ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

নীতিমালা না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কার চালকরা  

আরিফুর রহমান তুহিন

প্রকাশিত : ০৪:১২ পিএম, ২৪ এপ্রিল ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৪:৫০ পিএম, ২৪ এপ্রিল ২০১৮ মঙ্গলবার

ঢাকায় এক ব্যবসায়ীর গাড়ি চালাতো মো. ইকবাল। সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে মালিকের সন্তানদের নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী থেকে ধানমন্ডী যেতো ১২ হাজার টাকা বেতনের ইকবাল। ফিরত বিকেল ৩টায়। মধ্যে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার মালিকের সন্তানদের নিয়ে কোচিংয়ে পৌঁছে দিতে হতো। ফিরতে ফিরতে রাত ৮টা। এরই মধ্যে হয়ত মালিকের বৌয়ের কোন পার্টি বা অন্য কোনো কাজ থাকলে তাকে নিয়ে আবার দে ছুট।  কোনো দিন রাত ১১টা আবার কোনো দিন রাত ১টা। বাসায় ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি। আবার যে আগামীকাল সকাল ৬টায় তাকে উঠতে হবে। সেই ভাবনা ভাবতে ভাবতে সামনে আসে কিছু সুখ দুঃখের স্মৃতি।  এমনি করতে করতে রাত আড়াইটা বা ৩টার দিকে ঘুম।  পরের দিন আবার শুরু।  সপ্তাহে ৭ দিন এমন চলে তার।  হঠাৎ একদিন তার মেরুদণ্ডে সামান্য একটা অস্ত্রপচারের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে তাকে ২০ দিনের মতো বিশ্রামে থাকতে হয়। এতদিন কি আর সাহেব বসে থাকবেন। তাই তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেন।

সুস্থ হলে আবার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেয় ইকবাল।  কয়েক মাস গাড়ি চালানোর পরে একদিন গভীর রাতে গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফেরার পর প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয় ইকবাল। সকালে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ডাক্তার তাকে চিকুনগুনিয়ার কথা জানায়। ব্যাস, চলে যায় এ চাকরিটাও। বর্তমানে চাকরির খোজে হন্নে হয়ে ঘুরছে মা-বাবা হারানো মাদারীপুরের ইকবাল।

এত কম সময় ঘুমিয়ে কিভাবে গাড়ি চালায় জানতে চাইলে তিনি জানান, যাত্রী আনা নেওয়ার ফাঁকে যতটুকু সময় পাওয়া যায় তখন একটু ঘুমিয়ে নেন। অনেক সময় ঘুমানোর সুযোগ না পেলে তন্দ্রা আসে। তখন গাড়ি চালাতে খুব কষ্ট হয়।  একবার চালানো অবস্থায় হালকা তন্দ্রা এসে যাওয়ায় ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আরেকটি গাড়ির পিছনে তার গাড়িটি লেগে যায়।  পুলিশ একটি মামলা দিয়ে ছেড়ে দেয়।  আক্ষেপের সঙ্গে ইকবাল বলেন, এক টাকাও চুরি করি না। সিএনজি গ্যাস সাহেব নিজেই ঢুকায় তার পরেও সাহেবরা সন্দেহের চোখে আমাদের দেখে।  তারা মনে করে ড্রাইভার মানেই চোর, বাটপার।

এক ছেলে, এক মেয়ে ও বউ নিয়ে দক্ষিণখানে বাবুলের ছোট্ট সংসার।  ২০০০ সাল থেকে প্রাইভেটকার চালিয়ে আসা বাবুলের বর্তমান বেতন ১৬ হাজার টাকা।  যখন শুরু করেছিল তখন ছিল পাঁচ হাজার।  তিনি জানান, তার বর্তমানে সংসারের খরচ প্রায় ৩০ হাজার টাকা।  বেতনের দিগুণ খরচ তিনি কিভাবে বহন করেন জানতে চাইলে বাবুল জনায়, তিনি যে গাড়িটি চালায় সেটি অকটেনে চলে।  তাই সুযোগমতো সেখান থেকে কিছু ইনকাম করে।  আবার গ্রেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করা আছে।  তাদের গ্রেজে গাড়ি মেরামত করলে সেখান থেকে কমিশনতো পাবেই সঙ্গে বাড়তি বিল করার সুযোগতো আছেই। এছাড়া গাড়ি থাকে ভাড়া করা একটি গ্রেজে। তাই সুযোগমত কাছাকাছি কোন ট্রিপ পেলে মালিককে না জানিয়ে রাতে ছোট্ট একটা ট্রিপ মেরে আসে। বাবুলের যুক্তিতে তার সব কাজগুলো বৈধ। তার বক্তব্য, যেহেতু তাদের বেতনের কোন নিয়মকানুন নেই।  এছাড়া সামান্য কারণেও বেতন কাটা হয়। আর বেতন বাড়ার আগেই চাকরি থেকে বরখাস্ত, তাই সংসার চালাতে তিনি এসব করেন।

তবে ভিন্ন কিছু পাওয়া গেল, ১৯৯৪ সাল থেকে শিকদার গ্রুপের কর্ণধার নাসির শিকদারের পারিবারিক গাড়িচালক হিসেবে কাজ করে আসছে ইদ্রীস ফরাজি।  বর্তমানে তার বেতন ২৬ হাজার টাকা।  থাকা-খাওয়া মালিকের।  বর্তমানে তিনি অনেকটা নাসির শিকদারের পরিবারের সদস্যের মতই।  ইদ্রীস জানায়, দুই বছর আগে তার হার্টে দুটি রিং বসাতে হয়।  তখন তাকে প্রায় দুই মাস হাসপাতাল ও বিশ্রামে থাকতে হয়েছিল।  মালিক তাকে ছুটি দেন এবং চিকিৎসার প্রায় ৭০ ভাগ খরচ বহন করেন।  যতদিন গাড়ি চালাবেন তিনি নাসির শিকদারের গাড়ি চালাবেন বলে জানায় ইদ্রীস।

এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিদ্যমান আইনে গাড়ি চালকদের জন্য কোন নীতিমালা না থাকায় শ্রমিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন লক্ষাধিক গাড়ি চালক। অতিরিক্ত দায়িত্বপালন, কাজের তুলনায় স্বল্প পারিশ্রমিক, যখন তখন চাকরি চলে যাওয়ার কারণে অনেকটা অনিরাপদ তাদের জীবন। তাই বাড়তি আয়ের লোভে সুযোগ পেলেই নির্ঘুম থেকে বাড়তি ট্রিপ মারেন তারা। ফলে অনেক সময়ই ঘটে মারাত্মক দুর্ঘটনা। তবে শ্রম মন্ত্রণালয় বলছে, একজন চালক পর্যাপ্ত বেতন পেয়ে থাকেন। আর সবাইকে শ্রম আইনের আওতায় আনা কষ্টকর। দুর্ঘটনার জন্য চালকদের লোভকেই দায়ি করছেন তারা।

দেশের গাড়ি চালকদের একটি নীতিমালার জন্য দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন করে আসছে পেশাজীবী প্রাইভেটকার অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংগঠন। ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করা এই সংগঠনটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. আমির হোসেন সরদার জানান, দেশে বেশিরভাগ খাতের শ্রমিকদের জন্য নীতিমালা থাকলেও তাদের জন্য কোনো নীতিমালা নেই। সেই সুযোগে মালিকপক্ষ ইচ্ছামত কাজ করায়। অথচ তাদের বেতন বর্তমান বাজারে খুবই নগণ্য। আবার সামান্য অজুহাতে তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। একটি নীতিমালার জন্য তারা অনেকবার শ্রম মন্ত্রণালয়ের দারস্থ হয়েছেন। সর্বশেষ গত বছর তারা শ্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। তখন তাদের শিগগিরই একটা নীতিমালা করা হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালয়ে যাবেন বলে জানান তিনি।

শ্রম মন্ত্রণালয় একটি সূত্র জানায়, কিছুদিন আগে বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছিল। পরে ভাবা হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তারা বিষয়টি এড়িয়ে যায়। তবে পরবর্তি মিটিংয়ে বিষয়টি আবার উপস্থাপন করা হতে পারে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।

জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, চালকদের জন্য একটি নীতিমালা করার প্রয়জনীয়তা আছে। কিন্তু বিষয়টি অত্যান্ত দুরুহ। তাই তারা তরিগরি করছে না। এছাড়া তার মতে দেশের কোনো চালকের ১২ হাজার টাকার নিচে কোন বেতন নাই। তাই এটা অন্যান্য খাতের মত এতো গুরুত্বপূর্ণও না। তবে বিষয়টি নিয়ে সরকার ভাবছে। ধীরে ধীরে সব শ্রমিক নীতিমালায় আসবে বলে আশ্বাস দেন তিনি। তবে চালকরা কম বেতনের জন্য বাড়তি ট্রিপ মারে বা তাদের অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ এমন কথা মানতে নারাজ এই প্রতিমন্ত্রী। তার মতে, অতি লোভের কারণে চালকরা বাড়তি ট্রিপ মারে। দেশের অনেক চালকের বেতন এখন ২০ হাজার টাকার বেশি। আর যারা ব্যক্তিগত গাড়ি চালায় তাদের হয়ত মাঝামাঝে বাড়তি ডিউটি করতে হয়; তর পরেও সেটা নিয়মিত না।

এসএইচ/