ছাত্রলীগ অনবরত ট্রেন মিস করছে
গোলাম সারোয়ার
প্রকাশিত : ০৯:৪৪ পিএম, ২৬ এপ্রিল ২০১৮ বৃহস্পতিবার
কোটা সংস্কার নিয়ে এই মাসের শুরুর দিকে শিক্ষার্থীরা একটি আন্দোলন শুরু করেন। দেখতে দেখতে আন্দোলনটি বড় হতে থাকে। বড় হতে হতে মাত্র দুই দিনে আন্দোলনে নাটকীয় পরিবর্তন আসে যা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অবস্থা এমন হয় যে গত ১১ এপ্রিল নাগাদ আন্দোলনটি ঢাকাসহ দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা সড়ক অবরোধ করে। আন্দোলনকারীরা কোটা সংস্কারে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দাবি করেন। বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। তারপর আন্দোলন প্রশমিত হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন সফল হওয়ার কারণ এই আন্দোলনে দেশের অধিকাংশ মানুষের সায় ছিলো। এমনকি আওয়ামী লীগেরও বহু নেতাকর্মীরও এতে সায় ছিলো। কিন্তু তারপরেও বহুল গণদাবির এই আন্দোলনে উপমহাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দিতে পারেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, ক্ষমতার কাস্টোডিয়ান হিসেবে সরকার এবং সরকারের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী সংস্কারের দাবিকে আমলযোগ্য বিবেচনা করে আলোচনার জন্যে প্রস্তাব দেওয়ার পরও ছাত্রলীগ এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা খুঁজে পায়নি এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নিতে পারেনি। বরং তাঁদের কেউ কেউ তখনো কোটা সংস্কারের বিপক্ষে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দাবির অসারতা প্রমাণে চেষ্টারত থাকলেন। এটিই হয়েছে কাল। যেখানে প্রধানমন্ত্রী আলোচনার প্রস্তাবে দূত পাঠালেন সেখানে আবার এই নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিলেতো পরিস্থিতি ঘোলাটে হবেই। তখন আন্দোলনকারীরা ভেবে বসলো তাদের ধোকা দেওয়া হচ্ছে; আসলে সংস্কার কিছুই হবেনা। এই সুযোগে আন্দোলনে যারা যারা ফুয়েলিং করতে চায় তারা উস্কানি দিতে লাগলো। পরিশেষে গত ১১ এপ্রিল পরিস্থিতি প্রায় ভয়াবহ রূপই ধারণ করলো। যাই হোক প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দেশ একটি বিপদের হাত থেকে আবারো রক্ষা পেল।
এই আন্দোলন থেকে আমাদের বহুকিছু শিখার আছে। দেশে বিরোধীদল কার্যত ব্যর্থ। ডানপন্থী দলগুলো আন্ডারগ্রাউন্ডে। এই অবস্থায় সরকার ভালোই চলছিলো। মনে হচ্ছিল কোথাও কেউ নেই। সবকিছু সাদা ফার্সা। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। বাস্তবতা হলো সবকিছুই চলছে অন্দরে-বাহিরে। সবাইই আছেন। দেশে সরকার যা করেন, সরকার বিরোধীরা তার চেয়ে কম কাজ করেন না। একটি আন্দোলনকে প্রথমেই প্রশমিত করা না গেলে সেই আন্দোলনে বিভিন্ন অশরীরী আত্মা যোগ হবে। তখন এই আন্দোলন আর নিছক কোটা সংস্কারের মতো একটি দাবিতে থাকেনা। এটিতে তখন বহুজনের বহু স্বপ্ন যোগ হয়ে যাবে। তখন পরিস্থিতি যেখানে যাবে সেখান থেকে বের করা তত সোজা না। ছাত্রলীগেরতো জানার কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়গুলোর আন্দোলনকে অন্য যেকোন আন্দোলনের সাথে গুলিয়ে ফেলা যায়না।
এটিতো হেফাজতের হঠাৎ গজে উঠা শাপলা চত্তর নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন এক পূণ্যভূমি যেখান থেকেই এই দেশের প্রায় সব ইতিহাসের জন্ম হয়েছে। সুতরাং এখানের কোন আন্দোলনকে এত হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। এত হালকা দাবি নিয়েও তারা নামেনি। আমরা অনেকেই ঘাট পার হলে মাঝি চিনিনা । শাহবাগ আন্দোলনকে আমরা ইদানিং কটাক্ষও করে থাকি । কিন্তু মনে পড়ে, কাদের মোল্লার রায় এবং রায়পরবর্তী সংক্ষুদ্ধ উত্তাল শাহবাগ! সেও এক ইতিহাসের আগুনের হলকা ।
যা বলছিলাম তাই বলি এবার। আমরা বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছি যে, গত কয়েক বছর ধরে ছাত্রলীগ অনবরত ছাত্রআন্দোলনগুলোর ট্রেন মিস করছে। তাঁরা ভ্যাট আন্দোলনের ট্রেন মিস করেছেন, পরীক্ষার ফি এবং বেতন বাড়ানোর আন্দোলনের ট্রেন মিস করেছেন, কাদের মোল্লা উপাখ্যানে শাহবাগ আন্দোলনের ট্রেন কোন রকমে একেবারে শেষদিকে গিয়ে ধরেছেন, এবং সর্বশেষ এই কোটা আন্দোলনের ট্রেন শুধু মিসই করেনি বরং তাঁরা এই ট্রেনের গতিকে বাঁধাই দিয়েছেন। সর্বশেষ অবশ্য তারা বিজয়ের ভাগ নিতে চেয়েছেন কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আজকের প্রযুক্তির যুগে মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ নেই। মানুষ সহজেই সত্যের কাছে পৌঁছে যায়।
একটি রাজনৈতিক দর্শনকে বোমা মেরে ব্যর্থ করা যায়না। যেমন পারেনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ২১শে আগস্টে গ্রেনেড হামলা করে কিংবা কোটালিপাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে। একাত্তরে ঝাঁকে ঝাঁকে মেরে কিংবা পঁচাত্তরে সপরিবারে হত্যা করেও পারেনি আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। বোমা মেরে, শক্তি প্রয়োগ করে কোন রাজনৈতিক দর্শনকে নিশ্চিহ্ন করা যায়না। একটি রাজনৈতিক দর্শনের মৃত্যু হয় কালের ভাষা আর মাটির জিকির বুঝতে ব্যর্থ হলে। কোন রাজনৈতিক দর্শন যদি আর মানুষের কথা না বুঝতে পারে, মানুষের অভিযোগ, অনুযোগের দাবি নিয়ে সোচ্চর হতে না পারে, মানুষের জন্যে আর মানুষের পক্ষে যদি তারা কাজ করতে না পারে, তবে সে রাজনৈতিক দর্শনের এমনিতেই মৃত্যু ঘটে।
যে রাজনীতি গণমানুষের ন্যায়যুদ্ধের পক্ষে না গিয়ে অন্যায়ের তোষণ করে সে রাজনীতি বিলীন হয়ে যায়। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমলীগ। এককালের প্রবল প্রতাপশালী মুসলিমলীগ এখন জাদুঘরে। আওয়ামী লীগের যখন জন্ম হচ্ছিল তখন মুসলিমলীগ এই অঞ্চলে একটি মহীরূহ। কেউ ভাবেওনি মাত্র দু’চার জনের যোগারযন্ত্রে যে আওয়ামী মুসলিমলীগের জন্ম হচ্ছে তা একদিন মহীরূহ হবে। অথচ শুধু মানুষের পালস ধরতে পেরেছিলো বলে আর মানুষের পক্ষে শাসনের প্রতিকূলে মাঠে নেমেছিলো বলেই দলটি মাত্র দু’চার বছরে নিজেই মহীরূহে রূপান্তরিত হয়।
ছাত্রলীগের পর পূর্বপাকিস্তানে ছাত্রদের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠনটি ছিলো ছাত্র ইউনিয়ন। এই সংগঠনটিও এদেশের রাজনীতিতে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে সময়ের ভাষা আর মাটির জিকির বুঝতে পারেনি বলে। তাঁরা বুঝতে পারেনি রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লব এই দেশের কৃষিভিত্তিক সমাজে চলবেনা । তাঁরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন, মানুষের আন্দোলন করতে হয় মানুষের ভাষায়। কিন্তু তাঁরা হয়ে রইলো দুর্বোধ্য, গণবিচ্ছিন্ন।
যা বলছিলাম। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী এবং এ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন সংগঠন। এ দেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয় এই দলটি। একাত্তরের রণাঙ্গনে শহীদ হয়েছেন ছাত্রলীগের ১৭ হাজার বীর। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন ছাত্রলীগ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের কারিগর ছাত্রলীগ। ১৯৫৬ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় এবং ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ছাত্রলীগের হাত ধরেই হয়েছে। ১৯৬৬ সালে বাঙালীর মুক্তির সনদ বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা মানুষের কাছে নিয়ে যান ছাত্রলীগ। ১১ দফার মাধ্যমে ছাত্রসমাজের রক্তে প্রবাহ সঞ্চার করে ছাত্রলীগ। ১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছাত্র আন্দোলন থেকে রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। গণজাগরনে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মুক্তির সনদ ছয় দফাকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এক দফার গণভোটে রূপ দেয়। এরপর ১৯৭১ সালে ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ আর দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা। তখনও সামনে ছাত্রলীগ।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কোনঠাসা হয়ে পড়ে। সামরিক শাসনের মধ্যেও ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দশ দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ১৯৯৮ সালে দেশে ভয়াবহ বন্যা। তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগ কর্মীরা তিন শিফটে রুটি তৈরি করেছেন, তৈরী করেছেন দুর্যোগপূর্ণ এলাকার মানুষের জন্য খাবার স্যালাইন। দুর্গত এলাকায় ক্যাম্প করেছেন। নিরক্ষরতা মুক্ত, পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ও বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে বিশ্বের উষ্ণায়ন কমাতে প্রতিটি জেলায় জেলায় কাজ করেছেন ছাত্রলীগ।
২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা এবং দেশব্যাপী সাংগঠনিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ প্রতিরোধ রচনা করেছেন প্রতি জনপদে। ১৯৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলন করেছেন ছাত্রলীগ নিজ দলের সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু আজকের ছাত্রলীগ দিশেহারা। তাঁরা রাজনীতি বুঝতে চাইতেছেন না। তাঁরা কালের ভাষা, মাটির জিকির কিংবা ভূরাজনীতির বাস্তবতা-কিছুই বুঝতেছেন না। তাঁরা অনবরত ট্রেন মিস করতেছেন। তাঁরা ভুলে গেছেন একটি ছাত্র রাজনেতিক সংগঠনের কাজ শুধু নিজ দলের সরকারের মন যুগিয়ে চলা নয়! বরং ছাত্রদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে আন্দোলন করা।
কোটা আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকার কথা ছিলো ছাত্রলীগের। কিন্তু তাঁরা ট্রেন মিস করে বসে আছেন। আগামিকাল যদি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, মহাবিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয় তবে তাঁদের ভোট কি এমপি, মন্ত্রী আর সরকার এসে দিয়ে যাবেন ! তাঁরা কি নিজেদের অন্তর্নিহিত শক্তিতে টিকতে পারবেন! তাঁদের সাথে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা কি আছেন। কিংবা তাঁরা কি গণমানুষের সাথে আছেন!
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট