ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

যেমন হওয়া উচিত বয়স্কদের জীবনধারা, ১৩ পরামর্শ

প্রকাশিত : ১০:৫৯ এএম, ২৫ এপ্রিল ২০১৮ বুধবার

বৃদ্ধ হওয়া কোনও অভিশাপের ফল নয়। এটা জীবনের অমোঘ বাস্তবতা। তবে জীবনের শেষ সময়টা কেমন যাবে এটি পুরোপুরি নির্ভর করে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির আর জীবনধারার ওপর। দৃষ্টিভঙ্গির যদি শোকরগুজার বা ইতিবাচক হয় আর জীবনধারা যদি বিজ্ঞানসম্মত অর্থাৎ সবকিছুর মধ্যেই একটা পরিমিতি থাকে তবে জীবনের শেষ দিনও আপনি কাজ করতে করতে হাসতে হাসতে হয়তো বা বিরিয়ানী খেয়ে পরপারে যাত্রা করতে পারেন।

বয়স হওয়ার ফলে নানাবিধ শারীরিক-মানসিক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। চল্লিশ/পঞ্চাশের পর থেকেই আপনার চুল পাকতে থাকবে, চামড়ায় ভাঁজ দেখা দেবে, চামড়া হয়ে যাবে শুষ্ক, রুক্ষ। মাংসপেশী দূর্বল হয়ে যাবে এবং শুকিয়ে যাবে। গ্রন্থিগুলোতে দেখা দেবে ব্যথা, কখনও বা ভাঁজ করতে অসুবিধা হবে। হাড় ক্ষয়ে যেতে চাইবে, হয়ে যেতে পারে ভঙ্গুর। এমনকি আপনার উচ্চতাও কমে যেতে পারে। শরীরে চর্বি বাড়তে থাকবে এবং জমা হবে পেটে বা পশ্চাৎদেশে। বয়সের প্রভাব পড়বে মুখমন্ডলে, ফলে বয়সের ছাপ আপনি হয়তো লুকাতে পারবেন না। আপনার দাঁত আর মাড়ি দূর্বল আর ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে। চুল আর নখ হয়ে যেতে পারে দূর্বল আর ভঙ্গুর। হরমোনের পরিবর্তনে দেখা দিতে পারে ডায়াবেটিস। কমে যেতে পারে স্মৃতিশক্তি, ফলে কোনও কিছু স্মরণে আসতে চাইবে না। দূর্বল হয়ে যেতে পারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। কানেও শুনতে পারেন কম। দৃষ্টিশক্তি হয়ে যেতে পারে ঝাপসা। ঘ্রাণশক্তি কমে যেতে পারে, কমে যেতে পারে খাবারের স্বাদ। কমে যেতে পারে প্রসাব-পায়খানা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। বেড়ে যেতে পারে কোষ্টকাঠিন্য। ঘুমের সমস্যা দেখা দিয়ে জীবনকে আপনার কাছে করে তুলতে পারে বিষময়। সর্বোপরি একাকীত্ব আপনাকে কুড়ে কুড়ে খেতে পারে ।


ইচ্ছে করলেই আপনি বয়সকে ধরে রাখতে পারবেন না। যৌবনের সোনালী দিনগুলোকে ফিরিয়েও আনতে পারবেন না। কিন্তু একটু চেষ্টা করলে আর বিজ্ঞান ও ধর্মসম্মত জীবন-যাপন করলে আপনি উপরে বর্ণিত অনেক পরিবর্তনকে ঠেকিয়ে দিতে পারবেন এবং লাভ করবেন ‘সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন কর্মব্যস্ত সুখী জীবন’।


এ লক্ষ্যে আপনার করণীয়-
১. ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হোন। আপনার কী নেই তা না দেখে যা আছে তারদিকে দৃষ্টি দিন।
২. সবকিছুর জন্যে শুকরিয়া আদায় করুন। এই বাতাস, এই খাবার, বাবার স্নেহ, মার মমতা, ভায়ের আদর, বোনের স্নেহ– সবকিছুর জন্য শুকরিয়া আদায় করুন। আর দিন শুরু করুন শুকরিয়া দিয়ে। ঘুম ভাঙ্গতেই বলুন শোকর আলহামদুলিল্লাহ! থ্যাংকস গড, প্রভু তোমাকে ধন্যবাদ একটি চমৎকার দিন দেওয়ার জন্য। দিনে যতবার কুশল বিনিময় হবে, বলুন ‘বেশ ভালো আছি’। রাতে ঘুমানোর সময় শুকরিয়া আদায় করে ঘুমাতে যান। এক অনন্ত প্রশান্তির অধিকারী হবেন আপনি।
৩. প্রতিদিন অন্তত: পাঁচ দফা (প্রতি দফায় ১৯ বার) বুক ফুলিয়ে দম নিন। আপনার শরীরের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অক্সজেন গ্রহণ করুন নিয়মিত এবং পর্যাপ্ত।
৪. নিয়মিত ব্যায়াম করুন। সপ্তাহে আড়াই ঘন্টা অর্থাৎ ৩০ মিনিট করে কমপক্ষে ৫ দিন ব্যায়াম করুন। ব্যায়ামের মধ্যে সেরা ব্যায়াম হচ্ছে যোগ ব্যায়াম। এরপরই হচ্ছে হাঁটা। ঘন্টায় ৪ মাইল বেগে হাঁটুন। এছাড়া সাতাঁর কাটতে পারেন। নিয়মিত ব্যায়াম বয়সের অনেক প্রভাবকে ঠেকিয়ে দেবে ।
৫. আপনার খাবার হতে হবে বিজ্ঞানসম্মত ও ধর্মসম্মত। আধুনিক পুষ্টি বিজ্ঞানের পরামর্শ মতে আপনি যদি দীঘায়ু হতে চান তবে সকালে রাজার মতো খান, দুপুরে রাজপুত্রের মতো আর রাতে খান ফকিরের মতো। আর খাওয়ার সময় এমনভাবে খান যেন আপনি আরও ২/৩ লোকমা খেতে পারেন। নবীজী (স:) বলেছেন, ‘তোমরা পাকস্থলীর এক তৃতীয়াংশ খাবার ও এক তৃতীয়াংশ পানীয় দিয়ে পূর্ণ করো এবং এক তৃতীয়াংশ ফাঁকা রাখো’। আর খাবার হতে হবে পুষ্টিবিজ্ঞান সম্মত। প্রতিদিন পর্যাপ্ত শাক-সবজি, ফল খান। ভাত বা রুটি সবসময় থাকতে হবে পরিমিত। রেড-মিট অর্থাৎ গরু, খাসি, পাঁঠার মাংস এড়িয়ে চলুন। সপ্তাহে বড়জোর ১ দিন মুরগীর মাংস খান। সপ্তাহে ২ দিন ছোট মাছ এবং ২ দিন বড় মাছ খান। সামুদ্রিক মাছ খাবার চেষ্টা করুন। আর সপ্তাহে ২ দিন শুধু নিরামিষ খাবার গ্রহণ করুন।
৬. উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ না থাকলে, মেদস্থূলতা না থাকলে প্রতিদিন ১ টি ডিম, ১ গ্লাস দুধ আর ১ টি কলা খান ।
৭. প্রতিদিন পর্যাপ্ত আঁশযুক্ত খাবার খান। শাক-সবজি, ফল, লাল আটা, লাল চালে পর্যাপ্ত আঁশ থাকে।
৮. প্রতিদিন কমপক্ষে দেড় লিটার পানি পান করুন। প্যাকেট জাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন। প্রতিদিন সয়াদুধ, স্পিরুলিনা, মাশরুম, লেবু, টকদই, কাঁচা রসুন, বাদাম খান।
৯. ফাস্ট ফুড, সফট ড্রিংক, হার্ড ড্রিংকস, এনার্জি ড্রিংকস, ভাজা পোড়া, তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
১০. আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে বড় অভিশাপ হচ্ছে টেনশন। ছোট বড় সকলেই আমরা কম-বেশি টেনশনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই টেনশন থেকে মুক্ত থাকুন। আর এজন্যে মেডিটেশন করুন। নিয়মিত দু’বেলা মেডিটেশন আপনাকে স্ট্রেসমুক্ত রাখার পাশাপাশি আপনার ভেতর এনে দেবে এক অপার্থিব প্রশান্তি। আর প্রশান্তিই হচ্ছে জীবনের একক। আপনার যতোই মান-সম্মান, যশ-খ্যাতি, প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকুক না কেনও, সবই অর্থহীন হয়ে যেতে পারে, যদি আপনার জীবনে প্রশান্তি না থাকে।
১১. ৪০ বছরের পর থেকে বছরে অন্তত একবার মেডিকেল চেক-আপ করান।
১২. ডায়াবেটিস থাকলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বা নেফ্রোপ্যাথি বা নিউরোপ্যাথি প্রতিরোধের লক্ষ্যে নিয়মিত চেক-আপ গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখুন। নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপের ব্যবস্থা করুন। কেননা অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ। হৃদরোগ থাকলে জীবনধারা আমূল বদলে ফেলুন। নিরামিষভোজীতে পরিণত হোন। নিয়মিত ব্যায়াম করুন। আর তেল ছাড়া বা ন্যূনতম তেলে রান্ন করা খাবার খেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠুন। ধূমপানের অভ্যাস থাকলে তা এখনই বন্ধ করুন।
১৩. সর্বোপরি সিনিয়র সিটিজেন হয়ে যাওয়ার পর আপনার সামাজিক যোগাযোগ যেন বিচ্ছিন্ন না হয়। একবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেই আপনি হারিয়ে যাবেন। দ্রুত বুড়িয়ে যাবেন। তাই কোনও একটি সৎসঙ্ঘ বেছে নিন। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করুন। আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ান। এতিম অসহায়দের জন্য প্রতিদিন কিছু না কিছু করার চেষ্টা করুন। আর তবেই বিদায় বেলায় আপনি বলতে পারবেন, আমার নিজের জন্য এবং অপরের জন্য যা কর্তব্য ছিল তা করার আমি চেষ্টা করেছি। প্রভু আমি এখন প্রস্তুত তোমার সঙ্গে সাক্ষাতে।
একে//