নির্দেশনা উপেক্ষা করেই চলছে কোচিং
রিজাউল করিম
প্রকাশিত : ০৮:২২ পিএম, ২৯ এপ্রিল ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৮:২৬ পিএম, ২৯ এপ্রিল ২০১৮ রবিবার
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। কোচিং সেন্টারগুলো ভর্তিসহ দাপ্তরিক সব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দেদারসে। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। কোনো কোনো কোচিংয়ে বাহির থেকে গেট বন্ধের নোটিস থাকলেও ভিতরে তৈরি হচ্ছে লেখচার শিট। আবার কোনো কোনোটায় চলছে পরীক্ষা। রাজধানী ঢাকার কয়েকটি কোচিং সেন্টার ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
সম্প্রতি পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নপত্র ফাঁস উদ্বেগজন পর্যায়ে যাওয়ায় কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দেশনা দেওয়া হয় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে ২৯ মার্চ থেকে দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকার কথা ছিল। এ নির্দেশনা পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত থাকবে বলে জানানো হয়। একইভাবে কোচিং বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয় এসএসসি, মাদরাসা বোর্ডের দাখিল ও কারিগরি বোর্ডের পরীক্ষা প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের ব্যাপারেও। দেশের আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এসব পরীক্ষা শুরু হয়। শেষ হবে ১৪ মে। অর্থাৎ ১৪ মে পর্যন্ত সব কোচিং সেন্টারের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে সন্দেহের তালিকায় থাকা কোচিংগুলোর লাগাম টানতে সরকার পরীক্ষা চলাকালে কোচিং বন্ধের এ কঠোর নির্দেশনা দেয়। কিন্তু বাস্তবতায় সরকারের সে নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে বেশিরভাগ কোচিং সেন্টারে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর ফার্মগেটের কনকর্ড টাওয়ারের চতুর্থ তলায় সানরাইজ কোচিং সেন্টার ব্যাঞ্চে বন্ধের একটি নোটিশ টানিয়ে রেখেছে। কিন্তু ভিতরে ঢুকে দেখা গেলো কোচিং সেন্টারের ডেস্কে দুইজন বসে আছেন। যাদের একজন পুরুষ, অন্যজন নারী। ভিতরে ঢুকতেই প্রতিবেদককে উদ্দেশ্য করে তারা আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলেন কি? ভর্তি হবেন? প্রতিবেদক জানতে চাইলেন আপনাদের ক্লাস কবে শুরু হবে? তখন ডেস্কে থাকা দুই ব্যক্তি ভিতরে বসে থাকা ছ্যারের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ জানায়।
ভিতরে প্রবেশ করেই দেখা যায় নির্বাহী কর্মকর্তা মহিন আহমেদ ও আসমত আরা নামে দুইজন বসে আছেন। সাংবাদিক পরিচয় না দিয়েই তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ভর্তি বিষয়ের নানা তথ্য। ভর্তির তথ্য নেওয়ার এক পর্যায়ে জানতে চাওয়া হয় সরকার কোচিং বন্ধের ঘোষণা দিলেও কেন তারা কোচিং
খোলা রেখেছেন। উত্তরে আসমত আরা বলেন, আমরা আমাদের ভ্যাটের কাগজগুলো হিসেব-নিকেশ করছি। তাছাড়া আমাদের অফিস ভাড়া ও অন্যান্য বিষয়ের আনুষঙ্গিক কাজ করছি। এগুলো যদি না করি তবে তো আমাদের বেতনই দেওয়া হবে না। মূলত কোচিং বন্ধ-ই আছে।
তবে কোচিং যদি বন্ধ থাকে কেন আমাকে কোচিংয়ের তথ্য জানতে ডেস্কে থাকা লোক আপনাদের কাছে নিয়ে আসলো? এমন প্রশ্নে মহিন আহমেদ বলেন, আসলে বিষয়টি হলো এমন যে আমাদের ভর্তি কার্যক্রম অনলাইনে চলছে। অনেকে আবার সশরীরে আসছে ভর্তি তথ্য জানতে, তাদের তথ্য দিচ্ছি মাত্র।
ভর্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে মহিন আহমেদ বলেন, আমাদের এখানে সকাল ৮টা থেকে ১১টা, ১১টা থেকে দুপুর ১টা এবং দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মোট তিনটি শিফটে কোচিং হয়। প্রতিদিনই প্রাই ১২০ জন শিক্ষার্থীর কোচিং ক্লাস হয়। কিন্তু সরকারি বন্ধের ঘোষণায় এখন ক্লাস বন্ধ। আমাদের ব্যাচ শুরু হবে আগামী ২৬ মে। এরই মধ্যে ৯০ জনের বুকিং হয়ে গেছে। প্রত্যেকের কাছ থেকে আমরা ১৩ হাজার টাকা করে নিচ্ছি। তবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করে সেটা প্রায় ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত পড়ছে।
তবে এ কোচিং সেন্টারের পাশের ভবনের তৃতীয় তলায় দেখা গেলো অনেক ছাত্র-ছাত্রী উঠানামা করছে। তাদের গতি লক্ষ করে তিন তলায় গিয়ে দেখা যায় সেখানে কোচিং চলছে। প্রায় ২০ জন ছাত্রের ক্লাস নিচ্ছেন ফাইবার কোচিং সেন্টারের রিপন ইসলাম। দেখা মাত্রই সাংবাদিক বুঝতে পেরে রিপন ক্লাস বন্ধ করে দেন। অনুরোধ করেন ক্লাসের ছবি না নিতে। পরে বাইরে এসে বলেন, ভাই আমি বুটেক্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। জামালপুরে আমার বাড়ি। আগে টিউশনি করে চলতাম। অনেক কষ্ট করে এ প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছি। গত একমাস ধরে আমি এ কোচিং চালু করেছি। যাদের ক্লাস নিতে দেখলেন ওরা নাইন ও টেনের ছাত্র। ৮০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা করে ওরা আমাকে দেয়। আর অন্যরুমে যাদের দেখলেন ওরা তো ক্লাস করতে আসেনি। আগামী ২০ মে ভর্তি কোচিং শুরু হবে, তাই লেকচার শিট তৈরি করছে। এই প্রতিষ্ঠানটা চালাতে আমাকে ৩০ হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিতে হয়। পুরো বন্ধ করে দিলে আমি এ টাকা কোথায় পাব। আবার ভর্তি কার্যক্রম এখন বন্ধ থাকলে মাস শেষে ছাত্র পাব কোথায়। এ পর্যন্ত মাত্র চারজন ছাত্র ভর্তি হয়েছে।
ফার্মগেটের রেটিনা কোচিং সেন্টারে দেখা গেছে বন্ধের নোটিশ ঝুলছে। যেখানে পাঁচজন ভর্তি সংক্রান্ত তথ্য নিতে এসেছেন। যাদের একজন মতিয়ার রহমান। দিনাজপুর থেকে তিনি এসেছেন ছেলের ভর্তি সংক্রান্ত তথ্য নিতে। এখন তারে ছেলে ক্যাম্বিয়ানে পরীক্ষা দিচ্ছে। রেটিনা সেন্টারের গেটে লাগানো নোটিশে অনলাইনে ফরম পূরণের নিয়মটা তিনি ভালো করে পড়ার চেষ্টা করছিলেন। নোটিশে দেওয়া নম্বরটি তিনি সংরক্ষণ করলেন পরে ফোনে যোগাযোগ করবেন এ আশায়।
কনকর্ড টাওয়ারের পঞ্চম তলায় গিয়ে দেখা যায় সেখানে শুনশান নিরিবিলি পরিবেশ। গেটের মুখে যেন ভুতুড়ে অন্ধকার। অন্ধকারের মধ্যে দুইটি রুম পেরিয়ে ভিতরে যেতেই দেখা গেলো তিন ব্যক্তি বেঞ্চের ওপর কি যেন করছে। জানতে চাইলে তাদের একজন জনি কাছে এসে বলেন, ভাই আমাদের এখানে কোনো ক্লাস হয়নি। সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ। আপনি চলে যান। কোচিং সেন্টারের নাম এবং নেতিবাচক কিছু লিখবো না এমন আশ্বাসে জনি বলেন, আসলে আমাদের এখানে খারাপ কিছু হচ্ছিল না। এখানে সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত একটি অ্যাডমিশন টেস্ট এক্সাম ছিল। গতবার যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি। তারাই দ্বিতীয় শিফটে এ পরীক্ষা দিয়েছে। অভিভাবকদের অনুরোধে এ পরীক্ষা নিতে হয়েছে। ছলিমুল্যাহ মেডিকেল কলেজের রাসেল ছ্যার এ পরীক্ষা নিয়েছে। আগামী ৪ মে এদের আর একটা পরীক্ষা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার কোচিং সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দিলেও রাজধানীর বিভিন্ন জায়গাতে রেটিনা, থ্রি ডক্টর’স, এথিনা, বীকন, কনফিডেন্স, মেডিকো, ইথিকাসহ বিভিন্ন কোচিং সেন্টার মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে কোচিং সেন্টার অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সহ-সভাপতি মাহাবুব আরেফিন বলেন, অনলাইন পদ্ধতিতে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনায় প্রশ্ন ফাঁসে কোনো প্রভাব পড়ে না। এ কারণে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। আগামী ১৪ মে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শেষ হবার পর সব কোচিং সেন্টারে ভর্তির প্রস্তুতি ক্লাস শুরু হবে। আগে থেকে ছাত্র ভর্তি না হলে পরে আর ঠিকমতো ক্লাস শুরু করা সম্ভব হয় না। তাই আমাদের কোচিং ক্লাস বন্ধ রেখে ভর্তি চলছে।
এসএইচ/