ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

দ্বারে দ্বারে বিষমুক্ত খাবার পৌঁছে দেন দোলোয়ার   

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ০৬:৪৪ পিএম, ২৭ এপ্রিল ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ১১:০৯ এএম, ২৮ এপ্রিল ২০১৮ শনিবার

দেলোয়ার জাহান

দেলোয়ার জাহান

দোলোয়ার জাহানের জন্ম কুষ্টিয়ার গোপালপুর গ্রামে। সেখান থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। পড়ালেখা শেষ করে একটি জাতীয় দৈনিকে কৃষির ওপরে সাংবাদিকতা করতেন দেলোয়ার জাহান৷ সবকিছুর মাঝেও তিনি এক ধরনের শূণ্যতা অনুভব করতেন। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন মানুষের জন্য কিছু করার। নিজের বন্ধুরা যখন খেলাধুলা বা অন্যকিছু নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় গ্রামের কৃষকদের ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করতেন দেলোয়ার। এভাবে প্রকৃতির সঙ্গে গড়ে উঠে তার গভীর সখ্য। সেই বন্ধন থেকেই সবার দ্বারে দ্বারে বিষমুক্ত খাবার পৌঁছে দিতে কাজ করছেন এ তরুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন বিষমুক্ত খাদ্য আন্দোলন সংগঠন ‘প্রাকৃতিক কৃষি’ বর্তমানে প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের সমন্বয়কারী ও প্রান্তজনীয় যোগাযোগ গবেষণা কেন্দ্রের (প্রাযোগ) পরিচালক দেলোয়ার জাহান।      

বিষমুক্ত খাবার সরবরাহের উদ্যোগ, আন্দোলন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সম্প্রতি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন একুশে টিভি অনলাইনকে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একুশে টিভি অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান।

তার কথায় ওঠে আসে রাসায়নিক সার আর কীটনাশক ব্যবহারের বিরুদ্ধে ও প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাস করে কিভাবে বিষমুক্ত খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব। এছাড়া বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে নানা সংলাপের মাধ্যমে কৃষকের সমস্যা, ফসলের ক্ষয়ক্ষতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি।   

একুশে টিভি অনলাইন: কি উদ্দেশ্য এই সংগঠন করেছেন? মানুষের মধ্যে এর সাড়া কেমন?

দোলোয়ার জাহান: বর্তমানে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ এই দুই ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিদিন ফসল উৎপাদনের জন্য এক লাখ কেজির বিষ ব্যবহার করছে কৃষকরা। এর মধ্যে প্রায় ৫০ কোটি টাকার কীটনাশন ব্যবহার করছে তারা। এগুলো কোনো না কোনোভাবে মানুষ খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করছে। ফলে দিনে দিনে মানুষের মধ্যে রোগবালাই বৃদ্ধি পাচ্ছে।  

এছাড়া বাংলাদেশে সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রতি ৮ জনে ১ জনের কিডনিতে সমস্যা আছে। অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছে ডায়াবেটিসে। এছাড়া আমাদের দেশে জীব বৈচিত্র এখন প্রায় ধ্বংসের মুখে। দিনকে দিন পশু পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব আস্তে আস্তে মানুষের ওপরে পড়বে। বাংলাদেশের মানুষ বছরে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার গ্যাস এর ওষুধ সেবন করে। কীটনাশক ব্যবহার করার কারণে একদিকে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যদিকে জীব বৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে। কীটনাশক যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করার কারণে মানুষ কোন না কোন সময় হাসপতাল মুখী হচ্ছে। এই ধ্বংস প্রক্রিয়া থেকে মানুষ ও বীজ বৈচিত্র রক্ষা করার জন্যই আমাদের এই আন্দোলন। পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব কৃষিব্যবস্থা। 

কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলে পুরো কৃষিব্যবস্থার চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও গ্রোথ হরমোন ইত্যাদির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে চাষাবাদের জমি হারাচ্ছে প্রাণশক্তি।

রাসায়নিক সার আর কীটনাশক ব্যবহারের বিরুদ্ধে ও প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাস করে কৃষিকে রক্ষার আন্দোলন হিসেবেই শুরু হয় এই সংগঠন। আমরা বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে নানা সংলাপের মাধ্যমে কৃষকের সমস্যা, ফসলের ক্ষয়ক্ষতিসহ নানা বিষয়ে তথ্য দিয়ে থাকি। এর কিছুদিনের মধ্যেই চাষের জন্য জমি খুঁজতে শুরু করা হয়।

একুশে টিভি অনলাইন: কবে থেকে এ কার্যক্রম শুরু করেছেন? সেটা কোথায়?    

দোলোয়ার জাহান: ২০১৩ সালের মার্চ মাসে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার আমতলী গ্রামে একটি ছোট নদীর পাড়ে জমি লিজ নিয়ে রাসায়নিক সার ও বিষমুক্ত প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সবজিচাষের মাধ্যমে শুরু করি প্রাকৃতিক কৃষির কার্যক্রম। সাপ্তাহিক ছুটিতে মানিকগঞ্জে গিয়ে ক্ষেতে কাজ করতাম। বর্তমানে প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের সঙ্গে কাজ করছেন প্রায় ৩০ জন কর্মী ও ১০০ জন স্বেচ্ছাসেবক। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অসংখ্য কৃষকও যুক্ত আছেন এই আন্দোলনের সঙ্গে।

একুশে টিভি অনলাইন: সাংবাদিকতা ছেড়ে কেন এমন কাজে আসলেন?    

দোলোয়ার জাহান: আপনার প্রশ্নের মতো অনেকেই আমাকে এমন প্রশ্ন করে আপনি কেন সাংবাদিকতা ছেড়ে এই কাজে আসলেন। সর্বশেষ ‘সকালের খবর’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আরও কয়েকটি পত্রিকায় কাজের প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু যোগ দেয়নি। কারণ গত ৯ বছর ধরে আমি নিজেকে প্রস্তুত করেছি যেন সাংবাদিকতা ছেড়ে নিজের কাজে সারাক্ষণ থাকতে পারি।

যারা কৃষি নিয়ে লিখতো, ওই সব সাংবাদিক বন্ধুদের ভীষষভাবে মিস করি। তারাও করে। একসঙ্গে কৃষক ও প্রাণ প্রকৃতির পক্ষে সাংবাদিকতার লড়াইটা চালিয়ে যাওয়া খুব জরুরি ছিল। কিন্তু আমি এখন যা করছি প্রান্তজনীয় যোগাযোগ গবেষণার লাইন ধরে প্রাকৃতিক কৃষি, সেটা আমার মত করে আমাদের গ্রুপের কেউ করতে পারছিল না। সাংবাদিকতায় থাকা অবস্থায় বিগত ৫ বছরের সাপ্তাহিক ছুটি ও অন্যান্য ছুটিগুলোও আমাকে প্রাকৃতিক কৃষির কাজে কাটাতে হয়েছে।

আমি রোববার অফিস করে রাতে কোনো গ্রামে চলে যেতাম। এরপর সারাদিন কাজ করে আবার রাতে ফিরে এসে পরের দিন অফিস করতাম। তবে এভাবে আর সম্ভব হচ্ছিল না। গ্রামে যে কাজগুলো আছে সেগুলো ঠিকভাবে হচ্ছে না। তাই সাংবাদিকতা ছেড়ে এখন পুরোপুরি এ কাজে নেমে পড়লাম। আমি মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই। মানুষের উপকার হয় এমন কাজগুলো করার ইচ্ছা। মনুষ যেন সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে সেই কাজই সারা জীবন করে যাবো।

একুশে টিভি অনলাইন: এই আন্দোলনের মাধ্যমে আপনারা কি কি কাজ করে থাকেন?  

দোলোয়ার জাহান: মানুষের ধারণা ছিল কীটনাশন ছাড়া কোন ধরনের ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়। আমরা মানুষের এই ধারণাকে পাল্টে দিয়েছি। সবাইকে দেখানোর চেষ্টা করছি কীটনাশন ছাড়াও ফসল উৎপাদন সম্ভব। আমাদের এই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের সব এলাকায় হয়ত কীটনাশক মুক্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি মানুষকে একটা পথ দেখানোর। যার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্ম এই পথ ধরে কাজ করতে পারে। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ার সময় পাঠ্য হিসেবে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের কথা পড়তে হয়েছে। বাংলার মানুষের যোগাযোগ নিয়ে কেন পড়ানো হচ্ছে না? এমন আপত্তি থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বাংলার মানুষের যোগাযোগের ইতিহাস উদ্ধারের অভিযান আমরা শুরু করি। মানুষের আদি যোগাযোগের ধরণটি অনুসন্ধান করতে ২০১২ সালে আমরা কাজ শুরু করি। আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি। যেখানে একটি জমির উর্বরতা শক্তি ধরে রাখতে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষের প্রয়োজন, সেখানে বেশি লাভের আশায় একই জমিতে বারবার একই ফসল চাষ করা হচ্ছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক, গ্রোথ হরমোন ছাড়া ভালো ও বেশি ফসল ফলানো সম্ভব নয়, এমন ধারণার কারণেই কৃষকেরা হয়ে উঠছে নানা রাসায়নিক পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল।

তাছাড়া রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিয়ে উত্পাদিত ফসলের কারণে প্রাকৃতিকভাবে উত্পাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না বহু কৃষক। এমন অবস্থায় চাষিদের ফসলের ন্যায্যমূল্য দিতে ‘প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলন’ ২০১৪ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকায় ‘প্রাকৃতিক কৃষি ফসল বিপণন’ কার্যক্রম শুরু করি। এখানে সংগঠনের নিজস্ব খামার মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া ছাড়াও ঝিনাইদাহ, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, মেহেরপুর, ধামরাইয়ের বেশ কয়েটি গ্রাম থেকে আসছে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশবান্ধব উপায়ে উত্পাদিত সবজি, ফল, বীজ। পথচলার পর থেকেই ‘প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলন’ অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছে। তবু থেমে যায়নি।

একুশে টিভি অনলাইন : বিশ্বমুক্ত খাদ্য সরবরাহে আপনার ভবিষৎ পরিকল্পনা কি?  

দোলোয়ার জাহান: আমরা গ্রাম রক্ষা আন্দোলন নিয়ে কাজ করব। বাংলাদেশের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় কৃষি খাত ও জীব বৈচিত্র্য হুমকির মুখে। ভালোবাসা থেকে যদি তরুণ সমাজ এগিয়ে আসে তাহলে এই ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তাছাড়া কৃষিখাতে কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করাও সম্ভব। আমরা বিষমুক্ত খাবার সরবরাহ করে মানুষের সু স্বাস্থ্য নিশ্চিতে কাজ করে যেতে চাই।   

এসি