পর্নোগ্রাফিতে বুঁদ কিশোর-তরুণরা
আলী আদনান
প্রকাশিত : ০৭:০৪ পিএম, ২৬ এপ্রিল ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১১:৫৯ এএম, ৫ মে ২০১৮ শনিবার
বাবুল সাহেব তার ছেলে মেয়েদের দেখে নিজের ছোট বেলার কথা ভাবেন। যেই বয়সে তিনি দাপিয়ে মাঠে ফুটবল খেলেছেন, পুকুরে সাঁতার কেটেছেন, বন্ধুদের সাথে রেললাইন ধরে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন, সেই বয়সে তার ছেলেমেয়েরা আলাদা আলাদা নিজেদের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। অনেক ডাকাডাকি করে খাওয়াতে হয়। অপ্রয়োজনে কারো সাথে কথা বলেনা। এটা কী ওদের স্বাভাবিক আচরণ, প্রশ্ন বাবুল সাহেবের। আলীম সাহেবের সন্তানদেরও একই অবস্থা। আলিম সাহেব খুশী। ছেলেমেয়েরা বাইরে ঘোরাঘুরি করলে অযথা চিন্তা বাড়ে। যা দিনকাল পড়েছে, তার চেয়ে রুমে আছে। খারাপ কী?
দু`জনেই বাবা। তাদের দু`জন-ই আলাদাভাবে সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত। কিন্তু তারা কি জানেন, এক নীল দংশন প্রতিদিন তিলে তিলে শেষ করছে তার সন্তানের মানসিক জগত?
কাগজে কলমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মোবাইল ফোন নেওয়া নিষিদ্ধ হলেও কার্যত তা মানছে না কেউ। শিশুদের আচরণ ও মনোজগত নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন শিক্ষাবিদ সালেহা খন্দকার। তিনি দাবি করেন, এসএসসি পাশ করার আগে প্রায় ৭৬ শতাংশ শিশু মোবাইল ব্যবহার করে। এদিকে `মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন` নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। গ্রামীণফোনের অভিভাবক কোম্পানি টেলিনরের দাবি অনুযায়ী, দেশে ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো না কোনো ভাবে সাইবার হুমকির শিকার।
মাহিয়ান ( ছদ্মনাম) পড়ছেন রাজধানীর একটি নামি-দামী প্রতিষ্ঠানে। এই প্রতিবেদকের সাথে তার কথা হলো ধানমণ্ডি লেক সংলগ্ন এলাকায়। স্কুল ড্রেস পরা এ শিক্ষার্থীকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলো, সে দামী স্মার্ট ফোনে কী করে। প্রথম ফেসবুক, ইনস্ট্রাগ্রাম নিয়ে কথা বললেও ধীরে ধীরে সে স্বীকার করে মোবাইলে নানা ধরণের মুভি দেখে সে। কী ধরণের মুভি দেখে এমন প্রসঙ্গে একপর্যায়ে আসে পর্নোগ্রাফি মুভির কথা। প্রথমে লজ্জা পেলেও পরে সে স্বীকার করে মোবাইলে ও বাসায় পিসিতে পর্নোগ্রাফি দেখে সে। তবে `পর্নোগ্রাফি` শব্দটি সে বা তার বন্ধুরা ব্যবহার করেনা। তাদের কাছে এটি থ্রি এক্স বা ন্যুড ছবি। শুধু মাহিয়ান নয়, তার কমবেশী সব বন্ধু মোবাইল পর্ণ আসক্ত।
জিনিয়া( ছদ্মনাম) অবশ্য একটু আলাদা। এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে জিনিয়া জনায় মোবাইল ফোন ছাড়া চলেই না। শুধু ঘুমানোর সময় ছাড়া অন্য সব সময় তার মোবাইল ফোনের দরকার হয়। কী করে তারা মোবাইল ফোনে? উত্তর শুনতে পারেন জিনিয়ার মু্খেই। জিনিয়া বলেন, আমরা বন্ধুরা নিজেরা নিজেরা যোগাযোগ করি। বিভিন্ন মুভি দেখি। ইংলিশ মুভি দেখি। ইংলিশ মুভির কথা বলার পরে তাকে সরাসরি জিজ্ঞেশ করি অ্যাডাল্ট ছবি দেখে কি না? জিনিয়া প্রথমে বিব্রত হলেও পরে আস্তে আস্তে স্বীকার করে সেও তার বন্ধুরা মোবাইলে ‘অ্যাডাল্ট ছবি’ দেখে। শুধু তাই নয়, নিজে যেমন দেখে, তেমনি অন্য বন্ধুদের মাঝেও ছড়িয়ে দেয় সেই মুভি। ব্যতিক্রম কিছু দেখলে প্রবল উত্তেজনায় একে অপরের সাথে আলাপ করে। শুধু মাহিয়ান বা জিনিয়া নয়, বরং পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত শিক্ষার্থীর পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে।
কেন শিশু-কিশোরদের মধ্যে পর্নোগ্রাফি আসক্তি বাড়ছে? এমন প্রশ্নে সমাজ বিজ্ঞানীরা দায়ী করছেন মোবাইল ফোনকে। অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের পাশাপাশি অপব্যবহারের পরিমাণও কম নয়। খুব অল্প বয়সে শিক্ষার্থীদের হাতে প্রযুক্তি চলে আসায় তারা বুঝতে পারেনা এর সঠিক প্রয়োগ কী। আর তাই ক্রমেই বিপদগামী হচ্ছে তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটি বিভাগের প্রধান মাহবুবুল আলম জোয়ার্দার বলেন, ‘পর্নোগ্রাফি আসক্তিসহ প্রযুক্তির অপব্যবহারের জন্য সবচেয়ে দায়ী মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা। তাছাড়া বাবা-মায়েরা সন্তানদের বদ্ধ রুমে কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেন। এর ফলেও তারা পর্নোগ্রাফিগ্রাফিতে বেশি আসক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।’
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন- এর ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে শতকরা ৭৮ শিক্ষার্থী গড়ে আট ঘন্টা মোবাইলের পেছনে ব্যায় করে। আর শুধু প্রেম করার উদ্দেশ্যে মোবাইল ব্যবহার করে শতকরা ৪৪ শিক্ষার্থী। ধানমন্ডির একটি স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্রী লুবনা ( ছদ্মনাম) বলেন, ক্লাসে কোনো মেয়ের বয় ফ্রেন্ড নেই মানে সে অবহেলিত। তার কোনো স্ট্যাটাস নেই। বয়ফ্রেন্ড না থাকাটা একটা লজ্জার ব্যাপার। ক্লাসের আড্ডায় প্রতিযোগিতা চলে কে কার গার্লফ্রেন্ডকে কী গিফট করলো, মেসেঞ্জারে কে কী লিখলো এসব নিয়ে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘মাদক যেমন শরীরের ক্ষতি করে তেমনি পর্নো আসক্তি আমাদের শিশুদের চিন্তার জগতকে নষ্ট করে। স্বাভাবিক চিন্তা শক্তি ব্যাহত করে। একটা প্রজন্মকে চিন্তার জগতে শেষ করে দেওয়ার জন্য এর চেয়ে ক্ষতিকর অস্ত্র আর হতে পারে না।’
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যারা অতিরিক্ত পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত তারা মাদকাসক্তদের চেয়েও বেশি ঝুঁকিতে আছে। প্রমাণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিজ্ঞানী জেফরি সেটিনোভার বলেন, আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে পর্নোগ্রাফির আসক্তি হেরোইনের মতোই। শুধু প্রয়োগটা ভিন্ন। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, যারা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত তাদের মস্তিষ্কে মাদকাসক্তদের মতোই নেশা কাজ করে। মাদক গ্রহণের ফলে আসক্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের যে অংশে অনুভূতি কাজ করে, পর্ন দেখার ফলে ঠিক সেই অংশই উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। । মাদকাসক্তদের যেমন স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন ঘটে, বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা নেমে আসে, তেমনি পর্নো আসক্তরাও ধীরে ধীরে অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে এবং বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেন, পর্নো আসক্তি শিশু-কিশোরদের অপরাধ প্রবণ করে তোলে। শুধু তাই নয়, সমাজে ধর্ষণ, ইভটিজিংসহ নানা ধরণের যৌন অপরাধ বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফি আসক্তি বড় ভূমিকা রাখছে। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির মামলাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অপরাধীর মেধ্যে কোনো না কোনোভাবে পশুত্ব জেগে ওঠে। আর এর জন্য অনেকাংশে দায়ী প্রযুক্তির সহজলভ্যতা। তাই বাবা-মার উচিত, সন্তানের হাতে স্মার্টফোন-ট্যাব-নোটবুক, পিসি তুলে দেওয়ার পূর্বে একবার ভাবা। আর শিশু-কিশোররা যাতে গোপনে এগুলো ব্যবহার করতে না পারে সেদিকটা খেয়াল করা।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শফি আহমেদ বলেন, কোনো সমাজ বা সভ্যতাকে আক্রান্ত করতে হলে তাদের শিশু কিশোরদের টার্গেট করা হয়। প্রশ্ন ফাঁস বা মাদকের মতো পর্নোগ্রাফিগ্রাফিতে শিশু কিশোরদের আসক্ত করাও তার একটি ধারাবাহিকতা পদক্ষেপ মাত্র। শিশু কিশোরদের পর্নোগ্রাফি সহ নানা ধরণের অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে দূরে রাখতে শিক্ষক ও অভিভাবকরা সচেষ্ট হবেন এটাই সবার প্রত্যাশা।
এ সংক্রান্ত আরও পড়ুন:
ভয়াবহ ইন্টারনেট আসক্তিতে শিশুরা: বাবা-মা কি করছেন?
স্মার্টফোন আসক্তি, বাড়ছে অশান্তি
এমজে/