‘মৃত্যুই পারে মাথা থেকে ঝুঁড়ি নামাতে’
রিজাউল করিম
প্রকাশিত : ০৮:৩০ পিএম, ৩০ এপ্রিল ২০১৮ সোমবার
হাশমত মিয়া। বয়স ষাটের কাছাকাছি। গ্রামের বাড়ী কুড়িগ্রাম। ঢাকা এসেছেন আজ থেকে ৪৫ বছর আগে। প্রতিবেশী রহিম চাচার হাত ধরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এসেছিলেন কাজের সন্ধানে।
চাচা কারওয়ান বাজারে মাছের ব্যবসা করতেন। ভাতিজাকে তাই খুব সহজেই মাছ বহনের (কুলি) কাজ নিয়ে দিলেন। সেদিনের সেই মাছ পরিবহনের সুযোগে হাশমত মাথায় তুলে নিয়েছিলেন মাছ বোঝায় ঝুড়ি। যা আজও নামেনি তার মাথা থেকে। জীবনের এ পড়ন্ত বিকেলে তাই সে ভাগ্য বদলানোর আর কোন উপায় দেখছে না। নিয়তির বাস্তবতায় সে ধরেই নিয়েছে মরণ ছাড়া মালবোঝাই এ ঝুঁড়ি আর নামবে না তার মাথা থেকে।
সোমবার সকাল দশটায় কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজার অংশে দেখা হয় হাশমতের সঙ্গে। পরনে লুঙ্গি আর গায়ে সাদা শার্ট পরিহিত এ বয়স্ক লোকটি মাথায় ঝুঁড়ি নিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসলেন প্রতিবেদকের দিকে। প্রতিবেদকের পাশে থাকা লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলেন কিছু নিতে হবে স্যার। বাজার করতে আসা সিমসাম পোশাকে অর্ধবয়সী লোকটি জানালো না। হাসমত আবারো অনুরোধের সুরে নেননা স্যার। লোকটি একটু চড়া সুরে বলে উঠলেন, আরে তোমারে দিয়ে আমার পোশাবে না। তুমি তো নিজেই চলতে পারবা না। আমার বাজার কি করে নিবা। বাজার গন্তব্যে নিতে অনেক সময় নিয়ে ফেলবা। আস্তে আস্তে গেলে আমার সময় লস হবে। শেষে দেখা যাবে মাঝ পথে আমাকে ধরেই ওই ঝুড়ি গন্তব্যে নিতে হবে। একটু শক্ত সামর্থ না হলে হবে না। তুমি যাও। অন্যদিকে দেখ। হাসমতের চোখে হতাশার চিহ্ন। চোখ দুটো বয়ে যেন পানি গড়িয়ে আসার উপক্রম। ঠিক তখনি হাসমত বলে উঠলেন স্যার আমি না নিতে পারলে, এক টাকাও মজুরি নিব না। হাসমতের পিড়াপিড়িতে শেষমেষ বাজার করতে আসা লোকটি রাজি হলেন। তবে তিনি প্রতিবেদকসহ পার্শবর্তী অনেকের অনুরোধেই বয়স্ক লোকটি দিয়ে তার সদায় বহনের অনুমতি দিল বয়স্ক লোকটিকে।
জানতে চাইলে হাসমত বলেন, বাবা নিজের ভাগ্য কে না চাই বদলাতে। আমিও চেয়েছি। কিন্তু পারিনি। যৌবন থাকতে একবার বেশকিছু টাকা জমিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেই আবার হয়ে পড়ি অসুস্থ্য। ওদিকে মা মরা একমাত্র মেয়েটিও বড় হয়ে উঠে। তাই নিজের চিকিৎসা ও কন্যার বিয়েতে সব টাকা খরচ করে ফেলি। এখন মেয়েটার একটা বাচ্চা হয়েছে। মেয়েটা আমার জামায় ও বাচ্চা নিয়ে সুখে আছে। সেটাই আমার সুখ। এতো কষ্টের মধ্যেও যখন মায়ের বাড়ি গিয়ে নাতির কোমল মুখটি দেখি, তখন আমার আর কষ্ট থাকে না। এখন ভাবি আল্লাহ আমার এ কষ্টের মাল বোঝায় ঝুড়ি হয়তো আর মাথা থেকে নামবে না। এ বোঝা নিয়েই আমার মরণ হবে। তবে আমার মরণের সময় যেন আমি সৎপথেই মরতে পারি। আমার ভাগ্য একালে না বদলালেও পরকালে যেন আল্লাহ বদলে দেয়। আমার মেয়ে জামাইয়ের যেন শক্তি সামর্থ্য থাকে। সে যেন ভালোভাবে রিক্সা চালিয়ে আমার মেয়ে ও নাতির মুখে দুমুঠো পেটের ভাত যোগাতে পারে। ওদের যেন আমার মতো বয়স্ক অবস্থায় বেকার থাকতে না হয়।
কারওয়ান বাজারে হাশমতের মতো আরো অনেক বয়স্ক লোকের মাথায় দেখা যায় এমন ঝুঁড়ি। হাশমতের মতো তাদেরও আছে ভাগ্য না বদলানোর এমন করুণ কাহিনী। বাজারের কাঁচামালের আড়তদার আরিফ বিল্লাহ পাটোয়ারি বলেন, ভাই আপনার সামনে যাদের দেখছেন এদের প্রাই সবাই পেটের দায়ে এমন কষ্টের কাজ করে। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা কষ্টের বোঝা মাথায় নিয়ে দুটো টাকা দাবি করে। আর তাই আমাদের মতো অর্থশালী লোকেরা দিতে কুণ্ঠাবোধ করি।
তিনি বলেন, এই দেখেন আগামীকাল মঙ্গলবার পহেলা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। বিশ্বব্যাপী আয়োজন করা হচ্ছে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের। অতিব শ্রমিকভক্ত কোনো মালিক হয়তো শ্রমিকদের মাঝে ফ্রি খাবার বিতরণ করছেন এই দিন উপলক্ষে। হুংকার-শ্লোগান দিয়ে হয়তো কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলছেন, এগিয়ে চলো শ্রমিক ভাইয়েরা আমরা আছি তোমাদের সঙ্গে। কিন্তু বাস্তবে কাজই হচ্ছে না কোনো। যিনি শ্রমিক খেটেই মরছেন তিনি। আর যিনি মালিক অত্যাচার আর অবহেলার পাহাড় গড়েই চলছেন তিনি। যে গার্মেন্টস শ্রমিক কোটি কোটি মানুষের বস্ত্র তৈরি করে উন্নত বিশ্বে প্রেরণ করছে, তার স্ত্রী ও সন্তানের দেহে বস্ত্র নেই। যে শ্রমিক বহুজাতিক কোম্পানীতে কোটি কোটি মানুষের জন্য ওষুধ তৈরি করছে সেই মৃত্যুর সময় মুখে দেয়ার মতো ওষুধ পায় না, খাদ্যের অভাবে বিরাট বিরাট অট্টালিকায় শ্রমিকের হাড় ও মাংস একাকার হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সভ্যতার চরম উন্নতির এ যুগে সর্বত্রই মেহনতী মানুষ লাঞ্চিত, বঞ্চিত, শোষিত এবং অবহেলিত। প্রকৃত অর্থে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার নীতিমালার পাশাপাশি তা বাস্তবায়ন ও সে অনুযায়ী ধনীদের মধ্যে মানবপ্রেম জাগ্রত করতে হবে।
/আরকে//