স্মৃতিতে শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়
মো. মুজিবুর রহমান
প্রকাশিত : ১০:৫১ পিএম, ৬ মে ২০১৮ রবিবার
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসাবে খ্যাত একটি নাম শায়েস্তাগঞ্জ। ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে সিলেট যেতে হলে একমাত্র আকাশপথ ছাড়া হবিগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী এলাকা শায়েস্তাগঞ্জ না ছুঁয়ে যাওয়া যায় না। এ জন্য অনেক জেলা প্রশাসক মহোদয় বলে থাকেন শায়েস্তাগঞ্জের নামেই হবিগঞ্জের পরিচিতি। ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা খর¯্রােতা খোয়াই নদীর তীরের নিকটবর্তী পশ্চিমপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে ঐতিহ্যবাহী শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় অবস্থিত।
আমি উবাহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণি সমাপনান্তে ১৯৭৫ সালে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই এবং ১৯৮০ সালে মার্চ মাসে এসএসসি পরীক্ষা শেষে এ স্কুলে শিক্ষাজীবন শেষ করি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এ ০৫ (পাঁচ) বছর আমার জীবনের স্মরণীয় অধ্যায়।
নতুন স্কুলের নতুন পরিবেশ নতুন বন্ধুদের মাঝে নতুন জীবন শুরুর কিছুদিন পরই এক সপ্তÍাহ স্কুল বন্ধ হবে গ্রীষ্মকালীন ছটির জন্য। এ ছুটি উপলক্ষে স্কুলের রেওয়াজ অনুযায়ী প্রত্যেক ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা নিজ নিজ শাখা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বিভিন্ন আলপনা এঁকে, বিখ্যাত মনীষীদের বাণী দেয়ালে সাঁটিয়ে কার শাখা কত সুন্দর করা যায় সেদিকে সবাই ব্যস্ত। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহোদয়সহ অন্যান্য শিক্ষক ছুটি ঘোষণার দিন প্রতিটি শাখা পরিদর্শন করে ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান অধিকারী শাখা শনাক্ত করে পুরস্কার বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
স্কুল ভবন, সুবিশাল খেলার মাঠ, শিক্ষকদের আন্তরিক শিক্ষাদান পদ্ধতি, আজও আমার মনকে দোলা দেয়। সে আলোকে কিছু বর্ণনা: ৬ষ্ঠ শ্রেণির আমাদের ক্লাস রুমটা ছিল প্রধান শিক্ষক (জনাব আবদুন নূর চৌধুরী) মহোদয়ের অফিসের উল্টোদিকের বিল্ডিংয়ে। জনাব সুরেশ চন্দ্র দেব স্যার আমাদের ক্লাস টিচার এবং গণিত ক্লাস নিতেন, সরল অংকের সহজ পদ্ধতি (BADMAS) বোর্ডে লিখে দিয়ে বললেন এটা মনে রেখে অংক করলে যত বড় সরল অংকই হোক কখনও ভুল হবে না। ৭ম শ্রেণি ‘খ’ শাখায় বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক জনাব মালেক স্যার সমাজ পড়াতেন, ক্লাসে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করতেন আজ কি পড়া? জানানো হলো ‘ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির শাসন আমল’, বই ছাড়াই পুরো ক্লাস শেষ করতেন। একই ক্লাসে জনাব মহেশ^র স্যার বিজ্ঞান পড়াতেন, যদি কোনো ক্লাসে ২/৩ জন বাদে কেউ পড়া শিখে না আসত তাহলে ঐ ২/৩ জন বাদে সবাইকে Detain রাখা হতো অর্থাৎ ৮ম পিরিয়ডের পর তাদের ক্লাস নেওয়া হতো। এরকম ছিল স্যারের শাসন ব্যবস্থা। ৮ম শ্রেণিতে জনাব আফিল উদ্দিন স্যার ইংরেজি ক্লাস নিতেন, উনার ক্লাসে পড়া বোঝানোর ধরন ছিল অন্য রকম। ক্লাসে বোর্ডে সিঁড়ি (মই) এঁকে Step by Step Poem টি খুব সহজে আমাদের বুঝিয়েছেন। জনাব খালেক স্যার (পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক) ক্লাসে খুব সহজে সাবলীলভাবে ইরেজি পাঠদান করতেন যা আজও মনে পড়ে- ক্লাসে Easy এবং Understand শব্দ দুটির বঙ্গাব্দ জানতে চেয়ে কয়েক শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করলেন Easy এই সহজ এবং Understand - এর অর্থ কি বোঝ না। এভাবেই স্যার ক্লাসে কঠিন কঠিন শব্দগুলোর অর্থ ক্লাসেই শিখিয়ে দিতেন।
জনাব নৃপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত স্যার ক্লাসে বোর্ডে কিছু লিখছিলেন এর মধ্যে একটি বানান ভুল ছিল, পিছন দিক থেকে কোন শিক্ষার্থী বলল, ‘স্যার বানান ভুল হয়েছে।’ স্যার লেখা শেষ করে বললেন, এভাবে সরাসরি বলতে নেই, ‘বলতে হবে স্যার এ লাইন বা প্যারাটি আবার পড়েন।’ তারপরও যদি শিক্ষক ভুল বের করতে না পারেন তাহলে ভুল শব্দটি দেখিয়ে বিনয়ের সাথে বলতে হবে। এটা ছিল স্যারের কাছ থেকে আদব কায়দা শেখার একটি উদাহরণ। স্যার এদিন আমাদের এও শিখিয়েছিলেন, বড়দের/গুরুজনদের/সম্মানিতদের নামের আগে জনাব বা পরে সাহেব বলতে হয়। জনাব বিপদবারন স্যারের কেমিস্ট্রি পড়ায় কোন ছাড় ছিল না, সব বিষয়ে আগে স্যারের পড়াটা শিখে অন্য বিষয়ের পড়া শেখা হতো এজন্য অনেকেই কেমিস্ট্রিতে লেটার নম্বর (৮০) পেত। আর মওলানা আব্দুর রশীদ স্যারের কথা তো এ স্কুলের কেউই ভুলতে পারবে না, স্যারের বেতের পিটুনি খায়নি এমন ছাত্র খুব কমই আছে।
জনাব রন্জিত স্যার ছিলেন অমায়িক এক ব্যক্তিত্ব। তিনি আমাদের স্কুলসহ শায়েস্তাগঞ্জ কলেজেও কেমিস্ট্রি ক্লাস নিতেন (পরবর্তীতে কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন হন)। স্যার ছিলেন সব বিষয়েই পারদর্শী। এছাড়া জনাব আব্দুল খালেক স্যার (সহকারী প্রধান শিক্ষক), ওমর আলী স্যার, জলিল স্যার, তাহের আলী স্যার, তাহের মিয়া চৌধুরী স্যার, ফরিদ স্যার (ব্যাংকার), সুখময় স্যার, ইসমাইল স্যার, রহিম আলী স্যার উনারা সবাই ছিলেন বিষয় ভিত্তিক পারদর্শী। আমি শ্রদ্ধাভরে স্কুলের সকল শিক্ষককে স্মরণ করি।
আমাদের প্রধান শিক্ষক জনাব আব্দুন নূর চৌধুরী, উনার প্রশাসনিক কৌশল, শিক্ষাদান কৌশল ইত্যাদি ছিল অনন্য। স্যার মাঝে মধ্যেই কোন না কোন ক্লাসে হঠাৎ করেই পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসে ক্লাস উপভোগ করতেন এবং মাঝে মধ্যে পাঠদানরত শিক্ষককে বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন। এভাবেই স্যার স্কুল পরিচালনা করতেন ফলে ছাত্র-শিক্ষক কারো পক্ষে ফাঁকি দেয়ার কোন রাস্তা ছিল না। আমি মনে করি শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মানেই জনাব আব্দুন নূর চৌধুরী। স্কুলে স্যারের শাসন ব্যবস্থা এমন ছিল- যদি কোন কারণে কোন ছাত্রকে প্রধান শিক্ষক কর্তৃক শাস্তি দেয়া হতো তাহলে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে বেত্রাঘাত করা হতো এবং কারণ উল্লেখ করে নোটিশ আকারে প্রত্যেক ক্লাসে জানিয়ে দেয়া হতো। এতে সমস্ত স্কুল সাবধান হয়ে যেত।
যা হোক হাজার প্রতিক‚লতা সত্তে¡ও এ স্কুলের লেখাপড়ার মান ধারাবাহিকভাবে ভালো আছে। বাংলাদেশের সাবেক দুজন মাননীয় প্রধান বিচারপ্রতি এ বিদ্যালয়ের ছাত্র। অন্যদিকে সচিব, প্রকৌশলী, চিকিৎসকসহ বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদে আসীন অনেকেই এ বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানিত।
১৯৮০ সালের অর্থাৎ আমাদের ব্যাচের একজন চিকিৎসক ও একজন প্রকৌশলীসহ বেশ কয়েকজন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন আছেন।
শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন ছাত্র সর্বোপরি শায়েস্তাগঞ্জের ছেলে হিসাবে আমি গর্বিত। আমি শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের সর্বাঙ্গীন উন্নতি ও সাফল্য কামনা করি এবং এ বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতিতে ও সকল কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করি ও করবো।
লেখক: অডিট এন্ড একাউন্টস অফিসার, অডিট ভবন, ঢাকা