ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৫ বছর

দেশের গার্মেন্ট ব্যবসায় কী পরিবর্তন হয়েছে

প্রকাশিত : ০৯:১৫ এএম, ২৪ এপ্রিল ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৪:৪৮ পিএম, ২৪ এপ্রিল ২০১৮ মঙ্গলবার

পোশাক শিল্পের ইতিহাসে বড় ট্র্যাজেডি রানা প্লাজা ধস। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় এক হাজারের বেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হন কয়েক হাজার শ্রমিক। ওই ঘটনা শুধু বাংলাদেশকে নয়, পুরো বিশ্বকে নাড়া দেয়। ওই ঘটনার পর বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা মেনে কারখানার নিরাপত্তা ও পরিবেশ উন্নয়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ায় রানা প্লাজার দুর্ঘটনা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি বলেই মনে করছেন, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও অনেক কারখানার মান উন্নয়নের কাজ বাকি রয়ে গেছে। এছাড়াও সরকারি উদ্যোগে কারাখানাগুলোর পরিবেশ ও শ্রমঅধিকার রক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতারও ঘাটতি রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কার্যকর উন্নতি না আসলে তা ভবিষ্যতে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায় আবারও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

গাজীপুরের পুবাইলে অল ওয়েদার ফ্যাশনস লিমিটেড নামে একটা তৈরি পোশাক কারখানা। এই কারখানায় কাজ করেন এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক।

কারখানায় গিয়ে দেখা গেলো শ্রমিকরা বেশ খোলামেলা পরিবেশে নিজ নিজ সেকশনে কাজে ব্যস্ত। এই কারখানায় এমন অনেকেই আছেন, যারা বিভিন্ন কারখানায় কাজ করছেন বেশ কয়েকবছর ধরে।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর কারখানাগুলোর পরিবেশে যে পরিবর্তন এসেছে তা বেশ স্পষ্ট এসব শ্রমিকের কাছে।

তাদের মধ্যে সুফিয়া বেগম একজন নারী কর্মী বলছিলেন, আগে গার্মেন্টসগুলোতে ট্রেনিং হইতো না। এই কারখানায় গত তিন মাসেই আগুন লাগলে কী করতে হবে সেইটা নিয়ে দুইটা ট্রেনিং করলাম।

রাজিয়া খাতুন নামে আরেকজন বলছিলেন, এখন বেতন নিয়ে আগের মতো `টালবাহনা` নেই। বোনাসও হচ্ছে। কোনও সমস্যা হলে ম্যানেজমেন্টের কাছে অভিযোগও করা যায়।

এসব কারখানার কর্মীরা যেসব পরিবর্তনের কথা বলছিলেন মূলত: এসব পরিবর্তনের কারণেই রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পরও এখানকার পোশাক খাতের ব্যবসা বিশ্ববাজারে টিকে গেছে।

বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা মেনে একের পর এক কারখানা শামিল হয়েছে নিরাপত্তা ও পরিবেশের উন্নয়নে। কিন্তু কারাখানার মান উন্নয়নের মাধ্যমে বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা ফেরানোটা কতটা কঠিন ছিলো?

অল ওয়েদার ফ্যাশনস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরিকুল ইসলাম আমাকে বলছিলেন, আমাদেরকে সম্পূর্ণ নতুন করে বিনিয়োগ করতে হয়েছে। আমাদের কারখানা ছিলো ঢাকার মহাখালিতে। সেই বিল্ডিং ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পুরো কারখানা সরিয়ে আনতে হয়েছে গাজীপুরে। দুই বছর আমাদের উৎপাদন বন্ধ ছিলো।

‘বিদেশি ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ডের চাহিদা মেনে ফায়ার সেফটি, ইলেক্ট্র্রিক্যাল সেফটি, বিল্ডিং সেফটি সবকিছু নতুন করে আধুনিক পদ্ধতি মেনে চালু করতে হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা, পরিবেশের দিকেও নজর দিতে হয়েছে। সব মিলে প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। তবে এখন ক্রেতারা সন্তুষ্ট, কর্মীরা সন্তুষ্ট, আমাদের ব্যবসাও ভালো হচ্ছে।’

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের কারখানার পরিবেশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্রেতাদের মধ্যে যে উদ্বেগ তৈরি হয়, তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষে কারখানার বিদ্যুৎ ও অগ্নি নিরাপত্তা, অবকাঠামো ঝুঁকি, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও কর্মপরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয় উন্নয়নে কার্যক্রম শুরু করে ক্রেতাদের দুটি জোট অ্যাকর্ড ও এলায়েন্স।

সংস্থা দুটির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, তাদের আওতায় থাকা দুই হাজার ৪শ ১৬টি কারখানার মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ কারখানাতেই নিরাপত্তা ও অন্যান্য ত্রুটি সংশোধন করা হয়েছে।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, সব কারখানাই কি তাদের মান উন্নয়নে যথেষ্ট নজর দিয়েছে?

দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও`র সহযোগিতায় জাতীয় উদ্যোগে যেসব কারখানার উন্নয়নের কথা ছিলো সেগুলোতে অগ্রগতি খুবই কম। তাদের অধীনে থাকা ১ হাজার ৪৯টি কারখানার মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড মানে পৌছেছে মাত্র ২৭ শতাংশ কারখানা।

এছাড়া কারখানাগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রেও অগ্রগতি সামান্য। সারাদেশের ৩ হাজার ৮শ কারখানার মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন হয়েছে মাত্র ৬শ ৪৪টিতে।

এবিষয়ে জানতে চাইলে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ`র প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমান বলছিলেন, ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভ এর আওতায় ১৫শ`র বেশি কারখানার মধ্যে অনেক গুলোই কিন্তু তাদের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। বাকি যেগুলো আছে সেগুলো ৩০শে এপ্রিলের মধ্যে উন্নয়ন শেষ করার কথা। সেটা না হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর ট্রেড ইউনিয়ন করার ব্যপারে তো কোনও বাধা নেই। কিন্তু এই ইউনিয়ন না থাকলেও শ্রমিক অধিকারে তো কোন সমস্যা হচ্ছে না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের রিসার্চ ডিরেক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম অবশ্য মনে করেন, গার্মেন্টস খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তবে এর পেছনে বিদেশি চাপ একটা বড় কারণ ছিলো।

কিন্তু যখন এই চাপ থাকবে না তখন কারখানা মালিকরা নিরাপদ কর্মপরিবেশ ঠিক রাখতে কতটা আন্তরিক থাকবেন তার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।

তিনি বলছিলেন, অ্যাকর্ড ও এলায়েন্স এর কাজ এই বছরই শেষ হতে যাচ্ছে। তারা চলে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। তারা চলে গেলে নতুন একটা পক্ষকে এই জায়গায় দায়িত্ব নিয়ে কারখানা পরিদর্শন ও মনিটরিং এর কাজ করতে হবে। সেই জায়গায় একটা ঘাটতি আছে। কলকারকানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের লোকবল বাড়াতে হবে। আইনেও সংশোধনী আনতে হবে।

ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অতীতে যা-ই ঘটুক না কেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন কারখানা-মালিকরা তাদের ক্রেতা ধরে রাখার স্বার্থেই কারখানার কর্মপরিবেশ ও মান ঠিক রাখার দিকে গুরুত্ব দেবে। সূত্র: বিবিসি

একে//