ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

বিয়ের উপহারে বোমার রহস্য উদঘাটিত হলো যেভাবে

প্রকাশিত : ০৯:২৭ এএম, ৬ মে ২০১৮ রবিবার

ভারতের ওড়িষ্যায় গত ফেব্রুয়ারিতে বিয়ের উপহার হিসাবে বোমা হামলায় যে নব বিবাহিত বরসহ দুইজন নিহত এবং কনে আহত হয়, তাতে সন্দেহভাজন হিসেবে একজন কলেজ শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তদন্তকারীরা অনেকটা সূত্রবিহীন ঘোরাফেরা করলেও, একটি উড়ো চিঠির বরাত দিয়ে সেই তদন্তের রহস্য বের হলো।

গত ফেব্রুয়ারিতে একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী সৌম্য শেখর সাহুর সঙ্গে বিয়ে হয় রেমার। কিন্তু বিয়ের পাঁচদিন পরেই বিয়ের একটি উপহার খোলার সময় সেটি বিস্ফোরিত হলে বর সাহু এবং তাদের একজন আত্মীয় নিহত হন। গুরুতর আহত হন কনে।

পরের কয়েকমাস ধরে চারটি শহর জুড়ে দুই পরিবারের শতাধিক আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

তারা হাজার হাজার মোবাইল ফোনের রেকর্ড সংগ্রহ করেছে, দম্পতির ল্যাপটপ আর মোবাইল পরীক্ষা করেছেন।

সেখানে তদন্তকারীরা দেখতে পান, গত বছর এই দম্পতির এনগেজমেন্ট হওয়ার পর বর সাহু একটি টেলিফোন থেকে হুমকি পেয়েছিলেন।

পরে দেখা যায়, সেটি ছিল কনের প্রেমিক দাবিদার একটি ছেলের, যে মেয়েটির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনে তাকে বিয়ে না করার জন্য ছেলেটিকে হুমকি দিয়েছিল।

পুলিশ তাকে তুলে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর অবশ্য ছেড়ে দেয়। কারণ শুধু হুমকি দেওয়া ছাড়া তার বিষয়ে আর কিছু মেলেনি।

গোয়েন্দারা কয়েক ডজন সন্দেহভাজন ব্যক্তির একটি তালিকাও তৈরি করে, কিন্তু সেখান থেকেও অকাট্য কিছু পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে মামলাটি ঝিমিয়েই পড়ছিল।

কিন্তু তা পাল্টে যায় একটি উড়ো চিঠিতে। এপ্রিলের প্রথম দিকে ওড়িশার বালানগির জেলার পুলিশ প্রধানের কাছে একটি চিঠি আসে। যেখানে লেখা ছিল, গুরুত্বপূর্ণ চিঠি।

তার মধ্যে একটি সাদা কাগজে ১৩০ শব্দের একটি চিঠি। তবে প্রেরকের কোনও নাম-ঠিকানা নেই।

পুলিশ প্রধানকে সম্বোধন করে সেখানে লেখা রয়েছে, জনাব স্যার, পার্সেলটি এস কে সিনহা নামে পাঠানো হয়েছিল, আর কে শর্মা নামে নয়।

তিনি ওই নামেই তার আধার কার্ড নিয়েছিলেন। রায়পুরের তিনজন ব্যক্তি এই প্রজেক্টটি নিয়েছিল, কিন্তু তারা অনেক দূরে চলে গেছে, যেখানে পুলিশ তাদের ধরতে পারবে না।

‘তার (বরের) প্রতারণাই ওই বোমা হামলার কারণ, যাতে জীবন গেছে এবং কোটি কোটি রুপি নষ্ট হয়েছে। আমরা জানতাম আইনের কাছে যাওয়ার কোনও অর্থ নেই। তাই এ ধরণের পদক্ষেপ নিতে হল। সামান্য কোনও ক্ষতির জন্য কেউ এ ধরণের কাজ করে না। পুরো পরিবারটিকেও হত্যা করা হলে, তা আমাদের ক্ষতির সমান হতো না।’

পুলিশকে অনুরোধ করে লেখা হয়, আপনাদের চুপচাপ থাকার আর নির্দোষ লোকজনকে হয়রানি না করার জন্য অনুরোধ করছি।

এই চিঠি হাতে পান রাজ্যের রাজধানী ভুবনেশ্বরের ক্রাইম ব্রাঞ্চের প্রধান সাবেক সাংবাদিক অরুণ বোথারা।

‘আমি সারাদিন, সারারাত ধরে চিঠিটা পড়লাম। আমি হয়তো কয়েকশো বার চিঠিটা পড়েছি, এটা আমাকে অনেক কিছু বলছিল’ বলছেন বোথারা।

তিনি বলছেন, ‘এটা পরিষ্কার, এর প্রেরক ওই ঘটনা সম্পর্কে আমাদের চেয়ে বেশি জানে। কিন্তু একজন বার্তাবাহকের মাধ্যমে চিঠিটা পাঠিয়ে তিনি আমাদের বলতে চেয়েছেন, এটা স্থানীয় কারও মাধ্যমে হয়নি। তিনি বলেছেন, পরিকল্পনা তিনজন ব্যক্তি মিলে বাস্তবায়ন করেছে। তিনি আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন যে, আমরা একটা ভুল করছি।’

এরপর পুরো মামলাটির রেকর্ড চেয়ে পাঠান বোথারা। তিনি দেখতে পান, পার্সেলের রিসিটে হাতের লেখার কারণে প্রেরক সম্পর্কে পুলিশ, গণমাধ্যম, বেচে যাওয়া সবাই প্রেরকের নাম এসকে শর্মা বলেছে।

‘যেহেতু আমরা জানতাম যে এটা একটা ছদ্ম পরিচয় হবে, তাই এদিকে বেশি গুরুত্ব দেইনি।’

‘আমার মনে হচ্ছিল, হত্যাকারী নিজেই এই চিঠিটা পাঠিয়েছে। তিনি কিভাবে জানলেন যে, পার্সেলটা এসকে সিনহা পাঠিয়েছে?’

আর এটাই এই তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই চিঠিটি দুই পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠায় পুলিশ। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এর মাধ্যমে তারা কাউকে সন্দেহ করেন কি-না। নিহত বর সাহুর মা, স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষক ওই চিঠিটা অনেকবার পড়েন। তখন তিনি জানান, এটা তার একজন সহকর্মীর লেখা হতে পারে, যিনি তারই কলেজে ইংরেজি পড়ান।

তার লেখার ভাষা অনেকটা একই ধরণের। সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তিনি প্রায়ই ‘প্রকল্প শেষ করার’ মতো শব্দ ব্যবহার করেন।

ভিকটিমের মা পুলিশকে জানিয়েছিল, গতবছর মেহেরকে সরিয়ে তাকে অধ্যক্ষ করার পর তিনি প্রায়ই বিরক্ত করতেন। দুজনের মধ্যে প্রকাশ্যে কয়েকবার ঝগড়াও হয়েছে। এর কয়েকদিন পর ৪৯ বছর বয়সী ইংরেজির অধ্যাপক পুঞ্জি লাল মেহেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায় পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের সময় মেহের পুলিশকে জানান, কিছুদিন আগে তিনি যখন বিকেলে হাটছিলেন, তখন একজন ব্যক্তি এসে তাকে থামিয়ে একটি চিঠি দিয়ে বলে, বালানগির শহরে গিয়ে পুলিশকে চিঠিটি না দিলে তার ক্ষতি করা হবে।

বোথারা বলছেন, এটাই হচ্ছে এই মামলার সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য, যা প্রথম কোনও সন্দেহভাজনের মুখে শুনতে পেলাম। এরপর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে পুরো বিষয়টি বেরিয়ে আসে।

তাকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, গত অক্টোবরে দিওয়ালীর সময় তিনি প্রচুর আতশবাজি আর পটকা কিনতে শুরু করেন। সেখান থেকে তিনি বারুদ বের করে নিয়ে বোমা বানাতে শুরু করেন। কয়েকমাসের মধ্যেই সেটি প্রস্তুত হয়ে যায়। এরপর একটি কাপ বোর্ড বাক্সে সেটি বসিয়ে উপহারের কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারির এক সকালে তিনি কলেজে গিয়ে কয়েকটি ক্লাস নেন। এরপর বাড়িতে ফিরে আসেন। এরপর বোমার বাক্সটি নিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে রেলওয়ে স্টেশনে যান। যদিও মোবাইল ফোন বাড়িতেই রেখে আসেন, যাতে প্রমাণ হয় যে, তিনি সবসময় বাড়িতেই ছিলেন।

রেলে তিনি এমনটি টিকেটও কাটেননি, যাতে সিসিটিভির ক্যামেরায় তার ছবি না ওঠে। রেলে করে তিনি রায়পুরা স্টেশনে এসে নামেন। সেখানে কয়েকটি কুরিয়ার সার্ভিস ঘুরে প্রথমে একটি অফিসে থামেন। সেখানে রিকশাচালককে দিয়ে প্যাকেটটি পাঠানো হয়। কিন্তু কাউন্টারের কর্মী যখন জানতে চান, পার্সেলের ভেতর কি আছে, তিনি দৌড়ে ভেতরে ঢুকে তাড়াতাড়ি পার্সেলটি নিয়ে আসেন।

এরপর আরেকটি কুরিয়ার সার্ভিসে গিয়ে বিয়ের উপহার হিসাবে মিষ্টি লিখে বুকিং করেন। এরপর বিকালের রেলে তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন।

পরবর্তী কয়েকদিনে তিনটি বাস, চারজনের হাত ঘরে সাড়ে ছয়শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পার্সেলটি পাটনাগড়ে পৌঁছায়। এর তিনদিন পর সাহুর বাড়িতে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটে।

মেহের বিয়েতে গিয়েছিলেন, নিহত সাহুর শেষকৃত্যানুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন।

‘আমি রাগ আর ক্ষোভের কারণে এই কাজটি করেছি। অপমান আমি সহ্য করতে পারছিলাম না’ মেহের পুলিশকে বলেছেন।

তথ্যসূত্র: বিবিসি।

একে// এসএইচ/