ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

প্রিয় লন্ডনে অপ্রিয় অভিজ্ঞতা

শফিকুল ইসলাম জীবন  

প্রকাশিত : ১১:৪৩ পিএম, ২৮ এপ্রিল ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ১২:০৪ এএম, ২৯ এপ্রিল ২০১৮ রবিবার

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি কমিউনিটির কিছু অংশ এক অর্থে একটি পাকিস্তানি কমিউনিটি। সেখানে আমাদের কিছু প্রবাসী কখনো আমাদের (বাঙালিদের) পক্ষে কথা বলে না। সেখানে কয়েক বছর বাস করার ফলে এটা আমার নিজস্ব উপলদ্ধি এবং বিশ্বাস। দেশ সম্পর্কে এদের ভাবনা এবং এদের আচার আচরণ নিয়ে শুরু থেকে আমার একটা আগ্রহ ছিল। তাই খুব কাছ থেকে তাদের দেখার এবং জানার সুযোগ আমি হাতছাড়া করিনি।

জনকণ্ঠে আমার কিছু রিপোর্ট ছাপা হওয়ার কারণে আমিও সেখানে একাধিকবার আক্রমণের মুখে পড়েছি। সেই সব প্রসঙ্গে নাই গেলাম। লন্ডনে বাণিজ্য মেলার নামে আদম পাচার আর অর্থ আত্মসাৎ নিয়ে জনকণ্ঠে একটা রিপোর্ট করার কারণে একবার তো আমাকে প্রায় দুই সপ্তাহ আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল। আর এই ঘটনাটি পূর্ব লন্ডনের বহু নেতাই জানেন, কিন্ত তারা কখনো আমাকে সাহায্য করেননি। বরং দাঁড়ি টুপি পরে নিজের চেহারা বদলে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন। আর এই হচ্ছে সেখানে আমাদের কমিউনিটি নেতা। যাই হোক ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এলো এই কারণে যে একাত্তর টিভির বিশেষ প্রতিনিধি ফারজানা রুপাও সেখানে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এই কারণে আজকে আমার এ নিয়ে একটু লিখতে ইচ্ছে হলো।

আন্তর্জাতিক অপরাধ  ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ আমার ফেসবুকের বন্ধু তালিকায় আছেন। মানবতা বিরোধী অপরাধ সম্পর্কে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিরি কার্যক্রম নিয়ে তিনি এবং শাহরিয়ার কবিরের যুক্তরাজ্য সফরকালে আমি পূর্ব লন্ডনের দেশ টিভি নামক একটি কমিউনিটি চ্যানেলে তাদের নিয়ে আলাদা দুটি লাইভ টক-শো করেছিলাম। তখন আমি ওই টিভির বার্তা বিভাগটি দেখতাম। লাইভ অনুষ্ঠানটি প্রচার শেষে বাসায় যাওয়ার পথে একজন এক বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমার মুখে থাপ্পড় মেরেছেন। বলেছিল কখনো যেনো আর এই ধরনের অনুষ্ঠান না করি। ব্যারিস্টার তুরিনের হয়তো মনে আছে, লাইভ চলাকালে অনেক ফোন কল আসছিল এবং খুবই বাজে ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছিল। এক মহিলা চিৎকার করে বলছিলেন, যুদ্ধাপরাধের নামে আপনারা যা শুরু করছেন আল্লাহর গজব নামবে বাংলাদেশের ওপর, ইত্যাদি ইত্যাদি।

ব্রিটেনে বাঙালি কমিউনিটি নেতা বলতে আমি মনে করি কিছু নেতা সরাসরি মৌলবাদ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সাথে জড়িত। এদের মধ্যে একটি অংশের বৈবাহিক সম্পর্কগুলো গড়ে ওঠে পাকিস্তানিদের সাথে। আমার দেখা মতে, প্রতি পাঁচটি বাঙালি পরিবারের কমপক্ষে তিনটি পরিবারের সাথে পাকিস্তানি কমিউনিটির আত্নীয়তা রয়েছে। পাকিস্তানি মেয়েরা বাঙালি ছেলেদের কাছে নাকি প্রথম পছন্দ। ফলে সেখানে এখনও উর্দু এবং ইংরেজির সংমিশ্রিত ভাষাটাই বেশি চলে। আর এই চিত্র লন্ডনের বাইরের শহরগুলোতে আরও বেশি চোখে পড়ে।

ফলে ব্রিটেনে বসবাসরত ওই ধরনের বাঙালিদের নিয়ে আমাদের ওতো উচ্ছসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ তারা সুযোগ সন্ধানী একটি চক্র। তারা আমাদের দেশের কোন সম্পদ বলে মনে করি না। এমন কি তারা ব্রিটেনের জন্যও একটা বোঝা। তারা সেই দেশেরও সম্পদ হতে পারেননি। যুক্তরাজ্য বেনিফিট এবং শ্যেম ম্যারেজ নিয়ে আজ পর্যন্ত যতগুলো কঠোর আইন কানুন করেছে-তার বেশির ভাগই বাঙালি কমিউনিটিকে লক্ষ্য করে। ফলে এরা ব্রিটেনে থেকেও একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বাস করে।

মূলধারার রাজনীতি এবং ব্যবসা বাণিজ্যে দু’ একজনের যে সম্পৃক্ততা- সেটি মূলত ভোট ব্যাংকের রাজনীতির কারণে। সেটি কারও একান্ত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং যোগ্যতার ফসল বলে আমি মনে করি না। এর আগে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে যিনি মেয়র ছিলেন তিনি একজন কট্টর মৌলবাদী এবং সরাসরি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সাথে জড়িত। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল ইস্ট লন্ডনে পাকিস্তান এবং বাঙালি কমিউনিটির বদলৌতে।

ইস্ট লন্ডনের আফতাব আলী পার্কে যে শহীদ মিনারটি হয়েছে- বলা চলে সেটি মূলত প্রতিবছর বাংলাদেশকে হেয় এবং অপমান করার জন্যই। আমি বলবো, ওই শহীদ মিনার আমাদের প্রয়োজন নেই। পারলে যুক্তরাজ্য সরকারকে অনুরোধ করতে হবে শহীদ মিনারটি তুলে দিতে। আর না হয় সেটির মর্যাদা রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কারণ প্রতিবছর যে মর্যাদা এবং শ্রদ্ধার সাথে সেখানে শহীদদের বেদীতে ফুল দেওয়ার কথা- ঘটে তার উল্টোটা। সেখানে সন্ধ্যা থেকেই এই বাংলাদেশি প্রবাসী নামধারীরাই বিয়ারের বোতল নিয়ে আড্ডাবাজি শুরু করে দেয়। বলতে লজ্জাও হয়, সেন্ট্রাল লন্ডনের মতো এই জায়গাটিতে প্রভাতফেরীর দিন প্রশ্রাবের গন্ধে সেখানে ঢোকা যায় না।

গত কয়েক বছর ধরে ইস্ট লন্ডনে যে বৈশাখী মেলা হয়, সেটিও মূলত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল থেকে বরাদ্দ পাওয়া কিছু অর্থ লুটেপুটে খাওয়ার জন্য। আমার কয়েক বছরের লন্ডন জীবনে আমি কোনদিন সেখানকার প্রতিষ্ঠিত নেতৃবৃন্দ, বড় বড় ব্যবসায়ী, ধনাঢ্য ব্যক্তির মুখে ঘুনাক্ষরেও বাংলাদেশের প্রতি যে তাদের সামান্য ভালোবাসা এবং মমতা আছে সেটি খুঁজে পাইনি। অবশ্য এরা যখন অতিথি পাখির মতো বাংলদেশে আসেন, তখন তাদের চোখ দিয়ে কখনো কখনো দেশের প্রতি প্রেম  ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়তে দেখি। কিন্তু যুক্তরাজ্যের মাটিতে এদের চরিত্র এবং রুপ যেমন  ভয়ঙ্কর তেমনি উদ্ভট। তারা প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে দ্বিধাবোধ করে না।

ইস্ট লন্ডন ভিত্তিক কয়েকটি ইসলামী সংস্থা চ্যারিটির নামে বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নের সাথে সরাসরি জড়িত। আমাদের নীতি নির্ধারকরা যদি এদের কর্মকাণ্ড এবং আদর্শ সম্পর্কে সামান্যতমও ধারনা রাখতো, তাহলে তাদের এই দেশে কর্মকান্ড পরিচালনা করার সুযোগ পাওয়ার কথা না। আমার নিজ চোখে দেখা, ওই সব সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর দায়িত্বে আছে পাকিস্তানিরাই।

বাংলাদেশ থেকে পাড়ি দিয়ে এরা সুদূর ব্রিটেনে কমিউনিটি সৃষ্টি করেছে ঠিকই, কিন্তু তারা না হতে পেরেছে ব্রিটিশ না থাকতে পেরেছে বাংলাদেশি হয়ে। আমার জানা মতে, বিশ্বে এখনও পর্যন্ত যতগুলো আক্রোশী বর্ণবাদী গোষ্ঠি আছে, তার মধ্যে একটি বাংলাদেশি গোষ্ঠি যারা যুক্তরাজ্যে বসবাস করে। এদের ঘৃণা এবং হিংসা প্রকাশের ধরন যেকোন হিংস্রতাকে হার মানায়। দেশের বিশেষ একটি অঞ্চলের বাইরে বাংলাদেশের বাকি যেকোন অঞ্চলের মানুষ এদের কাছে ঢাকাইয়া হিসেবে পরিচিত। এমন কি ওই বিশেষ অঞ্চলের ভাষার বাইরে কথা বলা হলেও তারা ’ঢাকাইয়া’ বলে নানা অপ্রীতিকর মন্তব্য করতে থাকে। যা মানা খুবই কষ্টকর।

ওরা ওদের অঞ্চলের বাইরে ভুলক্রমেও কাউকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি বা কাজের সুযোগ দেয় না। কাজের যোগ্যতা হিসেবে তারা আগে দেখে, বিশেষ অঞ্চলের ভাষায় সে কথা বলছে কিনা।

লেখক: সিইও এন্ড লিড কনসালট্যান্ট, গ্লোবাল গ্লোবাল স্টাডি কনসালটেন্সি

(লন্ডন অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত)