ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

শিশুদের বিকাশে বড় শত্রু ফেসবুক

আলী আদনান

প্রকাশিত : ০৪:০১ পিএম, ৩০ এপ্রিল ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ১১:৫৯ এএম, ৫ মে ২০১৮ শনিবার

শিশুরা হাসবে, খেলবে, দৌড়াবে, আনন্দ-হু হুল্লোড়ে মেতে উঠবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সেই শিশুদের দৌড়াদৌড়ি বা দুষ্টুমির পরিমাণ কমে আসছে দিনদিন। তারা হয়ে পড়ছে ঘরকুনো। বদ্ধ রুমেই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় পার করছে অনেক শিশু। আর এর জন্য মনোবিজ্ঞানীরা দায়ী করছেন ফেসবুককে।

সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষ্য অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমের প্রভাবে শিশু কিশোররা হয়ে উঠছে আত্মকেন্দ্রিক। তাই তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন অসামাজিক আচরণ। বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা সাইফুল আলমের সাথে কথা বলে জানা যায়, তার দুই সন্তান। বড় সন্তানটি ক্লাস টেনে পড়ে। বাসায় কোনো মেহমান আসলে সে তাদের সঙ্গে মেশেনা। স্কুলেও তার বন্ধুর সংখ্যা খুব সীমিত। ঘন্টার পর ঘন্টা সে ব্যায় করে অনলাইনে। সারা দেশের মানুষ যখন ক্রিকেট নিয়ে উত্তেজনায় ভোগে তখনো তার মধ্যে সেসব নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। সে তখন ব্যস্ত ফেসবুকে পোষ্ট দিতে বা লাইক কমেন্ট দেখতে।

একই অভিযোগ আবু নাসের সাহেবের। এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি জানালেন, তার একমাত্র সন্তান আরিয়ান বাইরের কোনো লোকের সাথে কথা বলতে চায় না। বাসায় মেহমান এলেও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সব সময় নিজের ভেতরে নিজেকে লুকিয়ে রাখার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। তার একমাত্র সঙ্গী হাতের ট্যাব।

বর্তমানে শিশু কিশোরদের একটি বড় অংশ এভাবে আত্মকেন্দ্রিক ও অসামাজিক হয়ে বড় হচ্ছে বলে দাবি করলেন শিক্ষাবিদ শফি আহমেদ। মানবিক সম্পর্ক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ব্যারস্টার মিতি সানজানা বলেন, ভার্চুয়াল জগতের প্রভাবে শিশুদের স্বাভাবিক চিন্তা ও আচরণ নষ্ট হচ্ছে। তারা বাস করছে এক ধরণের ঘোরের মধ্যে। আর এর জন্য ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো দায় এড়াতে পারেন না।

শুধু বাংলাদেশে নয়, উন্নত বিশ্বের শিশুরাও একই ঝুঁকির শিকার। ২০১১ সালে আমেরিকান মনোবিজ্ঞান সমিতির এক জরিপে জানা যায়, ১২ থেকে ১৭ বছরের যেসব শিশু-কিশোর ফেসবুক ব্যবহার করছে, তাদের নানান মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে, তারা বিভিন্ন রকম ভয়ে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মধ্যে অসামাজিক আচরণ তৈরি হচ্ছে এবং রেগে যাওয়া ও হিংস্র হয়ে ওঠার প্রবণতা বাড়ছে। এসব শিশু কিশোরদের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে বলে এই জরিপের ফলাফলে দাবি করা হয়। এছাড়াও অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার বা অনলাইনে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় দেওয়ার ফলে শিশু কিশোরদের মধ্যে দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়া, বিষণ্ণ থাকা ও স্বাস্থ্যগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে বলেও দাবি করা হয়।

২০১৩ সালে ব্রিটেনে সে দেশের শীর্ষস্থানীয় স্কুলগুলোর ৫০০ শিক্ষককে নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপের শতকরা ৭০ ভাগ শিক্ষক জানিয়েছেন, স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় খারাপ করার জন্য সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট, বিশেষ করে ফেসবুক দায়ী। শিক্ষকদের ওই জরিপের ফলাফলে আরো দেখা যায়, যেসব শিক্ষার্থী ফেসবুকে নিয়মিত আপডেট দেখে, টেক্সট বা ভিডিও ব্যবহার করে ও নিয়মিত চ্যাট করে, সেসব শিশু-কিশোরের ক্লাসে মনোযোগ কমে যায়, মানসিক স্থিরতা শূন্যের কোঠায় চলে যায় এবং একটু দীর্ঘ সময় নিয়ে কাজ করার মতো সামর্থ্য থাকে না তাদের। বিশেষ করে অন্য শিশুদের তুলনায় তারা যে কোন জিনিস শেখার আগ্রহ দ্রুত হারিয়ে ফেলে। এমনকি তারা কথা বলার সময় অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে।

রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বলেন, সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবে ব্যস্ত থাকা শিশুরা তাদের স্কুলের হোমওয়ার্ক ঠিকমতো করে না এবং প্রায় বিষণ্ণ থাকে। শিশুদের স্কুলে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা শুধু কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ।

ব্রিটেনে ১৮ বছরের আগ পর্যন্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। জানা যায়, ব্রিটেনের যেসব শিশু অতিমাত্রায় কম্পিউটার ব্যবহার করে তাদের মধ্যে ইন্টারনেট-কম্পিউটার ব্যবহার করে না এমন শিক্ষার্থীদের তুলনায় বেশি বানান ভুল করে এবং শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। ফলে এমন পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন ৭৩ ভাগ অভিভাবক।

`সোস্যাল মিডিয়ায় শিশুদের জন্য ভালো-মন্দ` শিরোনামে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের প্রফেসর ড. ল্যারি ডি রোজেন ১১৯তম আমেরিকান মনোস্তাত্ত্বিক কনভোকেশনে জানান, আজকের দিনে সামাজিক যোগাযোগে এক নতুন দিগন্ত তৈরি করেছে ফেসবুক। তিনি বলেন, যেসব শিশু-কিশোর এবং তরুণ বেশি সময় ধরে ফেসবুক ব্যবহার করছেন, তাদের মধ্যে ক্ষতিকর আত্মমগ্ন হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বলা যায়, এই আত্মমগ্ন প্রবণতা হিংসা ও বিবাদ সৃষ্টি করছে। একটু পরপর ফেসবুক ব্যবহার করার ফলে, শিশু-কিশোর, তরুণদের পরীক্ষায় ফলাফল বিপর্যয় ঘটছে। ভবিষ্যৎ জীবনে এসব প্রবণতার ফলে দায়িত্বশীল উচ্চপদের কাজের জন্য এসব শিশু-কিশোর অযোগ্য হয়ে বেড়ে উঠছে। এর ফলে নেতৃত্ব ক্ষমতাশূন্য একটা প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় যে, তারা অকাল যৌনতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।

ফেসবুকের সাবেক প্রেসিডেন্ট শন পার্কার বলেন, তরুণদের ৯২ শতাংশ প্রতিদিন অনলাইনে যায়। তাদের ৫ জনের মধ্যে ১ জন রাতে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুক ব্যবহার করে। আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়েট্রিকসের এক গবেষণায় পাওয়া গেছে, ২২ ভাগ অপ্রাপ্তবয়স্ক তরুণ-তরুণী দিনে ১০ বারের বেশি ফেসবুকে প্রবেশ করে। আবার কমপক্ষে ৫০ ভাগ তরুণ-তরুণী দিনে একাধিকবার ফেসবুকে প্রবেশ করছে।

ড. জাফর ইকবালের ভাষায় ফেসবুক বা বিভিন্ন টেকনোলজি মানুষ ব্যবহার করার কথা থাকলেও এখন টেকনোলজি উল্টো মানুষকে নিয়ন্ত্রন করছে। যা কখনো কাম্য নয়।
শিশু কিশোরদের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রন করে তাদেরকে বই ও খেলাধূলামুখী করা হবে সেটাই সবার প্রত্যাশা।

এমজে/