ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

বিবিসির বিশ্লেষণ: দুই কোরিয়ার শান্তি বৈঠক

কৃতিত্ব কার, যুক্তরাষ্ট্র না চীনের?

প্রকাশিত : ০১:২৫ পিএম, ২৮ এপ্রিল ২০১৮ শনিবার

ছয় দশক ধরে দুই কোরিয়ার সম্পর্কটা এ রকম যে, এক দেশের সীমান্তে শান্তির পায়রা উড়ল তো অন্য সীমান্তে গুলির শব্দ। দীর্ঘ ৬৫ বছরের যুদ্ধংদেহী মনোভাব থেকে সরে শান্তির নতুন যুগে প্রবেশ করল দুই কোরিয়া।

গতকাল শুক্রবার উত্তরের সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন এবং দক্ষিণের প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন সীমান্তবর্তী গ্রামে ঐতিহাসিক বৈঠক শেষে পানমুনজুম ঘোষণা দিয়েছেন, যা নতুন ঐতিহাস সৃষ্টি করেছে। ঘোষণায় দুই নেতা দু’দেশের ৮ কোটি নাগরিকের উদ্দেশে বলেছেন, দুই রাষ্ট্র আর কখনও যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। দুই দেশই স্নুায়ুদ্ধকালীন বৈরিতা দ্রুত ঘুচিয়ে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর চেষ্টা চালাবে। কোরীয় উপদ্বীপকে সম্পূর্ণ পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করার বিষয়েও দু’দেশ একমঞ্চে দাঁড়িয়েছে। বৈঠকে দুই নেতার মধ্যে আন্তরিকতায় কোনো খুঁত ছিলো না। কিম জং উন নিজ দেশের ঠাণ্ডা নুডলস নিয়ে গেছেন প্রতিবেশি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য। আর শান্তির স্মারক শেষে দুই কোরিয়ার সীমান্তে পাইন লাগান দুই নেতা।

দুই কোরিয়ার এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির জন্য এরই মধ্যে নিজের কৃতিত্ব দাবি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবশ্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে, ট্রাম্প কি সত্যিই এর কৃতিত্ব পেতে পারেন? তবে তাকে একক কৃতিত্ব দিতে নারাজ বিশ্নেষকরা। তাদের যুক্তি, সংলাপের পরিবেশ তৈরিতে আসলে মূল ভূমিকা পালন করেছে সিউল। ট্রাম্পকে কৃতিত্ব দেওয়া আসলে সিউলের কৌশলমাত্র। এর লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রকে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার টেবিলে আনা। পর‌্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন, দুই কোরিয়ার এই শান্তি আলোচনায় ট্রাম্পকে কৃতিত্ব দিলে চীনের অবদানকে খাঁটো করে দেখা হবে। কারণ দুই কোরিয়ার বৈরিতা দূরীকরণে উত্তরকে চাপে রেখেছে মিত্র দেশ চীন।

বিশ্নেষকদের অন্য একটি অংশ দক্ষিণ কোরিয়ার পাশাপাশি চীনকেও এ ক্ষেত্রে বড় কৃতিত্ব দিতে চায়। তাদের মতে, উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার পক্ষে গত বছর থেকে সমর্থন দিতে শুরু করে বেইজিং। সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ও সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীনের এই অবস্থান উত্তর কোরিয়াকে প্রবল চাপে ফেলে দেয়। বাধ্য হয় আলোচনার পথে হাঁটতে। তাছাড়া ট্রাম্পের আক্ষেপ থেকেও তা টের পাওয়া যায়। তিনি বলতেন, এ ক্ষেত্রে চীনের আরও কঠোর ভূমিকা নেওয়া দরকার। আর দুই কোরিয়ার বৈঠকের আগে কিমের গোপন চীন সফর থেকেও বেইজিংয়ের ভূমিকা টের পাওয়া যায়।

গত জানুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়াকে নববর্ষের শুভেচ্ছা বার্তা পাঠায় উত্তর কোরিয়া। তাতে দক্ষিণের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপনে রাজি বলে জানায় কিমের পিয়ংইয়ং। কয়েকদিনের মাথায় শীতকালীন অলিম্পিকে যোগ দিতে সম্মত হয় পিয়ংইয়ং। জানুয়ারির আগ পর্যন্ত পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে দুই কোরিয়ার চলমান উত্তেজনার মধ্যে এ ছিল বড় এক বাঁক। শীতকালীন অলিম্পিকে কিম পিয়ংইয়ংয়ের প্রতিনিধি হিসেবে বোন কিম ইয়ো জংকে পাঠান। বোনের হাতে দক্ষিণ কোরীয় প্রেসিডেন্টকে উত্তর কোরিয়া সফরের আমন্ত্রণপত্র পাঠান। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে তা বড় ভূমিকা রাখে। একইভাবে দক্ষিণ কোরীয় দূতের মাধ্যমে ট্রাম্পকেও আমন্ত্রণ পাঠান কিম। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনেতাদের বৈঠকে বসার সুযোগ তৈরি হয়।

শীতকালীন অলিম্পিক প্রশ্নে দুই কোরিয়ার সমঝোতার কয়েকদিন পর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট করেন। টুইটে বলা হয়, `সব ব্যর্থ `বিশেষজ্ঞ` যুক্তিকে সরিয়ে কেউ কি সত্যিই বিশ্বাস করবে, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে যে আলোচনা চলছে আমি দৃঢ় না থাকলে তা হতো না। আমি শক্ত না থাকলে, উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের সামগ্রিক সক্ষমতা ব্যবহারের অঙ্গীকার না করলে এমনটা হতো না। এর কয়েকদিন পর দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইনও ট্রাম্পকে কৃতিত্বের দাবিদার বলে উল্লেখ করেন।

২০০৬ সালে প্রথম পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালায় উত্তর কোরিয়া। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা উত্তর কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ভারী অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ, ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি এবং বিলাসবহুল মালামালসহ বিভিন্ন বিষয়ে উত্তর কোরিয়ার ওপর ৯ দফা নিষেধাজ্ঞা দেয় নিরাপত্তা পরিষদ। বেশিরভাগই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত। কয়েক বছর ধরে এ নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়।

২০১৭ সালের ডিসেম্বর নাগাদ জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার আওতা বাড়ানো হয়। এ সময়ের মধ্যে উত্তর কোরিয়ার তেল আমদানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ এবং লোহা, কৃষিজাত পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পাশাপাশি বিদেশে কর্মরত উত্তর কোরীয় নাগরিকদের বিতাড়িত করার দাবিও জানানো হয়। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে উত্তর কোরিয়ার ৫০টি জাহাজ ও সামুদ্রিক পরিবহন কোম্পানির ওপর অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নতুন এই অবরোধকে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের কৌশল বলে অভিহিত করেন।

উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে মিত্র দেশ চীনও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে সম্মতি দেয়। চাপের মুখে পড়ে পিয়ংইয়ং। চীন একটি বড় প্রভাবক। কারণ, উত্তর কোরিয়ার মোট বাণিজ্যের ৯০ শতাংশেরও বেশি চীনের সঙ্গে হয়ে থাকে। অতীতে দেখা গেছে, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা যখন উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার পক্ষে ভোট দিত তখন তাতে চীন খুব কমই সমর্থন দিত। কিন্তু গত বছর নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের পক্ষে সম্মতি দেয় চীন।

বিশ্নেষকদের অনেকেই মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণেই আলোচনায় অংশ নিতে বাধ্য হয়েছেন কিম। আসান ইনস্টিটিউটের গবেষক কিম বলেন, দক্ষিণের সঙ্গে বৈঠককে উত্তর কোরিয়া দেখছে `ওয়াশিংটনকে শান্ত করার এবং নিষেধাজ্ঞার মতো ইস্যুগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করার একমাত্র উপায়` হিসেবে।

 

তবে অ্যাস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ভারজিনি গরজেলচোজিক বলেন, উত্তরকে আলোচনায় রাজি করাতে দক্ষিণ কোরীয়দেরই কৃতিত্ব বেশি। উত্তর কোরিয়াকে অলিম্পিকে আনা নিশ্চিত করতে তারাই জোর চেষ্টা চালিয়েছে।` তাহলে দক্ষিণ কোরিয়া কেন ট্রাম্পকে কৃতিত্ব দিচ্ছে?

অ্যাস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ এ প্রভাষক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনার টেবিলে আনতে দক্ষিণ কোরিয়া কৌশলে কাজ করছে। কারণ, দুই কোরিয়াই যুক্তরাষ্ট্রের কোরীয় নীতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে।

উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সানশাইন পলিসি গ্রহণ করেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দায়ে জুং (১৯৯৯-২০০৩) এবং রোহ মুন হিউন (২০০৩-০৮)। তাদের চেষ্টায় উত্তর কোরিয়ার নেতাদের সঙ্গে ২০০০ এবং ২০০৭ সালে দুটি বৈঠক হয়েছিল। কিম দায়ে জুং তার প্রচেষ্টার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইনের আগের দুই প্রেসিডেন্ট হলেন লি মিয়ুং বাক (২০০৮-২০১৩) এবং পার্ক জিউন হাই (২০১৩-২০১৭)। লি মিয়ুং বাক উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। তবে পার্ক জিউন হাই উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার অঙ্গীকার করেছিলেন।

কিন্তু পিয়ংইয়ংয়ের ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালের শুরুতে ওই কৌশলটির সমাপ্তি ঘটে। ২০১৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মুন জায়ে ইন। উদ্বোধনী ভাষণেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছু দরকার সবই করবেন। পূর্বের সেই সানশাইন পলিসিতে ফিরে যায় দক্ষিণ কোরিয়া।

সূত্র : বিবিসি।

/ এআর /