসায়ীরা দুষেছেন পাইকারদের। আর পাইকাররা দুষেছেন সরবরাহ ঘাটতিকে। এবার এখনও এ দোষাদোষির চিত্র দেখা যায়নি। তাই বাজার আপন গতিতে চলছে। আর তার সুফল সাধারণ ক্রেতারা ভোগ করছেন। তারা সহনীয় দামে পণ্য ক্রয় করতে পারছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ ভোক্তাদের কথা চিন্তা করে সরকারের উচিত হবে বাজারের এ সহনীয় দামের চিত্র ধরে রাখতে তদারকি ব্যবস্থা কঠিন ও বলবৎ রাখা।

রমজানকে সামনে রেখে রাজধানীর  কয়েকটি খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা যায়, খুচরা ও পাইকারি বাজারে রমজান মাসে বেশি চাহিদা থাকে এমন পণ্যগুলোর দামের ব্যবধান আগের তুলনায় কম।

আজ সোমবার রাজধানীর পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত কারওয়ান বাজার ও বাবুবাজার এবং খুচরা বাজার হিসেবে পরিচিত রামপুরা বাজার ও ফকিরাপুল বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে সপ্তাহ তিনেক আগেও যে ডিম প্রতি হালি ২৬ টাকা বিক্রি হচ্ছিল। এখন তা হালিপ্রতি ৩০টাকা বিক্রি হচ্ছে। আবার মাংসের মধ্যে পোল্ট্রি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ থেকে ৪৯০ টাকা। সবজির দামও কিছুটা চড়া। প্রতিকেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব পণ্যগুলোর দাম আগের তুলনায় কিছুটা বাড়তি হলেও স্থিতিশীল বা ক্ষেত্রবিশেষে কম দামে বিক্রি হচ্ছে রমজানে চাহিদাপূর্ণ পণ্যগুলো।

খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ছোলা (কালো দেশী) বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা, সাদা ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮৫ টাকা। চিনি ৫৫ টাকা। দেশি পেঁয়াজ ৩৬ টাকা ও ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভোজ্য তেলের মধ্যে খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ৮৮ থেকে ৯০ টাকা। পামওয়েল ৭০ থেকে ৭২ টাকা। বোতলজাত সয়াবিন প্রতি লিটার ১০৮ টাকা থেকে ১১০টাকা এবং ৫ লিটারের বোতলজাত তেল ব্র্যান্ডভেদে ৫০০ থেকে ৫১৫ টাকা। মসুর ডাল ইন্ডিয়ান ৫৬ টাকা, দেশী ৮৫ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আদা ইন্ডিয়ান প্রতিকেজি ৯০ টাকা। খেঁজুর প্যাকেটজাত লাল বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা, শুকনা খেঁজুর বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়।

রমজান আসন্ন হলেও এসব পণ্যের দাম স্থিতিশীল  বা তুলনামূলক কম থাকার কারণ জানতে চাইলে রাজধানীর রামপুরা বাজারে আল্লাহর দান মসল্লা ঘরের প্রোপ্রাইটর মো. রাসেল বলেন, অন্যান্য বার এতোদিন দাম বেড়ে যায়। এবার এখনও দাম বাড়েনি। আমরা ইচ্ছা করলেই দাম বাড়াতে পারি না। পাইকাররা আমাদের কম দামে দিচ্ছে তাই আমরাও দিতে পারছি। এ ধারা সরকার ধরে রাখতে পারলে এবার রমজানে ভোক্তারা পণ্য ক্রয়ে স্বস্তি পাবেন। একই বাজারের ওমর ফারুক ষ্টোরের প্রোপ্রাইটর মো. মিজানুর রহমান বলেন, রমজানকে ঘিরে অধিক চাহিদাপূর্ণ পণ্যগুলোর মজুদও বেড়েছে আবার উৎপাদনও বেড়েছে। দেশে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগও হয়নি। তাই পণ্যের দাম স্থিতিশীল আছে।

খুচরা বাজারের সঙ্গে পাইকারি বাজারে পণ্যের দাম তুলনামূলক দাম জানতে রাজধানীর বাবু বাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারের দামের তুলনায় পাইকারি বাজারের দামে খুব বেশি ব্যবধান নেই। পাইকারি বাজারে প্রতিকেজি ছোলা, বুট, ডাল ও রসুনে ৫ থেকে ১০ টাকা ব্যবধান। সয়াবিন ও চিনিতে ৩ থেকে ৫ টাকা ব্যবধান। আর খেজুরে ১০ থেকে ১৫ টাকা ব্যবধান।

কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের ভাই ভাই জেনারেল ষ্টোরের প্রোপ্রাইটর মো. মাসুম বলেন, পাইকারি ও খুচরা বাজারে রমজাননির্ভর খাদ্য পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ আছে। এখন পর্যন্ত খুচরা ও পাইকারি বাজারে পণ্যের দামও স্থিতিশীল আছে। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশ থাকায় মনে হচ্ছে এবার রমজান মাসে আমদানিকারক ও পাইকাররা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াতে পারবে না। এ বাজারের আনোয়ার  ট্রেডার্সের প্রোপ্রাইটর নজরুল ইসলাম বলেন, এবার রমজান উপলক্ষে পণ্যের দামে কোনো প্রভাব পড়েনি। উল্টো দেখছি চিনির দাম কিছুটা কমেছে। চিনির দাম ক্ষেত্র বিশেষে ২শ’ টাকা পর্যন্ত কমেছে। আমরা এক মাস আগেও ৫০ কেজি ওজনের যে চিনির বস্তা ক্রয় করতাম ২৭শ’ টাকায় এখন সেই একই চিনি বস্তাপ্রতি ২৫শ’ টাকা কিনতে পারছি। তাই বলা যায় এবার রমজানে পণ্যের দাম বাড়েনি। বরং ক্ষেত্র বিশেষে কমেছে। তবে কোনো পণ্যের দাম কমলে আবার সেটা বাড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই রমজানের আগ মুহুর্তে আবার এসব পণ্যের দাম বাড়তেও পারে।

চিনির দাম কমার কারণ জানতে চাইলে বাবু বাজার চিনি ব্যবসায়ী শফিকুল আলম বলেন, পণ্যের দাম বাড়া-কমা বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম। চিনির দামও সে নিয়মেই কমছে। তবে ধারণা করে বলা যায় আগামী রমজান ও ঈদের বাজারকে ধরতে ব্যবসায়ীসহ চিনির মিল মালিকদেরও অনেক টাকার প্রয়োজন পড়ে। তাই রমজানের আগে মিলে মজুদ থাকা অতিরিক্ত পণ্য কম দামে হলেও তারা ছেড়ে দেয়। ঈদের আগ মুহুর্তে নতুন উৎপাদিত পণ্য বাজারে ছাড়ে। তাই রমজানের দুই মাস আগে থেকে চিনির দাম কমেছে। এছাড়া সরকারের বাজার মনিটরিং কঠিন হওয়াও একটি কারণ হতে পারে।

এ বিষয়ে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, চিনিসহ রমজানে অধিক চাহিদাপূর্ণ পণ্যগুলোর দাম বিশ্ববাজারে স্থিতিশীল আছে। যার কারণে আমাদের দেশীয় বাজারও স্থিতিশীল আছে। ইতোমধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ এসব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও রমজানের চাহিদাপূর্ণ পণ্য পরিবহনে কোন প্রকার  চাঁদাবাজি হবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। যার সুফলে বাজারে এখনও পণ্যের দাম বাড়েনি। আমরা আশা করবো আমাদের বন্দরগুলো যথাযথ কার্যক্রমের মাধ্যমে পণ্যের এ দাম স্থিতিশীল-ই থাকবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের অংশ হিসেবে টিসিবি প্রতি বছরই প্রস্তুত থাকে। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ কারণে বাজার এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আছে এবং আগামীতেও পণ্যের দামও বাড়বে না বলে আশা করছি।

বাজার চাহিদার কতটুকু টিসিবি পূরণ করতে পারবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টিসিবির পণ্য দেশের সব শ্রেণীর মানুষের চাহিদা একসঙ্গে পূরণ করতে পারে না। তবে মানুষের চাহিদা পূরণে আমাদের অংশগ্রহণ একেবারে কমও নয়। জরুরি মুহূর্তে বা অন্য যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে প্রতিষ্ঠানটি ২৭৮৪ জন ডিলার রয়েছে। ১৮৭টি ট্রাকসেল কাজ করছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ৩৫টি, চট্টগ্রামে ১০টি, বিভাগীয় শহরে ৪টি এবং জেলা শহরগুলোতে ২টি করে ট্রাকসেল কাজ করবে।এছাড়া ঢাকাসহ সারাদেশে টিসিবির নিজস্ব ১০টি বিশেষ খুচরা সেলের দোকান রয়েছে। যেগুলো রমজানের সময় সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত খুচরা পণ্য বিক্রি করবে। অন্য সময় এ কেন্দ্রগুলো দুপুর ১টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

এবার রমজান উপলক্ষ্যে টিসিবি তিন ধাপে পণ্য সরবরাহ করবে। প্রথম দফায় রমজানের ১০ দিন আগে পণ্য সরবরাহ করা হবে। দ্বিতীয় দফায় রমজানের প্রথম সপ্তাহে এবং তৃতীয় ও শেষ দফায় রমজানের মাঝামাঝি পণ্য সরবরাহ করা হবে। তবে শেষ  দফায় বাজারে পণ্যের চাহিদা বিবেচনা করে পণ্য ছাড়া হবে।

হুমায়ুন কবির বলেন, রমজানকে সামনে রেখে চাহিদার চেয়ে বেশি মজুদ করা হয়েছে ভোজ্যতেল, চিনি ও ডাল। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো রোজার অপরিহার্য পণ্য ছোলা সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।এরইমধ্যে কী পরিমাণ ছোলা মজুদ করা হয়েছে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলে আগামী ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে জানিয়ে দেওয়া হবে। দামের ক্ষেত্রে এতটুকু বলা যায় যে টিসিবির পণ্য বাজার দরের চেয়ে কম দামেই বিক্রি হবে।

আরকে// এআর