সেবার মাস রমজান
প্রকাশিত : ১০:৫৯ পিএম, ৪ মে ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ১০:০০ এএম, ১০ জুন ২০১৮ রবিবার
আমাদের দেশে আরবি সওম শব্দটির বদলে রোযা কথাটির প্রচলন ব্যাপক হয়েছে। রোযা ফারসি শব্দ। এমনি ভাবে আরবি সালাত শব্দটির বদলে নামাজ শব্দটির প্রচলন অধিক। রোযা ফরজ হয়েছিলো দ্বিতীয় হিজরিতে। রামাদান নামকরণ করার আগে এ মাসের নাম ছিল নাতিক। নাতিক মানে হচ্ছে ধূলিসাৎ করে দেয়া। অন্য দিকে রমজ মানে হচ্ছে পুড়িয়ে দেয়া, জালিয়ে দেয়া। মরুভূমিতে পাথরের উপর রৌদ্রতাপ পড়লে তা যখন গনগনে চুল্লীর মত উত্তপ্ত হয় তখন তাকেও রমজ বলে। আরবরা হুজুর পাকের (সাঃ) জামানার আগে বলির পশুকে উত্তপ্ত পাথরের উপর রেখে দিত। এতে পশুটি মারা যেত –এটাই ছিল তাদের বলিদান।
তবে এ মাসটির তাৎপর্য গভীর। সে কথা উপলব্ধির চেষ্টা করতে হবে। এ মাসে শুধু কোরআন নয়, আরও তিনটি ধর্মগ্রন্থ নাজিল হয়েছিল। জবুর নাজিল হয়েছিল রমযানের ৩ তারিখে, তাওরাত নাজিল হয়েছিল রমযানের ৭ তারিখে এবং ইঞ্জিল বা বাইবেল নাজিল হয়েছিলো রমযানের ১৭ তারিখ। আর শবে কদরে নাজিল হয়েছিলো কোরআন।
সূরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতের দিকে তাকালে দেখা যায় রোযা কোনো নতুন বিধান নয়। আল্লাহতায়ালা এ আয়াতে এরশাদ করেছেন যে- ইয়া আইয়ো হাল্লাজিনা আমানু কুতিবা আলাইকুমুস সিয়ামো কামা কুতিবা আলাল্লাজিনা মিন কাবলিকুম লা’য়াল্লাকুম তাত্তাকুন- অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো। যেমন দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্বসূরীদের যাতে তোমরা সাবধানতা অবলম্বন করতে পার। এখানে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। মানুষের জীবনের এই যে অন্তহীন প্রবাহ – সুখ-দুঃখ, ভোগবিলাস নিয়ে যে জীবন, মানুষকে জীবনপ্রবাহের উৎস মুখ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। মওলানা রুমি বলেছেন-যে জিনিসটি তোমাকে আল্লাহর ভালোবাসা থেকে দূরে সরিয়ে নেয় তারই নাম দুনিয়া। কিন্তু এ মাসের সওম অর্থাৎ এ মাসের সাধনা ফিরিয়ে আনবে ঐ পথে যে পথে তোমার গন্তব্য রয়েছে।
এখানে উপবাসের কথা না, সাধনার কথা বলা হয়েছে। সাওম মানেও সাধনা, উপবাস নয়। এ মাসের এ সাধনার ফজিলত বর্ণনার অতীত। শুধু একটি কথাই বলি এ মাসে যে পথের উপর থেকে অন্যে কষ্ট পাবে মনে করে একটি পাথর সরিয়ে দেয় সে একটি পুরো হজ্জের সওয়াব পাবে। প্রেম, ধৈর্য্য ও সেবা। উপবাস কার জন্য? কিসের জন্য? কার জন্যে? শুধু তাই নয় নিজেকে পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শের মোহনীয় আকর্ষণ থেকে দূরে রাখা কিসের জন্য? একমাত্র স্রষ্টার প্রেমে, তাঁর রাসূলের প্রেমে উৎসর্গ করছো নিজেকে- সে কারণে নিজের নফসকে তার স্বাভাবিক প্রবণতার দিকে যেতে দিচ্ছ না। নফসকে ধর্মের শক্ত বাঁধনে বেঁধেছ যাতে জীবন কামনা- বাসনার বল্গাহীন স্রোতে ভেসে না যায়। কিন্তু একথা বলা হয়নি যে সে ধর্মের নামে তুমি কামনাকে অস্বীকার কর। বলা হয়েছে, সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সম্ভোগ বৈধ করা হয়েছে – তারা তোমাদের পরিচ্ছেদ, তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। কি অসাধারণ কথা! স্বামী স্ত্রীর এ সম্পর্ক পারস্পরিক।পোশাক তোমাদের কি দেয়? পোশাক তোমাকে উত্তাপ দেয়, তোমাকে রক্ষা করে সূর্যের উত্তাপ থেকে, তোমার সামাজিক ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে। তোমাকে সম্মান এনে দেয়, দেয় সম্ভ্রোমবোধ।
তোমরা একে অপরকে একটা অন্তরঙ্গ সম্মানবোধে গ্রহণ করো। ভোগের সামগ্রী হিসেবে নয়, লালসা চরিতার্থ করার পণ্য হিসাবে নয়।
আর শেষ কথা হচ্ছে রমজানে সেবায় উদ্দীপ্ত হও। সেবার মাঝে পরমাত্মাকে পাবার চেষ্টা করো।হযরত যায়েদ (রাঃ) একবার হুযুর পাক (সাঃ) কে জিঞ্জেস করেছিলেন- হুযূর, আল্লাহকে জীবনের কোন কোন স্থানে পাওয়া যাবে?
হুযূর বললেন, দূস্থ মানুষের সেবা করো, সেখানেই আল্লাহকে পাবে। হুযূর পাক (সাঃ) আরো বলেন,যেখানে মাসুম, নিষ্পাপ শিশু খেলা করছে, সেখানে আল্লাহকে পাবে। আর পাবে তাঁর মাঝে যিনি দুঃখ-কষ্টে আল্লাহর উপর বিশ্বাসী, ধৈর্য্যশীল। রমযান উপবাসের উৎস নয়- রমজান হলো মানবতার আলোকে আলোকিত হবার সাধনা। আর এ সাধনা যখন পূর্ণ হবে, তখন কোরআনের সে কথা তোমার জীবনে সত্য হয়ে উঠবে - ওয়া ইজা সাআলাকা এবাদি, আন্নি ফাইন্নি ক্বারিব ( সূরা বাকারা ১৮৬)।
অর্থাৎ আমার বান্দারা যখন আমার সম্পর্কে প্রশ্ন করে, আমি তো নিশ্চয়ই নিকটে। আল্লাহ আরো বলেছেন- উজিবু দাওয়াত্তাদ্দায়ি ইজা দায়ানী ফাল ইয়াসতাজিবুলি। অর্থাৎ আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে,তখন আমি তার আহ্বানে সাড়া দিই। তোমাদের সওমের সাধনা তোমাদের ঐ মোকামে পৌঁছে দিক, আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা।
(হয়রত সৈয়দ রশিদ আহমদ জৈনপুরী (রহঃ) এর সংলাপ সমগ্র থেকে নেওয়া হয়েছে)
কেআই/টিকে