ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

ডা. মাহাথির মোহাম্মদ: আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক

শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত : ১১:৫২ পিএম, ৯ মে ২০১৮ বুধবার

পুরো বিশ্বের কাছে এক পরিচিত নাম ডা. মাহাথির বিন মোহাম্মদ। একজন রাষ্ট্র নায়ক কেমন হতে পারেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ৯২ বছর বয়সী এই ব্যক্তি। সাধারণ এক পরিবার থেকে উঠে আসা মাহাথির নিজে বড় হয়েছেন, সফলতার শীর্ষে নিয়ে গেছেন নিজের দেশকে। আজকে জানুন মাহাথিরের জীবন গল্প।

১৯২৫ সালের ১০ জুলাই মালয়ে যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেন তখনও মালয় ব্রিটিশ কলোনীভুক্ত। কেদাহ অঞ্চলের সেতার নামক গ্রামে সাধারণ এক স্কুল শিক্ষকের ঘরে জন্ম নেন তিনি। মাহাথিরের আগে যে তিন জন প্রধানমন্ত্রী মালয়েশিয়া শাসন করেছেন তারা সবাই ছিল রাজবংশীয় অথবা সমাজের ধনাঢ্য শ্রেণীর। সেই অর্থে তিনি বেশ সাধারণই বৈকি!

প্রায় অসাধ্য সাধন করে মালয়ের একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি হন তিনি। অন্য সবাইকে ছাপিয়ে ক্লাসের ‘রোল-১’ হয়ে ওঠেন তিনি। ইংরেজ শিক্ষক বাবার কাছ থেকেই হয়তো ইংরেজির জাদুকরী দক্ষতা পেয়েছেন তিনি। স্কুল থেকে কলেজ আর সেখান থেকে ভর্তি হন মেডিকেল কলেজে। ১৯৪৭ তিনি যখন সিঙ্গাপুরের কিং অ্যাডওয়ার্ড সেভেন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন তখন সেখানে মালয় শিক্ষার্থী ছিল মাহাথিরসহ মাত্র ৭ জন।

কর্মজীবন

এমবিবিএস পাসের পর মালয়েশিয়ার সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন মাহাথির। চাকরি করেন মালয়ের একটি সরকারি হাসপাতালে। তবে সরকারি বিধি নিষেধের বেড়াজাল বেশি দিন ভালো লাগেনি তার। তাই সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই খুলে বসেন একটি প্রাইভেট ক্লিনিক। এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাহায্যে চালানো এই হাসপাতালটিই ছিল সে সময়ে মালয় বংশোদ্ভুত কোন ব্যক্তির মালিকানাধীন একমাত্র হাসপাতাল।

চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার মধ্যে দিয়েই সাধারণ মানুষের খুব আসার সুযোগ পান মাহাথির। সেই সাথে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন তিনি। গণমানুষের সাথে গণ সম্পৃক্ততা তাঁর সেই সময় থেকেই শুরু। পরবর্তী জীবনে প্রধানমন্ত্রী হয়েও সাধারণ মানুষের একদম কাছাকাছি থাকতেন এই নেতা।

রাজনীতি

মাহাথির বিন মোহাম্মদ নিয়ে আলোচনা হলে যে বিষয়টি নিয়ে সব থেকে বেশি আলোচনা করা যাবে তা হলো মাহাথিরের রাজনৈতিক জীবন। ছাত্র অবস্থায়ই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন মাহাথির বিন মোহাম্মদ। এমনকি সরকারি ডাক্তার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়েও রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চেয়েছিলেন তিনি। অনেকে মনে করেন, শুধু রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। রাজনৈতিক দল ইউএমএনও থেকে মালয় প্রাদেশিক রাজ্যের শীর্ষ পদে নিয়োগ পান।

সংখ্যায় মাহাথিরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার

-           ১৯৬৪ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে সংসদে একজন সদস্য নির্বাচিত হন

-           ১৯৬৯ সালে আবারও সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি।

-         সেবছরই নিজ দলের প্রধান এবং সেসময়ের মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টেংকু আবদুর রহমানের সাথে মত বিরোধে তিন বছর রাজনীতি থেকে অবসরে ছিলেন। ১৯৬৯ এর ৩০ মে সংঘটিত চীনা ও মালয়ীদের মধ্যেকার দাঙ্গার জন্য টেংকু আবদুর রহমানকে দায়ী করেছিলেন মাহাথির।

-           ১৯৭২ সালে আবার রাজনীতিতে ফিরে আসেন। সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হন।

-           ১৯৭৪ সালের নির্বাচনে জয় লাভের পর শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।

-           সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী তুন হোসেন শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরলে উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৭৬ সালে।

-           ১৯৮১ সালের নির্বাচনে দেশটির চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন মাহাথির বিন মোহাম্মদ।

-           দীর্ঘ ২২ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার পর ২০০৩ সালে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে সরে আসেন মাহাথির বিন মোহাম্মদ।

  

যেভাবে বদলে দিলেন মালয়েশিয়াকে

মালয়েশিয়ার আমূল পরিবর্তনে শুরু থেকেই স্বপ্ন দেখেছেন মাহাথির। ক্ষমতায় আসার পর একের পর পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি বাস্তবায়নও করেছেন সেগুলো। দেশটির ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মসূচিও তাঁর ঘোষণা করা ছিল। মাহাথির শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ দিক-

-           মালয়েশিয়ার সকল মুসলিমদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন তিনি।

-           মালয়েশিয়ানদের শিক্ষার ৯৫ শতাংশ খরচ সরকার বহন করে। এই নীতি চালু হয় মাহাথিরের আমল থেকে।

-           আশির দশকে গৃহিত ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাস্তবায়ন করা শুরু করেন তিনি। ফলাফল এই যে, ১৯৯২ সালে নিজ দেশের সবাইকে কর্মসংস্থান দিয়ে উলটো আরও ৮ লক্ষ বিদেশী শ্রমিক নিয়োগ দেয় মালয়েশিয়া।

-           একই বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতেই ৬৫০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করে।

-           পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার নির্মাণ, সমুদ্র থেকে ৬,৩০০ হেক্টর জমি উদ্ধার, অত্যাধুনিক এয়ারপোর্ট তৈরি, একাধিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, হাইওয়ে নির্মাণসহ তার অসংখ্য উদ্যোগ সফল হয়েছে।

-           ১৯৯০ সালেই বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছাড়িয়ে যায় ৮ শতাংশের বেশি।

-           ১৯৮২ সালে থাকা মালয়েশিয়ার ২৭ দশমিক ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ জিডিপি ২০০২ সালে এসে দাঁড়ায় ৯৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডোলার।

-           অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর তালিকার তলানীতে থাকা মালয়েশিয়াকে নিয়ে আসেন তালিকার ১৪তম স্থানে।

-           সরকারি দপ্তরগুলোতে আমূল পরিবর্তন আনেন তিনি। সরকারি কর্মীরা যেন ঠিক সময়ে অফিসে আসেন তার জন্য প্রথমবারের মতো চালু করেন ফ্লো-চার্ট।

মাহাথিরের ব্যক্তি জীবন

ব্যক্তিজীবনে মাহাথির ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি একাই যে স্বপ্ন দেখেছেন এমনটা নয়। পুরো জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। চীনা, মালয়ী, তামিলসহ বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত মালয়েশিয়াকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। তিনি কর্মীদের যা করতে বলেছেন তা নিজে করেও দেখিয়েছেন।

সরকারি কর্মীরা যেন ঠিক সময়ে অফিসে আসেন সেজন্য নিজেও ঠিক সময়ে অফিসে আসতেন। টাইম ম্যাগাজিন একবার তার অফিসে আসার সময় রেকর্ড করেছিল। পরপর পাঁচ দিন তার অফিসে প্রবেশের সময় ছিল সকাল ৭:৫৭, ৭:৫৬, ৭:৫৭, ৭:৫৯, ৭:৫৭

তিনি নিজে একজন পরিশ্রমী এবং শৃংখলা পরায়ণ মানুষ ছিলেন। সময়ের মূল্য দিতে জানতেন তিনি।

সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শাস্ত্র পড়ার সময় তার সাথে যে ছয় জন মালয়ী শিক্ষার্থী ছিলেন তাদের একজন ছিলেন সিতি হাসমাহ নামের একজন ছাত্রী। এই সিতিকেই নিজের জীবনের সঙ্গী করে এতটা পথ হেটেছেন।

সর্বশেষ

সবকিছু ঠিক থাকলে মাহাথির বিন মোহাম্মদ আবারও হাল ধরতে যাচ্ছেন মালয়েশিয়ার। আজ বুধবার অনুষ্ঠিত মালয়েশিয়ার সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তার দল পাকাতান হারাপান।

দীর্ঘ ১৫ বছর রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মাহাথির বিন মোহাম্মদ আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন।

সূত্র: রোর বাংলা,ইন্টারনেট

টিকে