পর্ব-৩
প্রিয় লন্ডনে অপ্রিয় অভিজ্ঞতা
শফিকুল ইসলাম জীবন
প্রকাশিত : ০৬:৪২ পিএম, ১ মে ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৬:৪৩ পিএম, ১ মে ২০১৮ মঙ্গলবার
প্রবাস জীবনে লন্ডনে থাকার সময় আমি বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। তেমন একটি অভ্যাস হলো নাক ঘুমের মধ্যে ডাকার অভ্যাস। ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এই নেতিবাচক অভ্যাস বেশ। আমার মতে কমপক্ষে ষাট ভাগ বাঙালির এই অভ্যাসটি আছে। বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা চালিয়ে অর্থ খরচ করেও তারা খুব বেশি প্রতিকার পাননি। আবার কারও কারও নাকের ডাক এতো বেশি যে মনে হয় বুনো হাতিকেও হার মানায়।
নাক ডাকার নিপীড়ন থেকে বাঁচতে আমি বার বার বাসা বদল করেছি। তাতে খুব বেশি লাভ হয়নি। সম্ভবত আমিই প্রথম ব্যক্তি একটি কমিউনিটি পত্রিকায় পাঁচ পাউন্ড খরচ করে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। তাতে বলেছি, নাকডাকা সমস্যা নেই এমন একজন রুমমেট চাই। কারণ একার পক্ষে কখনো একটি রুম ভাড়া নিয়ে লন্ডনে বাস করার মতো পরিস্থিতি আমার ছিল না। তারপরও মাস খানেক শুধু একা একটু শান্তিতে থাকার জন্য একটি রুম ভাড়া নিয়েছিলাম। কিন্তু বিধি বাম। পাশের কক্ষে বাস করা পরিবারেরও সেই নাক ডাকার অভ্যাস আমাকে বেশি দিন সেখানে টিকতে দেয়নি। আমার মতো যাদের ঘুম হালকা এবং সৌখিন প্রকৃতির তাদের পক্ষে রাতভর ওই সুরেলা আওয়াজ শ্রবণ করা কঠিন! লন্ডনে কাঠ এবং হালকা ইট শুরকীর বাড়িগুলো এমন যে, পাশের রুমে তেলাপোকা হাটলেও তার আওয়াজ পাওয়া যায়। সেখানে নাক ডাকা তো দূরের কথা।
এখানে একটু বলে রাখি। নাক ডাকা যে কেবল বাঙালিদের মধ্যে আছে তা কিন্তু নয়। প্রায় সব গৌষ্ঠীর কমিউনিটিতে এই সমস্যা রয়েছে। আমি কখনো কখনো পাকিস্তানি, ভারতীয়, আফ্রিকান, ইউরোপীয়দের মধ্যেও একই সমস্যা দেখেছি। একবার এক বাসার কর্তৃত্ব আমার হাতে থাকায়, নাক ডাকার কারণে অতিষ্ট হয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে এক পাকিস্তানিকে বের করে দিয়েছিলাম।
ছোট জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে আরেকটি পালক যুক্ত করেছে। তা হলো নতুন প্রজন্ম শিক্ষিত এবং মূলধারার অর্থনীতি ও রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া। যদিও কমিউনিটির মোট জনগোষ্ঠির তুলনায় সেই হার অতি নগন্য। কিন্তু এই অর্জনের পেছনে যেমন ত্যাগ আছে তেমনি আছে শ্রম। সে দিকটাকে অবশ্যই আমাদের প্রশংসা করতে হবে। তবে তাদের পূর্বসূরীদের জীবন যাপন এবং ব্রিটিশ পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সূচনাটা তেমন সুখকর ছিল না। এক দিকে ছিল আবহাওয়া জনিত বৈরী পরিবেশ। ছিল বর্ণবাদীদের আকষ্মিক হামলা, ঘৃণা এবং তাচ্ছিল্যতা। ইংরেজি ভাষা দক্ষতা না থাকা এবং সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধের দূরত্বের কারণে ব্রিটিশ পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। সেটি হয়তো লন্ডনে গড়ে ওঠা হাল আমলের ধ্যান-ধারনার প্রজন্মটি ভুলেই যাচ্ছে।
লন্ডনে চব্বিশ ঘণ্টা বাস সার্ভিসগুলোর একটি হচ্ছে ১০ নম্বর বাস, যেটি এখন হ্যামারস্মিথ এবং কিং-ক্রস রুটে চলাচল করে। ইংরেজি না জানা এবং বোঝার কারণে এক সময় বাঙালিদের বাসে চড়া নিয়ে নানা বিড়ম্বনা পোহাতে হতো-যেমনটি এখনও ঘটে মস্কোর মতো রুশ ভাষাভাষি শহরে হঠাৎ আসা কোন বাঙালির ক্ষেত্রেও।
আজ থেকে কয়েক দশক আগে লন্ডনে সঠিক সময়ে সঠিক বাসটি যাতে হাতছাড়া না হয়, সে জন্য দেখা যেতো অনেক বাঙালি কিছু সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করছেন। যেমন ইংরেজি ১০ কে বোঝার জন্য তারা নিজেদের ভাষায় ঠিক করে নিলেন ‘এক লগি এক আন্ডা’ হিসেবে। মানে একটি লাঠিকে সোজা করে ধরে তার পাশে একটি ডিম বসালে সেটি ইংরেজি 10 এর মতো দেখায়। আর এটি দেখে সহজেই তারা সেই বাসে ওঠানামা করতে পারতেন।
লন্ডন কেন্দ্রীক বাঙালি রেস্টুরেন্টগুলোর একটি ঐতিহ্যবাহী এবং জনপ্রিয় জায়গা হচ্ছে ব্রিকলেন। এই ব্রিকলেনকে ঘিরেও রয়েছে নানা মজার তথ্য। বিলবোর্ড বা নেমপ্লেট ব্যবহারের সুযোগ সীমিত ছিল। বাহির থেকে কাঠামোগত সাজ-সজ্জা, রঙ একই রকম হওয়ার কারণে রাতে তালা লাগিয়ে সকালে ফিরে অনেকের পক্ষেই নিজের প্রতিষ্ঠান সনাক্ত করা কঠিন হতো। এমনকি সবার তালাগুলো পর্যন্ত ছিল একই রঙ এবং আকারের। এ কারণেও তারা রাতে যাওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানের দরজায় বা সামনে নানা সাংকেতিক চিহ্ন রেখে যেতেন। পান খাওয়ার চুন, ইট, কয়লা দিয়ে দাগ কেটে নাম লিখে যাওয়া ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার দুষ্টুমি করে সেগুলো মুছে অন্যদের নাম লিখে রাখতেন। এ নিয়ে বিড়ম্বনা, ঝগড়া-ঝাটি, হাতাহাতি লেগে যেতো।
লন্ডনে সেই সব পূর্বসূরীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলি, এই ব্রিকলেনে বাঙালি কমিউনিটি গঠনের পেছনে তাদের ত্যাগ আছে। সেখানে বর্ণবাদী হামলায় রক্তের পর রক্ত ঝরেছে। সবকিছু ছাপিয়ে ছিল অক্লান্ত পরিশ্রম আর স্বপ্ন জয়ের আকাঙ্ক্ষা। দুর্ভাগ্য সেখানকার আজকের প্রজন্ম সেটা ভুলে যাচ্ছে। এদের কারণে লন্ডন শহরের সবচেয়ে ভীতিকর এবং অপ্রীতিকর জায়গাটি হচ্ছে ব্রিকলেন এবং হোয়াইটচ্যাপল স্টেশনের আশপাশ।
মাদক, নারী ব্যবসা, মেসেজ পার্লার, জুয়া-এ সবই হয়ে উঠছে নতুন প্রজন্মের বাঙালি কমিউনিটির প্রধান আকর্ষণ এবং কর্মকাণ্ড। যে কারণে ব্রিটেন বা ইউরোপের যে প্রান্তেই আপনি যান, হোয়াইটচ্যাপেলের কথা বললে আপনার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মুহুর্তের মধ্যে বদলে যাবে। তারা এই সব নাম শুনলে সবাই আঁতকে ওঠে। বলবে, ওহ নো, হোয়াইটচ্যাপল ইজ সো ডার্টি প্লেস।
সেখানে আরও আছে সোস্যাল বেনিফিট আর শ্যেম ম্যারেজ বাণিজ্য নিয়ে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার প্রচেষ্টা। শুধু এদের লক্ষ্য করেই যুক্তরাজ্য সরকার এখন ইস্ট লন্ডনের মোড়ে মোড়ে পোস্টার লাগিয়ে বলে, ‘উই আর লুকিং ফর দ্যা বেনিফিট থিবস’। এ সব দেখেও এই বাঙালিদের লজ্জা হয় না।
আমি নিজ কানে কখনো কখনো বেথনাল গ্রীন, স্টেপ্নি গ্রীন, মাইল এন্ড কিংবা স্ট্রাটফোর্ড স্টেশনের মতো জায়গাগুলোতে আজকের টিনএজারদের অনেকের মুখেই নির্লজ্জ্বভাবে অফার করতে শুনেছি, ‘বিজনেস করতানি’?
ত্রিশ চল্লিশ পাউন্ডের মিনিট বিশেক বিজনেস। অতি ভয়ঙ্কর, কুৎসিত এবং অন্ধকার জগতের সেই বিজনেস-যা করছে আজকের কমিউনিটির উঠতি বাঙালি তরুণীদের বড় একটি অংশ।
লেখক: সিইও এন্ড লিড কনসালট্যান্ট, গ্লোবাল গ্লোবাল স্টাডি কনসালটেন্সি
(লন্ডন অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখকের নিজস্ব মতামত)