ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

বিনামূল্যে রোগী পরিবহনেই দুলালের সুখ

রিজাউল করিম

প্রকাশিত : ০৬:৪৬ পিএম, ৬ মে ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৫:৪৮ পিএম, ৭ মে ২০১৮ সোমবার

দুলাল চন্দ্র দাস। গ্রামের বাড়ি রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারের বলিয়াপুরে। বসবাস ঢাকার গাবতলীতে। বয়স ৪০ বছর পেরিয়েছে। পেশায় সিএনজি চালক। সামান্য একজন শ্রমজীবী হয়েও তিনি তৈরি করেছেন মানবতার এক অনন্য উদাহরণ। পরোপকারের নেশায় নিজেকে বিলিয়েছেন গরিব-অসহায় রোগীদের পরিবহন সেবায়। সামান্য একটা ফোন কল পেলেই, তিনি ছুঁটে যাচ্ছেন রোগীদের পাশে। বিনামূল্যে পৌঁছে দিচ্ছেন ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।

আর এ সেবা দিতে গিয়ে তিনি নিজের সিএনজিকে রাঙ্গিয়েছেন ডিজিটালের ছোঁয়ায়। সিএনজির ছোট্ট ওই জায়গাটিতে রোগীর বসার জন্য রাখা হয়েছে অভিযাত শ্রেণীর এক সোফা। সোফায় রাখা হয়েছে দুটো কুশন। যেখানে রোগী ও তার সঙ্গের ব্যক্তি স্বাচ্ছন্দে বসতে পারবেন। সোফার সামনে রাখা হয়েছে একটি টেলিভিশন। যা রোগীকে মানসিক শক্তি যোগান দেওয়ার জন্য দেখানো হয়। রোগী ও তার সঙ্গের ব্যক্তির হঠাৎ কোন রোগ দেখা দিলে রাখা হয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ। সুদৃশ্য একটি বাক্সে রাখা হয়েছে টিস্যু পেপার। পাশেই রাখা হয়েছে বিশুদ্ধ পানির একটি বতল। সোফার সামনে রাখা হয়েছে একটি ফ্যান। যেটা রোগীকে বাতাস দিয়ে গরমের হাত থেকে রক্ষা করবে। সিএনজিতে উঠে রোগীর চেহারা দেখা ও এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে নেওয়ার জন্য আছে বড় একটি আয়না ও দুটি চিরুনি। এছাড়া সিএনজিতে বসে কেউ ইন্টারনেট দুনিয়ায় প্রবেশির জন্য রাখা হয়েছে ওয়াইফাইসহ প্রয়োজনীয় নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা।

সামান্য একজন চালক হয়েও তিনি সিএনজির ওই ছোট্ট পরিসরে নাগরিক জীবনের আধুনিক এতোসব উপাদানের পসরা সাজিয়েছেন শুধু রোগীর উদ্দেশ্যে। তবে নিরেট এই মানব সেবাই ব্যতিক্রমী কাজের জন্য তাকে নিন্দুকেরা শুনিয়েছেন অনেক কথা। কেউ বলেছেন, ‘আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর’, কেউ বলেছেন, ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’, কেউবা বলেছেন, ‘নিজে খায়তে পায় না- শঙ্করে ডাকে’, ‘নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানো’। অর্থাৎ নিন্দুকেরা তাকে বুঝাইতে চাইছেন সামান্য সিএনজি চালক হয়ে, গাড়িতে এতোসব রাখা বড় লোকের বাহাদুরি দেখানোর সমান। সামান্য কিছু টাকা হয়েছে তাই লাফালাফি করছে। নিজের পেটে ভাত জোটে না, অন্যকে দেওয়ার খায়েস। কাজ আর নেই, অকাজ করে।

তবে পরিচিত-অপরিচিত ও বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে যারাই এ কথা বলেছিলেন তারাই এখন হার মেনেছে দুলালের ইচ্ছা শক্তির কাছে। পরাজিত হয়েছে তার মানব সেবা দেওয়ার দৃষ্টান্তের কাছে। কারণ রোগীদের ফ্রি পরিবহন সেবা দেওয়া অব্যাহত রেখেই ১০ বছর আগের পেটের ভাত যোগাতে অক্ষম দুলাল এখন দুটি সিএনজির মালিক। বিনামূল্যে রোগীর পরিবহন সেবা দিয়েও যেখান থেকে তার প্রতিদিনের আয় আসছে ২৪শ’ টাকা। আর তাই দুলালের স্বপ্ন এখন জীবনের শেষ মুহুর্তেও যেন সে পরিবহন সেবা দিতে পারে।

কারণ  শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে অষ্টম শ্রেণী পাশ দুলাল হৃদয়ে ধারণ করেছেন মানব সেবার মাহত্ম। তিনি জেনেছেন স্বামী বিবেকানন্দ`র চিরন্তন সেই উক্তি-"জীবে দয়া করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর"। শুনেছেন হযরত মুহাম্মদ (স:) এর সেই বাণী-আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘দয়াকারীদের প্রতি মহান দয়াময় আল্লাহ রহম ও দয়া করেন। দুনিয়াতে যারা আছে; তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো, তাহলে আসমানে যিনি আছেন; তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। (আবু দাউদ ও তিরমিজি)।

আবার নিজের জীবনে মেনে চলেছেন দুলাল ভুপেন হাজারিকার সেই অমর গান ...মানুষ মানুষের জন্য/জীবন জীবনের জন্য/একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না/ও বন্ধু/

জানতে চাইলে দুলাল বলেন, আমি একজন গরিব ঘরের সন্তান। আমি নিজের জীবনের কষ্টের ঘটনা থেকে গরিব রোগীদের সেবা দেওয়ার এ ব্রত গ্রহণ করি। বর্তমানে আমার সংসারে তিন সন্তান ও বাবা-মাসহ মোট ৭জন। আমরা দুই ভাই-বোন। বোন বিবাহিত। অর্থের টানা পড়েনে আমি অষ্টম শ্রেণীর ওপর পড়তে পারিনি। আমার বাবার ৫টি গরু ছিল। যার মধ্যে ২টি ছিল দুধালো। দুধ বিক্রি করেই আমাদের সংসার চলতো। কিন্তু আমার বড় বোনের বিয়ের খরচে সবকটি গরু বিক্রি করে দিতে হয়। এরপর আমাদের সংসারে চরম অর্থ কষ্ট দেখা দেয়। উপয় না পেয়ে আমি আজ থেকে প্রায় দেড় যুগ আগে বেবিট্যাক্সি চালানো শুরু করি। বেবিট্যাক্সি চালিয়ে মোটামুটি চলছিল আমাদের সংসার। দিন আনি দিন খায় হলেও সে সময় যেন একটা সুখের ছন্দ ছিল আমার জীবনে। অর্থের টানা পড়েন কিছুটা থাকলে সুখের ভাগটা ছিল বেশি। কিন্তু সে সুখ আমার সইলো না। আমার জীবনে নেমে আসলো কালবৈশাখী ঝঁড়।

রাজধানীর কল্যাণপুরে আমার বেবিট্যাক্সির সঙ্গে ট্র্যাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে মারাত্মকভাবে পায়ে আঘাত পেলাম আমি। ঘটনাটি ছিল ২০০০ সালের। সে সময় আমার সংসার পথে নেমে যায়। অর্থের অনটনে চিকিৎসা তো করাতে পারতাম না। সরকারিভাবে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য হাসপাতালে যাওয়ার পরিবহন খরচটাও ছিল না। আমার মেয়ে ছিল খুব ছোট। তার জন্য একটি কাঁশির সিরাপ কিনে দিব সেই টাকাও ছিল না আমার। মেয়ের অসুস্থ্যতা, বাবা-মার হাপানির সমস্যাসহ পারিবারের নানাবিধ সমস্যায় জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিসহ। উপয় অন্তর না দেখে আমি গাবতলী থেকে শ্যামলী শিশু হাসপাতালে আসতাম লাঠির উপর ভর করে। কষ্টে জীবনটা যেন বের হয়ে যেত। সিএনজিতে যে পথ আসতে ৫ থেকে ৭ মিনিট লাগে। সেই পথ আমার আসতে সময় লাগতো দেড় থেকে ২ ঘণ্টা। আমার ছোট মেয়েকে সঙ্গে করে আমি সে সময় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসতাম। হাসপাতালে যাওয়ার সময় অসম্ভব রকমের কষ্টে আমার মনে হতো, ভগবান আমার জন্য কি কারো মনে একটু দয়া তৈরি করে দিবে না? আমি তো আর কষ্ট সইতে পারছি না। কেউ যদি আমাকে একটু বাড়িতে দিয়ে আসতো। আমি মনে হয় জীবনভর তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতাম। কিন্তু আমার পরিবহন সেবা দেওয়ার সে চাওয়া অনুযায়ী কাউকে পায়নি। তাই সেদিন বলেছিলাম, ভগবান আমার সুস্থ করো। আমি আমার সামার্থ অনুযায়ী গরিব-অসহায় রোগীদের পরিবহন সেবা দিয়ে যাবো। ভগবান আমার কথা শুনেছে, আমি ভালো হয়ে গেছি। তাই আমার মতো কষ্টো যেন আর কেউ না পায় সেজন্য আমি গত ২০১১ সাল থেকে এ পরিবহন সেবা দিচ্ছি।

প্রথমে আমি এলাকার দুটি এনজিও থেকে কিস্তিতে ঋণ নিয়ে তিন লাখ টাকার এ গাড়ি কিনি। এরপর শুরু হয় আমার পথচলা। সম্প্রতি একটি টেলিভিশনে বহুলপ্রিয় একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে আমাকে তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে বিনামূল্যে গরিব রোগীদের পরিবহন সেবা দেওয়ার জন্য আমাকে সম্মান দেখিয়ে ১ লাখ টাকা দেওয়া হয়। সেই ১ লাখ টাকা, আমার কাছে গোচ্ছিত ৫০ হাজার টাকা ও ফের ১ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে মোট আড়াই লাখ টাকা দিয়ে নতুন আরো ১টি সিএনজি কিনেছি। যেটি আমি ভাড়া দিয়েছি। ভাড়া থেকে আমার প্রতিদিন আয় হচ্ছে ৮০০ টাকা। আর আমি নিজে একটি চালিয়ে প্রতিদিন আয় করছি ১৬০০ টাকা। সে হিসেবে প্রতিদিন আমার মোট আয় হচ্ছে ২৪০০ টাকা। এখন আমি মানুষকে সেবা দিচ্ছি। ভালোবাসা দিচ্ছি। তাই আমিও ভালোবাসা পাচ্ছি। সুখ পাচ্ছি।

কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আমাকে বুঝে না। তাদের ব্যবহার আমাকে খুব কষ্ট দেয়। যেগুলো আমার জীবনের তীক্ত অভিজ্ঞতা বলতে পারেন। যেমন গত বৃহস্পতিবার নারায়নগঞ্জ থেকে একটি রোগী নিয়ে কারওয়ান বাজার ইটিভি ভবনের পাশ দিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কারওয়ান বাজারের সিগনালে পড়ি। আমার গাড়ীতে থাকা রোগীর অবস্থা খুবই শোচনীয় দেখে আমি দায়িত্বরত সারজেন্ট হামিদকে অনুরোধ করি, স্যার আমার রোগীকে একটু সুযোগ দেন। আমার গাড়িকে ছেড়ে দেন। রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। সে তখন জানতে চাই, আমার গাড়ি অ্যাম্বুলেন্স কিনা? কাগজপাতি আছে কি না? এই-সেই নানাবিধ। পরে আমি বলি দেখেন রোগী মরে গেলে দায় কিন্তু আপনার। তখন সার্জেন্ট আরো রেগে গিয়ে আমার বুকে লাঠি দিয়ে তিনবার আঘাত করে। এরপর উপস্থিত লোকদের রোশানলে পড়ে সার্জেন্ট বাধ্য হয় গাড়ি ছেড়ে দিতে। গাড়ি ছাড়লেও সেদিনের সেই ব্যথা আমি আজও বহন করে যাচ্ছি। তাই আমি বলবো মানুষ আজ মরলে কাল দুই দিন। কিছুই সঙ্গে যাবে না। পূণ্যের কাজ করলে ভগবান খুশি হবেন। তাই সবার উচিত যার যার জায়গা থেকে মানব সেবায় নিবেদিত হওয়া।

টিকে