ভয়াবহ ইন্টারনেট আসক্তিতে শিশুরা: বাবা-মা কি করছেন?
আলী আদনান
প্রকাশিত : ০৩:৪৯ পিএম, ২৪ এপ্রিল ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৩:৪৯ পিএম, ২৪ এপ্রিল ২০১৮ মঙ্গলবার
ব্যবসায়ী আইয়ুব সাহেব তার সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে বাস করেন রাজধানীর বনানী এলাকায়। স্ত্রী পেশায় একজন শিক্ষিকা। এই দম্পত্তির ঘরে রয়েছে দুই ছেলে সন্তান। বড় ছেলে সাজেদ পড়ছে অষ্টম শ্রেণীতে, আর ছোট ছেলে শাকি চতুর্থ শ্রেণীতে। পেশাগত কারণে দুজনকেই থাকতে হয় ঘরের বাইরে। আর বাসায় সন্তানদের সময় কাটে কম্পিউটার, ট্যাব ও স্মার্ট ফোন নিয়ে। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তারা কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোনে কী করে। শাকি জানায়, সে সবসময় নানা ধরণের গেম ডাউনলোড করে ও খেলে। পাশাপাশি ইউটিউবে নানা ধরণের গান শুনে সময় কাটে। শুধু বাসা-ই নয়, এমনকি স্কুলেও তাদের সঙ্গী স্মার্টফোন ও ট্যাব।
অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া সাজেক জানায়, সে বেশিরভাগ সময় ব্যয় করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফেসবুক, হোয়াটস্ এ্যাপ, ভাইবার, ইনস্ট্রাগ্রাম- প্রত্যেকটিতে একটি করে এ্যাকাউন্ট আছে তার। তবে তার বেশি সময় কাটে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে। এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে রাহুল স্বীকার করে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মেসেঞ্জার অনেক সহজ। কারণ এতে মোবাইল ফোনের মতো বিল কাটেনা। বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষণ চ্যাট না হলে তার অস্থির লাগে। তাই বাসায় সারাক্ষণ তার সঙ্গী স্মার্ট ফোনটি। এক মুহূর্ত নিজের কাছ থেকে আড়াল করতে চায় না নিজের কাছে থাকা স্মার্ট ফোনটি।
নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আকাশের কাছে জানান, সারাদিনই সে ফেসবুকে থাকে। স্কুলেও গোপনে ফেসবুক ব্যবহার করে। শুধু তাই নয়, স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে নতুন নতুন ভিডিও, মুভি, গান শেয়ার করাও তার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাজেদ,শাকি, আকাশ, রিয়াদ, শাওন, হেনা, দীপ, নুসরাত-সবাই শিশু-কিশোর। তাদের সবারই একটা জায়গায় মিল। আর তা হলো, সবাই ইন্টারনেটে মারাত্মকভাবে আসক্ত। এটাই শিশু-কিশোরদের বর্তমান চেহারা।
মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের প্রতি শিশু কিশোরদের এই প্রীতি কে মনোবিজ্ঞানীরা ইন্টারনেট আসক্তি বা মোবাইল ফোন আসক্তি হিসেবে চিহ্নিত করছেন। তাদের ভাষায়, মানুষ যখন কোনো কিছুর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে যায়, ওই জিনিশ ছাড়া যখন তার নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক বিকার দেখা দেয় তাই আসক্তি। মানুষ যখন কোনো কিছুর প্রতি নির্ভরশীল হয় তখন তা ব্যবহার করতে না পারলে তার মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। তার জীবনের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়।
বর্তমান যুগ প্রযুক্তির চরম সম্প্রসারনের যুগ। সময়ের কারণে কম্পিউটার, দামী এন্ড্রয়েড মোবাইল, ভিডিও গেমস সবার হাতের নাগালে। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসএ্যাপ, ইনস্ট্রাগ্রাম- এ অবাধ বিচরণ এখন সবার জন্যই সহজ। আর অবাধ বিচরণ করার ফলেই মানুষের মধ্যে একটা পর্যায়ে জন্ম নেয় আসক্তি। ইন্টারনেটের আনাচে কানাচে ঘোরাঘুরি করতে করতে যে তার মধ্যে আসক্তি নেওয়া সম্ভব তা প্রথম মনোবিজ্ঞানীদের নজরে আসে ১৯৯৭ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও রাজ্যের সিনসিনেটি শহরে এক নারী দৈনিক তেরো ঘন্টা তার বন্ধ ঘরে কাটাতো। তাকে যখন সেই ঘর থেকে বের করে আনা হয় তখন তার মধ্যে নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক বিকার দেখা দেয়। কিছু কিছু বিকার অতিরিক্ত পাগলামী পর্যায়ের।
এ ব্যাপারে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, যারা মদ পান করে, ইয়াবা সেবন করে, হিরোইন, পেথিড্রিন সহ নানা ধরণের মাদক নেয় তারা তাদের সময় মতো মাদক নিতে না পারলে তাদের মধ্যে নানা ধরণের বিকার দেখা দেয়। সে খুব অস্থির হয়ে পড়ে। অনেকে প্রথমদিকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ইন্টারনেট আসক্তিও এর ব্যতিক্রম নয়। কেউ যখন আসক্ত হয়ে পড়ে তখন সে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে যায়।
পৃথিবীতে ইন্টারনেট আসক্তির দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে চীন। সেখানে ইন্টারনেট আসক্তদের পূণর্বাসনের জন্য আলাদা ক্যাম্প করা হয়েছে। মধ্যরাতের পর যেনো কেউ ভিডিও গেমস খেলতে না পারে তেমন আইন প্রয়োগের কথাও ভাবছে চীন সরকার। যুক্তরাষ্ট্রে ২, ২০০ জন শিশুর উপর গবেষণা চালিয়ে প্রতি চারজন শিশুর মধ্যে একজন ইন্টারনেট আসক্ত বলে দাবি করা হয়েছে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায়। যা তাদের অভিভাবকদের বড় দু:শ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্টারনেট জগতে প্রায় ৪৫ কোটি পর্ণো সাইট আছে। ইন্টারনেট আসক্ত শিশু কিশোরদের অনেকেই সহজে ঢুকে পড়তে পারে এসব সাইটে। যা তাদের চিন্তার জগতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে খুব সহজে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চিন্তার জগত ও ১৮ বছরের নিচে যারা তাদের চিন্তার জগত এক নয়। ফলে অনেক বিষয়ের জন্য তাদের মানসিকতা প্রস্তুত নয়। ফলে শিশুরা শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
একই প্রতিষ্ঠানের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, যেসব শিশু কিশোর বেশীরভাগ সময় সাইবার জগতে কাটায় তাদের কে নানা প্রলোভন দেখিয়ে টার্গেট করে সাইবার অপরাধীরা। পরে তাদের দিয়ে নানা ধরনের অন্যায় কাজ করিয়ে নেওয়া হয়।
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারজানা রবিন বলেন, ইন্টারনেট আসক্তি কোনো রোগ নয় বরং অনেকগুলো রোগের জন্য দায়ী একটি বড় সমস্যা। এই আসক্তি সময় মতো নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এর ফলে শিশুদের পড়াশোনায় মনোযোগ নষ্ট হতে দেখা যাচ্ছে। যে কোনো কাজে আগ্রহ কমে যাচ্ছে। তারা একা একা থাকতে চায়। আবার অন্য বয়সীদের ক্ষেত্রেও ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। যার প্রভাব অন্য সকল কাজে পড়ছে। এমন সমস্যাকে অবহেলা না করে এখনই এর বিরুদ্ধে সকলকে সচেতন করা দরকার।
তবে শিশু কিশোরদের মধ্যে ইন্টারনেট আসক্তি বেড়ে যাওয়ার জন্য শুধু তাদেরকে নয়, বরং পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে দায়ী করলেন সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা। তিনি বলেন, আমরা আমাদের শিশুদের খেলার মাঠ দিতে পারছিনা। তাদের সুস্থ বিনোদনের কোনো জায়গা নেই। ভাল সাংস্কৃতিক চর্চার কোনো আবহ নেই। এর ফলে তারা সময় কাটাতে বেছে নিচ্ছে এন্ড্রয়েড, ট্যাব সহ নানা আইটেম। তাদের সুস্থ বিনোদন চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রযুক্তির পৃথিবীতে প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে চলা সম্ভব নয়। তাই বলে আমাদের আগামী প্রজন্ম `আসক্ত` হয়ে ঝুঁকির মুখে থাকবে তা কারো নয়। সচেতন হওয়ার এখনই সময়।
এএ/ এমজে