ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

লেগুনায় শিশু হেলপার, বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি 

রিজাউল করিম

প্রকাশিত : ০৮:৪৪ পিএম, ৩০ এপ্রিল ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৮:৪৮ পিএম, ৬ মে ২০১৮ রবিবার

আরশাদ। বয়স ১১ বছর। গ্রামের বাড়ী ফরিদপুর। জন্ম ঢাকার পূর্ব রাজাবাজার। সেখানেই বেড়ে ওঠা। গত চার বছর ধরে লেগুনার হেলপার। সুযোগ পেলে লেগুনার ড্রাভিংয়ের দায়িত্বও পালন করে। আশা আগামী বছর থেকে সে হেলপারি ছেড়ে ড্রাইভারি করবে। তাতে মোটা অঙ্কের টাকা রোজগার হবে। আর পরিবারে অসুস্থ্য মা-বাবা আর ছোট ভাই-বোনের পেটের খোরাক যোগাবে।

রাজধানীর ফার্মগেট টু মো:পুর গামী লেগুনার হেলপার হিসেবে কাজ করে আরশাদ। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এ কাজেই ব্যস্ত থাকে সে।মাঝে মধ্যে চালকের আসনে বসলেও মজুরি পায় সহকারি হিসেবে।এখন সে প্রতিদিন ২৫০টাকা থেকে ৩০০টাকা পর্যন্ত মজুরি পায়। চালক হলে মজুরি পেত ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। তখন তার পক্ষে একটি পরিবারের ভরণ-পোষণ চালানো সহজ হবে।তার পঙ্গু পিতা ও হাফের রুগি মায়ের মুখে হাঁসি ফুটবে।তাই সে রাতদিন কষ্ট করে যাচ্ছে। তবে কয়েকবার সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে সে। যার কারণে দুইবার করে ছেড়েও দিয়েছে হেলপারের কাজ। কিন্তু অর্থের কষ্ট তাকে ওই কাজে আবার ফিরে আসতে বাধ্য করেছে। এখন সে ঝুঁকি নিয়ে হলেও এ কাজ করছে।   

আরশাদের মতো লেগুনায় সহকারি হিসেবে কাজ করে আরিফ। গ্রামের বাড়ী কুমিল্লার লাকসামপুর। মা-বাবা ও ছোট বোনসহ থাকে রাজধনীর মোহাম্মদপুরে। বাবা রিক্সা চালায়। মা ব্রেস্ট ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরণের রোগে আক্রান্ত। ছোট বোন ক্লাস ওয়ানে পড়ে।বাবা ও তার আয়ের উপরে ভর করে চলে তাদের সংসার। রাজধানীর ফার্মগেটে কথা হয় আরিফের সঙ্গে। আরিফ বলে, আমার বাবা ৫ বছর আগে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ২ মাস বিছানায় পড়ে ছিলেন। তখন আমার বয়স ছিল ৬ বছর। আমাদের সংসার মোটেও চলছিল না। মা অসুস্থতার  কারণে ভিক্ষা করবে তাও পারছিল না। বাবা উপায় না পেয়ে আমাকে একটি লেগুনার হেলপারের কাজ খুঁজে দেয়। প্রথমে আমি গুলিস্থান টু নিউমার্কেট এলাকায় লেগুনার সহকারি হিসেবে কাজ করি। এখন আমার বয়স ১২ বছরে পড়েছে। হেলপারি করতে করতে এখন আমি ভালোই গাড়ি চালানো শিখে ফেলেছি। তবে এখনও মাঝে মধ্যে লেগুনা চালাতে ভয় হয়। দূর্ঘটনা হতে পারে জেনেও আমি এ কাজ করছি। কারণ অন্য কাজ আর এভাবে পারবো না। বয়স কম হলেও এ কাজ রপ্ত করে ফেলেছি।অপেক্ষায় আছি কবে পুরো চালক হতে পারবো? সেদিন আমার বাবাকে আর রিক্সা চালাতে দিব না।  

এদিকে ফার্মগেট লেগুনা স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, ঝিগাতলা, নিউ মার্কেট, ৬০ ফিট, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, মিরপুর ১ নম্বর ও ১০ নম্বর রুটের অধিকাংশ গাড়ির চেহারা লক্কড়-ঝক্কর। ফিটনেসবিহীন এসব গাড়ি ভোর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ছুটে চলে রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তা জুড়ে। তবে রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কের যাত্রী বোঝায় করা এসব লেগুনার স্টিয়ারিংয়ের নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের দিয়ে। যাদের প্রত্যেকের বয়স ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। আরশাদ এবং আরিফের মতো এসব শিশু চালকদের কারোরই নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স। তার পরও কেউ করছে হেল্পারি আবার কেউবা বসছে লেগুনাগুলোর ড্রাইভিং সিটে।

আরশাদ জানায়, ছোট থেকে এই লাইনে কাজ করায় অলিগলি ভালোই চেনা তার। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় মাঝেমধ্যে পুলিশ ঝামেলা করলেও তেমন কিছুই হয় না। ওস্তাদ বা বড় ভাই ফোন দিলে মুহূর্তেই ছেড়ে দেয় তারা। আর পুলিশে যেন প্রতিদিন সমস্যা না করে তার জন্য গুনতে হয় নির্দিষ্ট হারে লাইন খরচ। আরিফও খুব ছোট থেকেই লেগুনার হেলপারির কাজ করছে। হেলপারি করতে করতে ভালোই গাড়ি চালানো রপ্ত করে ফেলেছে সে। এজন্যই সন্ধ্যার পর ড্রাইভারের বদলে যাত্রীদের নিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণ করে সে।

রবিউল হোসেন নামের এক চালক বলেন, প্রতিদিন ফার্মগেট থেকে নিউ মার্কেট, ঝিগাতলা, ৬০ ফিট, মিরপুর-১০, মোহাম্মদপুর, আগারগাঁওসহ মোট পাঁচটি রুটে লেগুনা চলাচল করে। বয়স না হওয়ায় এর বেশির ভাগ চালকেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স বা বৈধ কাগজপত্র নেই। স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে অবৈধভাবে চলাচল করছে এসব লেগুনা। রবিউল জানায়, সবাই পেটের দায়ে এখানে কাজ করতে আসে। কাজ না করলে কে তাকে খেতে দেবে। চালকদের সঙ্গে থেকে আস্তে আস্তে ওরাও গাড়ি চালানো শিখে যায়।আর লাইন-ঘাট করে নিজেরাই মালিকের কাছ থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে চালানো শুরু করে। রবিউলও প্রথম চারবছর হেলপারী করেছে। এখন সে ড্রাইভারি করছে।তার বয়স সম্পর্কে জানতে চাইলে সে একটু ইতস্ত হয়ে বলে, এই দেখেন আমার ভোটার আইডি কার্ড।বিশ্বাস না হয় দেখেন আমার বয়স এখন ২২ বছর চলছে। গত দুই বছর ধরে আমি ড্রাইভারি করছি।  

এদিকে রাজধানীতে পরিবহনের এ দূরবস্থার মধ্যে সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন অকালে প্রাণ ঝরছে না কিংবা প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বাতাস ভারী হয়ে উঠছে না। সর্বশেষ গোপালগঞ্জে বেপরোয়া গাড়িতে শরীর থেকে হাত বিচ্ছিন্ন হয়েছে হৃদয় শেখ (২৬) নামের এক মোটর শ্রমিকের। গত মঙ্গলবার (১৭ এপ্রিল) দুপুরে সদর উপজেলার বেদগ্রামে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে।

এরও আগে গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দুই বা‌সের প্রতি‌যো‌গিতায় ডান হাত হারায় সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন। পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বাঁশবাড়ি গ্রামের রাজীব হোসেন ঢাকা মে‌ডি‌কেল ক‌লেজ হাসপাতা‌লে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ এপ্রিল সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে মারা যান।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান মতে, রাজধানীর ১৫টি রুটের লেগুনাচালকের ৩৫ শতাংশই শিশু। যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৮–এর মধ্যে। যাত্রাবাড়ী থেকে ডেমরা, পোস্তগোলা, জুরাইন, গুলিস্তান, মাতুয়াইল রোডে নিয়মিত লেগুনা চালাচ্ছে এসব শিশু। এ ছাড়া গুলিস্তান থেকে কেরানীগঞ্জ, আজিমপুর, খিলগাঁও,মিরপুর রোডেও নিয়মিত লেগুনা চালাচ্ছে তারা।

ঢাকা জেলা লেগুনা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী থেকে ডেমরা রুটে ২২০টি লেগুনা চলে। যাত্রাবাড়ী থেকে পোস্তগোলা রুটে চলে ১১৫টি। জুরাইন থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত চলে ১০৭টি লেগুনা এবং যাত্রাবাড়ী থেকে চিটাগাং রোড পর্যন্ত চলে আরও ২০টি। এসবের অধিকাংশের চালকই শিশু।

সোহাগ নামের এক লেগুনাযাত্রী বলেন, তিনি থাকেন মিরপুর রুপনগরে। প্রতিদিন লেগুনাতে চলাচল করেন। অধিকাংশ লেগুনা চালাচ্ছে শিশুরাই। যাদের বয়স ১৫ থেকে ১৬ বছর। এসব শিশুর গাড়ি এত দ্রুত চালায় যে, গাড়িতে উঠলেই ভয় লাগে। কিন্তু নিরুপায় হয়ে উঠতেই হয়। অনেক সময় দেখা যায় এসব লেগুনার হেলপার বয়সে এতোই ছোট যে কথাও ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারে না।

ট্রাফিক আইন অনুযায়ী, ২০ বছরের নিচে কোনো ব্যক্তি পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারেন না। আঠারো বছরের কম বয়সী কেউ কন্ডাক্টরের কাজও করতে পারবে না। অথচ আঠারো বছরের কম বয়সী এসব শিশু বছরের পর বছর খোদ রাজধানীতে লেগুনা চালাচ্ছে। শিশু আইন অনুযায়ী, আঠারো বছরের কম বয়সী সবাই শিশু হিসেবে বিবেচিত।

বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টার-এআরআই এর তথ্য অনুযায়ি এসব অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনার হার ক্রমশঃ বাড়ছে। তবে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ জানিয়েছে, আইনের লঙ্ঘন ঠেকাতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন তারা। যদিও এর ফলে চিত্র খুব একটা বদলাচ্ছে না বলেই অভিযোগ লেগুনার যাত্রীদের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফার্মগেটের মতো একই চিত্র দেখা যায় রাজধানীর গুলিস্তান, নিউ মার্কেট, মিরপুর-০১ নম্বর, ১০ নম্বরসহ বিভিন্ন রুটে। গুলিস্তান থেকে হাজারীবাগ, চকবাজার, নিউ মার্কেট, চান্দিরঘাট, ইসলামবাগসহ প্রতিদিন মোট ৭টি রুটে প্রায় ৪০০ লেগুনা চলাচল করে। লেগুনাগুলোতেও দেখা মেলে শিশু চালকদের। পিছনে দুইপাশে ছয় জন করে মোট ১২জন এবং সামনে ড্রাইভারের পাশে দুই জন করে মোট ১৪ জন যাত্রী বসার ব্যবস্থা রয়েছে এই লেগুনা গুলোর মধ্যে। তবে হেল্পারের সঙ্গে ২ থেকে ৩ জন ঝুলেও নিয়মিত যাতায়াত করে।

ফার্মগেট টু মোহাম্মদপুর রুটে চলাচলকারি লেগুনার একজন মালিক আবুল মিয়া। তিনি বলেন, ড্রাইভারেরা বয়সে ছোট হলেও তারা ভালোই গাড়ি চালায়। বছরের পর বছর এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকায় এরা খুব ভালোভাবে গাড়ি চালানো রপ্ত করে ফেলে। পুলিশে মাঝে মধ্যে ঝামেলা করলেও তা আপসে মীমাংসা করে নেয়া হয়।

আরকে//এসি